বুদ্ধিমান বাবা
সকাল বেলা মায়ের চিৎকার আর থালা বাটি ছোড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে।উহু,মাকে নিয়ে আর পারা যায় না। অসম্ভব রাগী,বাবার উপর বেশি রাগ দেখায় আমরাও বঞ্চিত হই না।আমি আর ছোট বোন অনন্যা এক ঘরে থাকি। অনন্যা ঘুমাচ্ছে।
খাট থেকে আস্তে করে নেমে বাবার ঘরে গেলাম।আহারে আমার সহজ, সরল গো বেচারা বাবা,মুখ কালো করে বিছানায়
বসে আছে।বাবা ব্যাংকে চাকরি করেন।
বাবার পাশে যেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললাম , আজ আবার কি হলো বাবা?পরশুদিনই তো মা চেচাঁমেচি করলো।
পরশু দিনের রেশ আজও চলছে রে অবনী।অনন্যা আমাকে বললো না, তোর মাকে মধু খাওয়াতে। মধু খাওয়াতে যেয়েই তো সর্বনাশ।
তুমি মাকে মধু খাওয়াতে গিয়েছিলে? কি আশ্চর্য! বাবা তোমাকে নিয়ে আর চলে না।
পরশু দিন বাবা অফিস থেকে ফেরার সময়, সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে এনেছে। যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার চা পাতা সেটা আনতেই ভুলে গেছে। সকালবেলা চা না খেলে মায়ের মাথা ব্যাথা করে। শুরু হলো মায়ের চিৎকার। বাবা করুণ মুখে আমাদের ঘরে এসে বসলেন।
অনন্যা বলে উঠল, আচ্ছা বাবা, মা সারাক্ষণ এই রকম বকাঝকা করে কেন?একটুও ভালো করে, মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না?
বুঝলি অনন্যা,আমার মনে হয় তোর মা জন্মানোর সাথে সাথে তোর নানি মুখে মধু দিতে ভুলে গিয়েছিল এজন্য এমন করে।এই কথা বলে বাবা একটু হাসলেন।
অনন্যা জিজ্ঞেস করল, বাবা জন্মের সময় মুখে মধু দিলে সত্যি সত্যি মিষ্টি করে কথা বলে? কতটুকু দিত বাবা?
সামান্য একটু দিত রে মা।নিশ্চয়ই কাজ হয়,আগের দিনে মা, চাচি,দাদিরা কত মিষ্টি করে কথা বলত। অথচ এখন দেখ,
সবাই রাগী। মধু না খাওয়ানোর ফল।
অনন্যা হেসে বলল,বাবা এখনও যদি প্রতিদিন এক চামচ করে মধু মাকে খাওয়ানো যায় তাহলে মা নিশ্চয়ই মিষ্টি করে কথা বলবে।মাকে মধু খাওয়াবে বাবা?
বাবা কোন কথা না বলে চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।
বাবার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা কি হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলবে?
বাবা মলিন হাসি দিয়ে বলল,অনন্যার কথাটা আমার খুব মনে ধরল।গতকাল দোকান খুঁজে খাঁটি সুন্দরবনের মধু এনেছি। সকালে এক চামচ মধু তোর মাকে দিয়ে বললাম,এটা খেয়ে নেও।
তোর মা রাগী গলায় জিজ্ঞেস করল,
কি এটা? সাত সকালে এটা খাব কেন?
খারাপ কিছু না এটা মধু।তুমি অনেক মোটা হয়ে যাচ্ছ তো, মধু মোটা কমাতে সাহায্য করে। এই কথা বলার সাথে সাথে তোর মা হাতের কাছে যা পেয়েছে ছুড়ে মেরেছে। আমি কোনোরকম পালিয়ে এসেছি।
বাবা তুমি জানো না! মোটা বললে মা ভিষণ রেগে যায়। তারপরও মোটা বললে কোন সাহসে?
তাহলে কি বলতাম বল? বলব যে, তোমার কথা যাতে মিষ্টি হয় এজন্য মধু খাও। তাহলে তোর মা আমাকে আস্ত রাখত?
অনন্যা মজা করে বলেছে আর সেটা তুমি সত্যি সত্যি করেছ।তুমি এত সরল কেন বাবা?
বাবা হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
ছোটবেলা থেকে মার উগ্র মূর্তি,আর বাবার শান্ত মূর্তি দেখে আমরা অভ্যস্ত্য।
আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আর অনন্যা এবার এইচএসসি দেবে।আমাদের বাড়িতে একনায়কতন্ত্র প্রচলিত। মা যা বলবে আমাদের তাই শুনতে হবে।কারোর মতামত দেওয়ার কোন অধিকার নেই।
আমার থেকে তিন ইয়ার সিনিয়র সাদিকের সাথে আমার সম্পর্ক। সাদিক ব্যাংকে নতুন চাকরি পেয়েছে। বাড়িতে সাদিকের কথা বলতে হবে, কিন্তু কোনোভাবেই সাহস পাচ্ছি না। কোনদিন না মা আবার অন্য কারোর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে! এ নিয়ে খুবই চিন্তাই আছি।
কয়েকদিন পর বাবা হাসিমুখে আমাদের ঘরে এসে বললেন, বুঝলি অনন্যা আমাদের বাড়িতে বিশাল আনন্দ হবে। তোর মা ফোনে তার কোন চাচাত ভাইয়ের ছেলের সাথে অবনীর বিয়ের কথা বলছে।
বাবার মুখে আমার বিয়ের কথা শুনে আঁতকে উঠলাম,আর দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে বললাম, বাবা তুমি আমাকে বাঁচাও।আমি একজনকে ভালোবাসি।ওকে ছাড়া বাঁচব না।
বাবা আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বললেন, কি সর্বনাশের কথা বলছিস অবনী? তোর মাকে না জানিয়ে প্রেম! এখন তোর মাকে এই কথা কে বলবে?আমি পারবো না, আমাকে জবাই করবে।তুই বল।
মা মনে হচ্ছে, আমাকে কোলে নিয়ে চুমু খাবে? আমাকেও মেরে ফেলবে।প্লিজ বাবা কিছু একটা করো।
কি সমস্যায় ফেললি বল তো?হাতে সময়ও বেশি নেই। তোর মা যদি তার ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে ফাইনাল করে তাহলে আর কিছুই করার থাকবে না। তুই ছেলে সম্পর্কে গুছিয়ে আমাকে বল।
বাবা ওর নাম সাদিক। ছোটোবেলায় ওর বাবা-মা একসিডেন্টে মারা যায়।চাচার কাছে গ্রামে মানুষ। বড়ো হয়ে ঢাকায় এসে পড়ালেখা শেষ করে। এখন ব্যাংকে নতুন চাকরি পেয়েছে। মেসে থাকে।
আচ্ছা তুই ওর মেসের ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বার দে।দেখি কতদূর কি করতে পারি।
রাতে বাবা চুপিচুপি আমাদের ঘরে এসে বললেন,কাল সাদিক আমাদের বাড়িতে আসবে।অবনী তুই যে সাদিককে চিনিস এটা যেন তোর মা কোনোভাবেই বুঝতে না পারে।তুই সাদিকের সামনেই যাবি না।
পরদিন বিকালে, কলিং বেলের শব্দে অনন্যা দরজা খুলল।পর্দার আড়াল থেকে দেখলাম সাদিক এসেছে।
কে এসেছে অনন্যা? বলতে বলতে মা ড্রইং রুমে ঢুকে, সাদিকের দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল, কাকে চাচ্ছেন?
জি আমি সাদিক,ব্যাংকে চাকরি করি আমজাদ স্যারের সাথে একটু দেখা করা দরকার। ব্যাংকের বিষয়ে।
ও তো এখনও বাড়ি ফেরেনি।আপনি বসুন এক্ষুণি এসে যাবে।
বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনি উনার কি হন?
আমি উনার স্ত্রী।
বলেন কি! আপনি ম্যাডাম!কিছু মনে করবেন না আমি তো ভেবেছিলাম আপনি স্যারের বড়ো মেয়ে। কি আশ্চর্য! আপনার দুইটা বড়ো বড়ো মেয়ে আছে বোঝাই যায় না।
সাদিকের কথায় মায়ের চেহারা পাল্টে গেল। সেই রাগী মুখ আর নেই, কেমন কোমল হয়ে গেল।
মা গদগদ কণ্ঠে বলল, কি যে বলেন! আমি তো অনেক মোটা।
কে বলেছে আপনি মোটা? আপনি একদম পারফেক্ট ম্যাডাম।
সাদিকের কথা শুনে আমার ভিষণ হাসি পেল।মুখ চেপে ধরে রাখলাম। হাসির দমকে গা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সাদিক সোফায় বসতে বসতে আদুরে গলায় বলল,চা খাব ম্যাডাম।
কি ম্যাডাম ম্যাডাম করছো? আন্টি বলো।
মা চা নাস্তা নিয়ে এসে, হেসে হেসে সাদিকের সাথে গল্প করছে। হাসি মুখে মাকে কি সুন্দর লাগছে! মার রাগের কারনে বাবা এবং আমরা কোনোদিন বাড়িতে বন্ধু বান্ধব আনতে পারি না।
আন্টি আপনি এত শান্ত, শিষ্ট, মায়ালু একদম আমার মায়ের মতো। আমার মায়ের সাথে আপনার অনেক মিল।
তাই নাকি? একদিন তোমার মাকে নিয়ে বেড়াতে আসো।
আন্টি আমার মা, বাবা কেউ বেঁচে নেই।
সাদিকের কথা শুনে মায়ের চোখ আদ্র হয়ে উঠল।
বাবা ব্যাংক থেকে চলে আসায়, মা সোফা থেকে উঠে পড়ে সাদিককে বলল,তুমি আবার এসো বাবা খুশি হবো।
এরপর থেকে সাদিক মাঝে মাঝে এসে মায়ের সাথে গল্প গুজব করে চলে যায়।আমার সাথে একদিনও দেখা হয়নি। আমি পর্দার আড়াল থেকে সব দেখি।
এক শুক্রবারে মা সাদিককে আমাদের সাথে দুপুরে খেতে বলল।ঐ দিন খাওয়ার টেবিলে সাদিকের সাথে মা আমার পরিচয় করিয়ে দিলো।খাওয়া শেষে আমরা সবাই রুমে চলে গেলাম। সাদিক আর মা ড্রইংরুমে গল্প করছে।
হঠাৎ সাদিক বলল,আন্টি আমি আপনাকে মা বলে ডাকতে চাই।
বেশ তো ডাকো, আমি অনেক খুশি হবো।
এভাবে না আন্টি, আপনার বড়ো মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আপনি যদি রাজি থাকেন আর স্যার ও আপনার মেয়ে যদি রাজি থাকে তাহলে আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই।
মা কর্কশ গলায় বলে উঠল,ওদের আবার কিসের মতামত? আমি যা বলব তাই হবে। হঠাৎ মা হুঁশে ফিরল, নরম গলায় বলল আচ্ছা ঠিক আছে আমি ওদের মতামত জেনে নেবো।তুমি কাল একবার এসো বাবা।
পরদিন সাদিক আসলে মা মিষ্টি করে বলল, আমরা তোমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি তবে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হবে। অন্য জায়গায় অবনীর বিয়ের কথা হচ্ছে তারা ফাইনাল করার আগেই বিয়েটা দিতে চাচ্ছি।
আন্টি বিয়ে করতে সমস্যা নেই কিন্তু আমি মেসে থাকি। নতুন বউ নিয়ে তো আর মেসে উঠতে পারবো না, আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ভাড়াও পাবো না। খুঁজতে সময় লাগবে।
না বাবা দেরি করা যাবে না, তুমি বিয়ে করে এখানেই থাকবে। তারপর বাসা ভাড়া পেলে চলে যেও।
খুব তাড়াতাড়ি ঘরোয়াভাবে সাদিকের সাথে আমার বিয়ে হলো।আমরা বাবার বাড়তে থাকি।
সকালে মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙতো কিন্তু এখন মা চিৎকার করতে পারে না। ঘরে জামাই আছে কি ভাববে! মিষ্টি করে আমাদের ডাকে।প্রতি রাতে বাবার সাথে চেচাঁমেচি না করলে মার ঘুম আসতো না এখন সেটাও বন্ধ। জামাই জানে মা শান্ত শিষ্ট মহিলা চেচাঁমেচি করলে কি মনে করবে!
শুক্রবারে সাদিক বাজার করে আনলো।বাবা বাজার করে আনলে, মা বাজার বের করেই বাবার সাথে ঝগড়া করবে মাছ পঁচা কেন? পাকা বেগুন কিনেছো কোন আক্কেলে। বুড়ো হয়ে গেল বাজার করা শিখল না।
সাদিকের কেনা বাজার মা চুপচাপ শান্ত ভাবে গুছিয়ে রাখছে। সাদিক শুঁটকি মাছ এনেছে। মার ভয়ে এবাড়িতে কোনদিনও শুঁটকি মাছ আসেনি। অথচ এখন মা শুটকি মাছ দেখেও টু শব্দটি করলো না। হয়ত মনে করেছে, আহারে মা মরা ছেলেটার শুঁটকি খেতে ইচ্ছা করছে। মা হাসিমুখে শুঁটকি রান্না করছে। আমাদের বাড়ি এখন শান্ত, হাসি আনন্দে ভরপুর।
দুই মাস বাবার বাড়িতে থাকার পর সাদিক নতুন বাসা ভাড়া করেছে।আগামীকাল আমরা চলে যাবো।
রাতে সাদিককে বললাম, তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো। তুমি, আমার মাকে একদম আমরা যেমন মা চাইতাম ঠিক তেমন মা বানিয়ে দিয়েছো।
সাদিক হাসতে হাসতে বলল,ধন্যবাদ আব্বাকে দাও।আমি তো শুধু অভিনয় করেছি। সমস্ত পরিকল্পনা, কাহিনী, সংলাপ সব আব্বার।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমার সরল সোজা, বোকা বাবার মাথায় এত বুদ্ধি! কোন ঝগড়া ঝাটি ,চিৎকার ,চেচাঁমেচি, কিচ্ছু না বুদ্ধি দিয়ে আমার আর সাদিকের বিয়েটা দিয়ে দিলো সেই সাথে আমার রাগী মাকেও শান্ত শিষ্ট মা করে দিলো!
লেখাঃ ইসরাত জাহান নিতা