একটি মেয়ের গল্প
একবার একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে এক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু সেটা আমার বা তার কারো জন্যই সুখপ্রদ ছিলোনা। কেন ছিলো না সেই গল্পই আজ বলবো।স্বামী, সন্তানদের নিয়ে আমি আমার শ্বশুর বাড়ির একজন নিকটাত্মীয়ের গায়ে হলুদের দিন তাদের বাসায় উপস্থিত হই।সেখানে নিকটাত্মীয়ের কাছের, দূরের অনেক স্বজনরা ছিলেন যাদের মধ্যে একটি মেয়ে এবং তার মা ছিলেন।মেয়েটির নাম আঁখি। পড়ে সবেমাত্র ক্লাস নাইনে। তবে এরইমধ্যে ছলাকলায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। পোশাকেও যথেষ্ট স্মার্ট।
পরিচয়ের কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম সে আমার স্বামী আর বাচ্চাদের সাথে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছে। আঁখি কিন্তু যথেষ্ট মোটা ছিলো। পিঠ খোলা ব্লাউজ আর লাল পার,হলুদ শাড়ি পেট বের করে পরার কারণে ওকে মোহনীয় লাগার বদলে কেমন যেন হাস্যকর লাগছিলো! কিন্তু বেচারি সেটা বুঝতে পারলে তো? যাইহোক, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই যখন যার যার রুমে ফিরে যাচ্ছি তখন হঠাৎ আঁখি এসে আমার স্বামীকে বললো, " ভাইয়া, আপনার সাথে তো আমার ছবি তোলা হয় নি, আসেন না আমরা একটা ছবি তুলি? " আমার স্বামী প্রবর ভেবেছেন ওনার সন্তানদের বায়না পূরণের মতো এটাও একটা ছেলেমানুষী বায়না! তাই তিনি ঘুরে ওর সঙ্গে ছবি তুলতে চলে গেলেন।
আমার খুব বিরক্ত লাগছিলো। আমার মাওই সম্পর্কীয় একজন পেছন থেকে সবটা দেখছিলেন। তিনি বিরক্তি মাখা সুরে বললেন, " কি জামানা আইলো, বেডার বেডি রে পাশে থুইয়া বেডারে লইয়া গেছে ছবি তুলতে, ছবি তুলবি বেডি রে সাথে নিয়া তুল; বেডার লগে এতো ঢলাঢলি কিয়ের? যত্তসব নষ্টামি! " আমি ভদ্রতা করে মুচকি হেসে রুমে চলে গেলাম। যে পরিবারের বিয়ে ছিল তাদের আত্মীয় বেশি হওয়ায় স্থান সংকুলান হচ্ছিল না দেখে আমরা ড্রয়িংরুমের খাটে ঘুমাই যেখানে আরও দুজন নিচে ফ্লোরিং করেন। ক্লান্ত ছিলাম বলে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো ভোরবেলা ফিসফিস কথার আওয়াজে। আস্তে করে চোখ মেলে দেখলাম সেই মেয়ে আমার বরের মশারির পাশে বসে মোবাইল চার্জ করতে দিয়ে বরের নাম্বার চাইছে। বর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছেন ওর মোবাইল আছে কি না। আঁখি বড় গলার কামিজ পরে ইচ্ছে করে আমার বরের পাশে নিচু হয়ে বসেছিল, আমার বোকা বর কিন্তু সোজা হয়ে শুয়ে থেকে কথা বলছিলেন তাই আঁখির মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হচ্ছিল না কিন্তু আমার মেজাজ প্রচন্ড বিগড়ে গেল।
আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম আর মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলে চোর বিড়াল যেমন দিশাহারা হয়ে ছুটে পালায় তেমনি ঐ মেয়েটা ছুটে চলে গেল। সেদিন বিয়ে ছিল বলে মেজাজটা ঠিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু আঁখির জন্যে সেটা হওয়ার জো নেই। যে কয়েকবার সে আমার সামনে পড়েছে, আমাকে ডাকছে আন্টি বলে আর আমার বরকে ডাকছে ভাইয়া! ততক্ষণে আমার বড় ছেলে আমার বিরক্তির কারণ কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। সে বাবার সাথে বিয়েবাড়ির মেহমানদের আপ্যায়ন করছিল। একবার ছুটে এসে বলে গেল, " মা, আমি আর বাবা যেখানে যাচ্ছি, ঐ আন্টিও আমাদের সাথে আসছে। বাবা ওদের খেয়ে নিতে বলেছিল কিন্তু আন্টি বলেছে বাবার সাথে খাবে। " আমি কোন কথা না বলে বসে আছি। আমি সম্পর্কে বউয়ের চাচি হই। গ্রামের বাচ্চা মেয়ে সকাল থেকে কেঁদে অস্থির হয়ে আছে। ওকে ফেলে রেখে উঠতেও মায়া হচ্ছে। কিছু সময় পর আমার বর এলেন খাওয়ার জন্য ডাকতে। বউকে ওর মা খাইয়ে দেবেন। খেতে বসে দেখি, আঁখি আর তার মা ও এক টেবিলে। আমার ছোট মেয়েকে সে খাওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছে। তিন বছরের মেয়ে আমি ছাড়া কারো হাতে খায় না।
সেটা বলার পর মেয়ে রেহাই পেয়ে ছুটে চলে এলো আমার কাছে। খেতে বসে আঁখির মা খাবার বাদ দিয়ে মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। "আমার মেয়ে বাচ্চাদের সাথে খুব সহজেই খাতির করতে পারে। আমার মেয়ের বয়স কিন্তু একদম অল্প, তবু খুব সুন্দর সাজতে পারে। " সকাল থেকে মেজাজ সপ্তমে চড়ে ছিল, " আমার মেয়ে, আমার মেয়ে " শুনতে শুনতে সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। ফস করে বলে ফেললাম, " জি আন্টি, আঁখির বয়সটা সত্যি অনেক কম। তাইতো এটাও জানে না যে, ভাইয়ের বউ আন্টি হয় না, ভাবি হয়। দেখুন না, কাল থেকে আমার বরকে ডাকছে ভাইয়া আর আমাকে আন্টি। " টেবিলে আমাদের অন্য আত্মীয় যারা বসেছিলেন সবাই মুখ টিপে হাসছেন। মা, মেয়ে দুজনেই লজ্জিত। বর কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করছেন। এরপর সবাই চুপচাপ খাবার শেষ করে উঠে পড়লাম।
বউকে বিদায় দিয়ে সেদিন সন্ধ্যায়ই আমরা আমাদের শশুর বাড়ি চলে যাই। তবে তার আগ পর্যন্ত আঁখিকে আর আমাদের আশেপাশে দেখতে পাই নি। আমি পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম, ও যা করেছিল সেটাতে ওর মায়ের ইন্ধন ছিল। ওর উঠতি বয়সে ভালো, খারাপ বিচারের বোধ তখনো গড়ে ওঠে নি। ওর জন্য আমার খারাপ লেগেছে এটা ভেবে যে, শুধুমাত্র লোভ, লালসার বশবর্তী হয়ে ওর নিজের মা ওকে যে শিক্ষা দিচ্ছেন সেটা ওর ভবিষ্যৎটাকে নষ্ট করে দেবে। আমার বরের টাকা দেখে বিবাহিত, সন্তানের বাবা হওয়া সত্ত্বেও তিনি মেয়েকে ওর পেছনে লেলিয়ে দিয়ে যে নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সেটা ভাবতে এখনো আমার খুব অবাক লাগে!
লেখাঃ ফারজানা অনন্যা।