রিয়্যাক্টর কিং
আমার যেদিন বিয়ে হলো সেদিন রাতেই আমার একমাত্র শালা আমার থেকে আমার ফেসবুক আইডি চেয়ে নিয়েছে। আর বলেছিলো যে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও নাকি পাঠিয়েছে। যেন অ্যাক্সেপ্ট করে নেই।
কিন্তু এই ক'দিন বিয়ের ঝামেলা এবং ব্যস্ততায় ওর রিকুয়েস্ট দেখা তো দূর,আমি আমার সোনার আইডিটাতেই ঢুকতে পারিনি। আজ সকালে চাপমুক্ত হয়ে ভাবলাম একবার ফেসবুকে যাই।
ফেসবুক খোলার পর দেখলাম অনেক পাবলিক বিয়ের কথা জানতে পেরে আইডিতে অভিনন্দন দিয়ে ভড়িয়ে ফেলেছে। লাস্ট পোষ্ট যে আমার কোথায় তলিয়ে গেছে খুঁজে পাওয়াই যেন মুশকিল।
যাহোক, আমি রিকুয়েস্ট চেক করতে গিয়েই দেখলাম অদভুত রকম নামের একটা আইডি দিয়ে রিকুয়েস্ট এসেছে। অ্যাকসেপ্ট না করে আগে প্রোফাইল চেক করতে ঢুকলাম।
আইডির নাম "রিয়্যাক্টর কিং"। ছবিতে আমার শালা শিহাবের একটা ছবি। যাক, বুঝলাম তবে এই রিয়্যাক্টর তবে আমারই শালা।
যাইহোক, আসলে নামটা বলা যতটা সহজ উচ্চারণ করা তার চেয়েও কঠিন। কেননা নামটা আসলে বাংলায় দেয়া নেই।
স্টাইলিশ ও উদ্ভট রকমের এক ফন্টে লিখা আছে। মুহূর্তের জন্য হলেও ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ এর উপর ভিষণ রাগ হলো আমার। আমি আমার নাম বাদে অন্য কোনো নামে ফেক আইডিই খুলতে পারিনা, আর এদিকে রিয়্যাক্টর কিং নামে আইডি খুলতে দেয় কীভাবে? তাও এই ২১ সালে?
সাঁতার কেটে কেটে, উফস সরি! স্ক্রোল করে করে নিচে নামছিলাম আর তার পোস্টগুলি দেখছিলাম।
বাহ,এ তো শালা আসলেই রিয়্যাক্টর। যেরকম পোষ্ট করেছে তার পোষ্ট সেরকমভাবেই হিট খেয়েছে। তার পোষ্টগুলো কেমন ছিল নিচে তার দুটো নমুনা দেয়া হলো:
"ফ্রেন্ডস আজ আমার বোনের বিয়ে। তবে ছেলেটা আমার একদমই পছন্দ হয়নি। কি করতে পারি?" পাশে সেন্টি ইমোজি।
হোয়াট! বড়সড় একটা চমক খেলাম দেখে; এই পোষ্ট যে আমাকে নিয়েই লিখেছে তা আমি কালি কলমে টের পেয়েছি। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই পোষ্টের রিয়্যাক্ট। ভাই একটাও লাইক নেই,একটাও লাভ,ওয়াও,কেয়ার,হাহা নেই। একঢালা সব স্যাড রিয়্যাক্ট। কীভাবে সম্ভব! কেউ আবার দেখলাম কমেন্টে সমবেদনা জানাচ্ছে আবার কেউ কতপ্রকার সাজেশনও দিচ্ছে।
নিজের গালে আলতো করে একটা থাপ্পড় মেরে বললাম, 'বাহ শালা বাহ! বহুত চালু তুমি।"
নিচে নামলাম, আর একটা পোষ্ট চোখে বাধল আমার। "ঝামেলামুক্ত একটা প্রেম করার জন্য মেয়েদের অনেক বড় কপাল লাগে, সেই কপাল তাদের নেই বলেই আমি আজও সিঙ্গেল।"
মানে? কি এসব? এসব পোষ্ট দেখে মাথা ঘুরাচ্ছে আমার। সিরাতকে ডেকে বললাম,"তোমার ভাই ফেসবুকে এসব কী করে? কাম কাজ নাই নাকি ওর?
সিরাত কোমরে শাড়ি গুঁজে বলল,"কেন কী করে ও? ও তো খুব ভালো ছেলে।"
"তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এসব রিয়্যাক্টর ফিয়্যাক্টর কী?"
ও ফোনের স্ক্রিনটা দেখে মাথা তুলে আমাকে বুঝিয়ে বলল,
"ওহহ রে, আরে এ তো একটা ট্রেন্ড। ওটাই ফলো করতেছে, আর কি। এসবও আবার তোমার উল্টাপাল্টা মনে হয়?"
"হায়রে ট্রেন্ড রে..." কপাল চাপড়ালাম আমি।
"যাকগে, এখন সব বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।" সিরাত বলল।
"কেন কোথায় যাবো?"
"আরে আজ তো বাবার বাসায় যেতে হবে। মনে নেই? জলদি রেডি হও। আমিও রেডি হচ্ছি এখুনি।"
দুদিন হলো বিয়ে হয়েছে তাতেই এত বাপের বাড়ি বাপের বাড়ি করলে হবে? এটাই তো বাপের বাড়ি। শশুর শাশুড়ি তো বাবা মায়ের মতোই। তাই নয় কি? তারপরও, নতুন বউ তো, এসব মেনে নিতেই হবে। নইলে আবার ভাত দিবেনা। মোবাইলটা রেখে রেডি হতে চলে গেলাম।
ঘণ্টাখানেক হয়েছে শশুড়বাড়ি এসেছি। মেয়ে-জামাইকে পেয়ে বাড়ি যেন নতুন রূপে জেগে উঠেছে। এরইমধ্যে শাশুড়ি আম্মা হরেক রকম খাবার দাবার খাওয়ালো। বিয়ে করে খুব বেশি লাভ-লস থাকুক বা না থাকুক। একটা লাভ কিন্তু আছেই, সেটা হলো শশুড়বাড়ির মজাদার খাওয়া। উফফ।
দুপুরের খাওয়া শেষে দাত গুঁতোচ্ছিলাম এমনসময় মনে হলো শালাবাবুর কথা। সিরাতের দ্বারা ওকে ডেকে পাঠালাম। অল্প সময়ের মধ্যেই ও আমার সামনে আসলো।
বয়স ১৮ কি ১৯ হবে। আমার কাছে আসতেই বললাম,"কি ব্যাপার রিয়েক্টর শালা? কি খবর তোমার?"
ও বলল,"এই তো ভাই ভালো। আপনার?"
"ওই মিয়াঁ , ভাই কে? আমি তোমার দুলাভাই হইনা? দুলাভাই বলবা। আজীবন ভাই ডাক শুনছি, বিয়ের পর তো অন্তত দুলাভাই ডাক ডিজার্ভ করি তাইনা?"
"জি, দুলাভাই।"
"তা দিনকাল কেমন চলছে আজকাল?"
"ভালো দুলাভাই। আপনার কেমন চলে?"
"আগের থেকে ভালোই চলছে। আর ভালো না চললেও সমস্যা নেই, কারণ তোমার... না... না কিছুনা। তারপর বলো।"
"দুলাভাই আপনি বসেন, আমার ওই একটু বাইরে যাইতে হবে বন্ধুদের সাথে। যদি পারমিশন দিতেন।"
"আরে বোকা ছেলে, পারমিশনের কী আছে? যাও,পরে কথা বলবনে তাহলে।"
বুঝলাম না কিছু, যেতে বলার পরও কিং যাচ্ছেনা। কি যেন ইশারা করছে সে। মুখে কিছু বলছেও না। চেয়েই আছে শুধু।
ভণিতা করে আমি বললাম,"কি কিছু বলবা ?"
ও বলল,"বন্ধুদের র্টিট দিতে হবে তো দুলাভাই। এজন্যে..." আমতাআমতা করতে লাগলো সে এবারে।
"ওহ বুঝেছি,আগে বলবা তো, এই নাও ৫০০ টাকা রাখো।" মানিব্যাগ থেকে বের করে দিলাম।
"না লাগবেনা দুলাভাই রাখেন। আমার র্টিট আজ দিবনা।"
"আরে বোকা ছেলে নাও। লজ্জা করতে হবেনা। আমি তো তো তোমার হাজার হলেও একটা দুলাভাই। রাখো তো।"
"না না দুলাভাই। আমি যাই। লাগবেনা। আপনি দিতে চাইলেন এতেই আমি হ্যাপি।" এই বলেই দৌড়ে চলে গেল শিহাব। ও চলে যেতেই টাকা আবার পকেট পুড়ে নিলাম।
যাক, টাকাটা বেঁচে গেল। আসলেই ছেলেটা ভালো। সিরাত ঠিকই বলেছিল, আমিই ভুল ভেবেছিলাম।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঝড়ের মতো ঘরে আসলো সিরাত। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ও বলল,"একটাই শালা তোমার,আর ওকে মাত্র ৫০০ টাকা দিতে চাও তুমি? এত কঞ্জুস কেন তুমি হা?"
আমি অবাক স্বরে বললাম,"তো কত দিতাম?"
"তোমার দিতে হবেনা। মানিব্যাগটা দাও,আমিই দিচ্ছি।" বলেই আমার কাছ থেকে মানিব্যাগ নিয়ে ১০০০ টাকার দুইটা কচকচে নোট বের করে নিলো ও। এরপর আমার দিকে মানিব্যাগ ছুড়ে বলল,"একটু কিপটামি কমাও বুঝছো। আপনজনদের সাথে কিপটামো করতে নেই।"
এ বলেই সিরাত চলে গেল।
ছেলেটা নাকি ভালো? এ তো কঠিন বেয়াদব। আমার দুই হাজার টাকা মেরে দিলো। মনটাই ভেঙ্গে গেল আমার।
ভাঙাচোরা মনে মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢুকলাম। দুই ঘণ্টা আগে শিহাব পোষ্ট করেছে,"আম্মুর কাছে ঝাঁটার বাড়ি খাওয়াটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার। যখন আগে খেতাম খুব ব্যথা পেতাম। কিন্তু এখন মাঝেমাঝে খেলে ভালো লাগে। কারণ এগুলো তো বাবা মায়ের দেয়া ভালোবাসা।"
বাহ,এই পোষ্টেও কেয়ার রিয়্যাক্টের বণ্যা। ট্রেন্ডের চক্করে বেচারা যেন আবার পাগল হয়ে না যায়। খোদা তুমি রক্ষা করো আমার এই দস্যু শালাকে।
বিকেলের পর সন্ধ্যা হবার আগে আমি আর সিরাত বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ফেরার আগে শিহাবকে কোথাও দেখলাম না। ছেলেটাকে শেষবারের মতো না দেখে ভালোই হলো। যেন মরণ বাঁচা বেঁচেছি। নইলে এখনো দুই হাজার টাকা মেরে দিত।
বাসায় আসতে আসতে রাত হয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। অতপর বালিশে মাথা পেতে দিয়ে মোবাইলের নেট অন করলাম। সাথেসাথেই নোটিফিকেশন আসলো,"ReAcToR KiNg Update her Status"
আমি ক্লিক করতেই পোষ্টের ভেতরে নিয়ে এলো। একটা ছবি আপলোড করেছে শিহাব। যেখানে কচকচে দুইটা হাজার টাকার নোট। আর ক্যাপশনে লিখা,"বোকাসোকা দুলাভাই আজ বাসায় এসে আমার সামনে খুব ভাব নিচ্ছিলো। সুযোগ বুঝে কৌশলে আমি তার দুই হাজার টাকা মেরে দিলাম।
ভালো করেছি না ফ্রেন্ডস?"
ওরে বাটপাড় রে, এ কোন ঘরে বিয়ে করলাম আল্লাহ? এ কোন শালা দিলা আমায়?
সিরাত আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। আফসোসের স্বরে বলল,"শেষবারের মতো ভাইটাকে দেখতে পারলাম না। খারাপ লাগছে গো।"
"আলহামদুলিল্লাহ। ভালো হয়েছে দেখতে পাওনি। যদি দেখতে তাহলে নির্ঘাত আমার আরো দু'হাজার টাকা মারা যেত। অপমানের কথা আর নাই বললাম।"
"কিসের অপমান?"
আমি সিরাতকে দেখলাম ওর ভাই যে এক ঘণ্টা আগে আমায় ট্যাগ করে করা এমন পোষ্ট করেছে। বরাবরের মতো পোষ্টে হাহা রিয়্যাক্টের ভরপুর। সিরাত এ দেখে মিটি হাসলো। বলল,"আররে, আমার ভাই তো সেলিব্রেটি হয়ে গেলো।"
আমি ওর দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না। ভাই-বোন দুটোই পাগল হয়েছে। সবই টেন্ডের চক্করে।
লেখা - রাফিক রহমান