হ্যাপি কাপল
ইদের দিন সকালে ঘুম ভেঙেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল রোমেলের। আট মাসের সিয়াম ঘুম ভেঙে উঠে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে।
রোমেল আধো ঘুম আধো জাগরণে হাতড়ে হাতড়ে ছেলের গায়ে হাত চাপড়ে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে গলা চড়িয়ে নীরাকে ডাকল। “নীরা! নীরা!”
নীরা রান্নাঘর থেকেই গলা উঁচু করে বলল, “পায়েস পুড়ে যাবে আমার, দাঁড়াও!”
পায়েস? ওহ! রোমেলের মনে পড়ল আজ তো ইদের দিন। উঠে বসে সিয়ামকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, “ইদ মোবারক আব্বু!”
সিয়ামকে কোলে নিতেই বিটকেল গন্ধ পেল সে। ব্যাটা বড় কাজ সেরেছে। এইজন্যই হৈচৈ করছে।
ডায়াপার না বদলানো পর্যন্ত হাউকাউ করতেই থাকবে। রোমেল বাধ্য হয়ে মাথার পাশের সাইড টেবিল থেকে ডায়াপার আর ওয়েট টিস্যু নিয়ে ডায়াপার বদলাতে লেগে গেল সে।
সিয়াম মনে হয় বুঝতে পেরেছে তার ডায়াপার বদলানো হচ্ছে। সে কান্নাকাটি থামিয়ে পিট পিট করে রোমেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রোমেল হাসিমুখে বলল, “ইদ মোবারক ব্যাটা!”
নীরা ঘেমে নেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। রান্নাঘরে ঢুকলেই তার গরমে অস্থির লাগে। রোমেল বলল, “নাও তোমার ছেলে সামলাও, আমি গোসল করে নামাজে যাই!”
হাত বাড়িয়ে ছেলেকে কোলে নিল নীরা। রোমেল গোসলে ঢুকতেই নীরার শাশুড়ি এসে বললেন, “বাবুকে দাও, তুমি সেমাইটা চট করে করে ফেল। নাহয় দেরি হয়ে যাবে, নামাজ পড়ে এসে খাবে তো সবাই।“
নীরা হাঁফসানো গলায় বলল, “দাঁড়ান মা, পাঁচটা মিনিট এসিতে বসে যাই, চুলার গরমে ঘেমে গেছি একেবারে!”
“তোমরাও সব ননীর পুতুল একেবারে! কই আমরা তো দু দুটো লাকড়ির চুলায় রান্না করেছি আমাদের তো এত এসিতে বসা লাগেনি!”
নীরা কোনো কথা না বলে বাবুকে শাশুড়ির কাছে ধরিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেল। চটপটি আর পায়েস নেমে গেছে, লাচ্ছাও ভেজানো হয়ে গেছে, এখন শুধু শুকনো সেমাইটা বাকি।
নীরার শাশুড়ি পিছু পিছু এসে বললেন, “বাবু কাঁদছে কেন?”
নীরা নিরুত্তাপ গলায় বলল, “খিদে লেগেছে বোধ হয়।“
শাশুড়ি বিরক্ত গলায় বললেন, “নাও খাওয়াও তাহলে, সেমাই আমিই দেখছি! বাবু ঘুম থেকে ওঠার আগে রান্নাটা শেষ করে রাখলেই তো আর ঝামেলা হত না!”
নীরা কিছু বলল না। সিয়ামের সেরেল্যাক বানিয়ে সিয়ামকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকে গেল। রুমে একটা খাঁচায় রাখা টিয়া আছে। সেটা দেখিয়ে সিয়ামকে খাওয়ানো সহজ।
রোমেল গোসল শেষ করে ওদের দেখে বলল, “বাচ্চা নিয়ে বসে পড়লে তো? আজকের দিনটা একটু সাপোর্ট দিলে পারতে! রান্নাঘরের গরমে আম্মুর কষ্ট হয়!”
নীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। আগে বলত। এখন আর ইচ্ছে করে না। কারো কাছে নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই। যার বোঝার সে এমনিতেই বুঝবে। যে বোঝে না সে হাজার বললেও বুঝবে না।
রোমেল বেরিয়ে গেল। খাওয়ানোর মাঝামাঝি রুমের দরজা সন্তর্পণে খুলে ঘরে ঢুকল রুমু।
“ভাবী!”
“এসো আপু!”
“একটু সাজিয়ে দাও তো, বের হব এখন!”
“এখুনি দিচ্ছি! বসো একটু, খাওয়ানোটা শেষ করে নিই!”
“দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!”
“এই তো আর পাঁচ মিনিট!”
পাঁচ নয় দশ নয়, পাক্কা কুড়ি মিনিট লাগল খাওয়ানো শেষ করতে। বাবু মাঝে মাঝে খাওয়া নিয়ে এমন বায়নাক্কা করে! খাওয়া মুখে নিয়ে বসে থাকে। গেলেও না, হাঁ করে না।
খাওয়ানো শেষ করে বাবুর মুখ ধুইয়ে ফিডিং চেয়ারে বসিয়ে রেখেই রুমুকে সাজিয়ে দিতে থাকে নীরা। রুমু ওর একমাত্র ননদ, আজকে বয়ফ্রেণ্ডের সাথে দেখা করতে যাবে, তাই সাজটা হতে হবে স্পেশাল। নেচারাল স্নিগ্ধ কিন্তু নজরকাড়া। এ বিষয়ে ননদ ভাবীর আগেই গোপন বোঝাপড়া হয়ে আছে গতকাল।
সাজানো শেষ করতে করতেই বাইরের দরজায় কলিং বেলের শব্দ বেজে ওঠে। নীরা চমকে উঠল। ওরা কি নামাজ শেষ করে এসে গেছে?
রুমু চট করে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। বাবু ফিডিং চেয়ারে বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে তারস্বরে চিৎকার শুরু করেছে। বাবুকে ফিডিং চেয়ার থেকে খুলে ঘরের বাইরে বের হলো নীরা।
রোমেল থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্ত গলায় বলল, “আজকের দিনেও বাবুকে নিয়ে ঘরে বসে আছ, আম্মুকে দিয়ে কাজ করাচ্ছ তাই তো?”
নীরার শাশুড়ি ঘাম মুছতে মুছতে সেমাইয়ের বাটি এনে টেবিলে রাখছেন। নীরার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, “বাবুকে খাওয়ানোর কাজটা কে করত তাহলে? তুমি?”
রোমেল আর তার বাবা খেতে বসেছেন, শাশুড়িও চেয়ার টেনে বসতে বসতে গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “রুমু! এই রুমু!”
রুমু তার ঘর থেকেই উত্তর দিল, “আসছি!”
ভেতরে নীরার ফোন বেজে উঠল। নীরা ভেতরে গিয়ে ফোন ধরল। আম্মু ফোন করেছে।
“হ্যালো আম্মু, ইদ মোবারক!”
“ইদ মোবারক! কখন আসবি?”
“এই তো, মাংস গুছিয়েই চলে আসব!”
“নে, আব্বু কথা বলবে তোর সাথে!”
বাসার সবার সাথে কথা বলা শেষ করে নীরা এসে দেখল সবার খাওয়া শেষ। তাকে কেউ খেতে বলল না। হঠাত করেই অজানা অভিমানে ছেয়ে গেল বুকটা। আর কেউ না বলুক, অন্তত রোমেল তো বলতে পারত?
ঠিক আছে না বলুক। নীরাও খাবে না।
রোমেলের ফোন বেজে উঠেছে। কসাই চলে এসেছে। রোমেল উঠে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। খুব ডিমাণ্ডের কসাই, অনেক জায়গায় তার এপয়েন্টমেন্ট।
বাবুকে শাশুড়ির কাছে দিয়ে নীরা পোলাও, মুরগির রোস্ট করতে লেগে গেল। একটু পরেই তো কোরবানির মাংস চলে আসবে।
রুমু এর মধ্যেই “আম্মু আসছি” বলে টুক করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় নীরার সাথে চোখাচোখি হল। নীরা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচু করে ইশারায় বোঝাল, সুন্দর লাগছে।
পোলাও মুরগির রোস্ট করতে করতেই কোরবানির মাংস আসা শুরু হয়ে গেল। মাংস নিয়ে বসে কখন যে বেলা গড়িয়ে গেল টেরও পেল না নীরা। ভাগ্যিস সাহায্যকারী মেয়েটা চলে এসেছে ততক্ষণে।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ কাজ শেষ করে নীরা যখন রান্নাঘর থেকে বের হল তখন তার মাথা ঘুরছে। ঘরে বাবুর কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নীরা কী মনে করে দৌড় দিতে গেল।
কিছুক্ষণ আগেই এদিক দিয়ে মাংসের বালতি নিয়ে এসেছে। এক ফোঁটা রক্ত মেঝেতে পড়েছিল বুঝি। সাহায্যকারী আকলিমা কেবলই ঘর মুছে দিয়ে গেছে। সেই মুছে যাওয়া পিছল মেঝেতে পিছলে পড়ে গেল নীরা। আকলিমা ছুটে এসে তাকে ধরে তুলল। নীরার চোখ ফেটে জল চলে এসেছে।
বাবুর জন্মের পর থেকেই কোমরে মাঝে মাঝে খুব ব্যথা হয়, আবার সেই কোমরেই লেগেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরে আসতেই শাশুড়ি রাগে ফেটে পড়লেন, “কি বাচ্চা বানিয়েছ রে বাবা! কিছুতে পারলাম না খাওয়াতে!”
নীরা মৃদু স্বরে বলল, “আমাকে দিন মা, আমি খাওয়াই!”
বাবু এবং বাবুর খিচুড়ির বাটি নিয়ে খাওয়াতে বসার কিছুক্ষণ পর রোমেল এসে খাওয়া দাওয়া করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “রেডি হও, তোমাদের বাসায় যেতে হবে না? মা ফোন করেছিলেন।“
“যাচ্ছি, বাবুকে খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছি।“
“সে তো এক ঘন্টার মামলা। আমার আবার একটা প্রোগ্রাম আছে…”
রোমেলের প্রোগ্রাম কী, সেটা নীরা জানে। ইদের দিন সন্ধ্যায় ওরা বন্ধুবান্ধব একসাথে হয়। প্রাণ খুলে আড্ডাবাজি করে।
নীরা কিছু বলল না। কোমরে লেগেছে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ব্যথা সামাল দিল। সারাদিন খায়নি সে। খিদে মরে গেছে। ভেবেছিল রোমেল আসলে হয়ত ডাকবে। ভুলে গেছে হয়ত। কিংবা বাবুকে খাওয়াতে দেখে আর তার জন্য অপেক্ষা করেনি।
সন্ধ্যা ছয়টায় গোসল করে সেজেগুজে রেডি হলো নীরা। বের হওয়ার আগে আগে চট করে কয়েকটা সেলফি তুলে নিল। কিছু বাচ্চাসহ ফ্যামিলি ফটো, কিছু রোমান্টিক কাপল ছবি।
বিকেলে মনে হয় সবাই বের হয়েছে, পাক্কা চল্লিশ মিনিট লাগল মায়ের বাসায় পৌঁছাতে।
দরজা খুলেই উচ্ছ্বসিত হয়ে নীরাকে জড়িয়ে ধরলেন আম্মু। সিয়াম দুপুরে ঘুমায়নি, গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে বহু যত্ন করে খুব সাবধানে ভেতরের ঘরে শোয়ানো হলো। অবেলার কাঁচা ঘুম, ভেঙে গেলে হৈচৈ কান্নাকাটি জুড়ে দেবে।
সেমাই পায়েস চটপটির আপ্যায়ন শেষ করে নীরার আম্মু ভেতরে যেতেই ড্রয়িং রুমে বসে রোমেলের উসখুস শুরু হলো।
“ইয়ে…মানে…নীরা…তুমি থাকো…আমি একটু প্রোগ্রামটা সেরে আসি? এই বেশিক্ষণ লাগবে না, ঘন্টা দুই? বোঝোই তো, ইদের একটা দিন…”
নীরা তাকিয়ে রইল পলকহীন চোখে। রোমেল বলল, “কিছু বলবে?”
নীরা ফিসফিস করে বলল, “ইদের একটা দিন…চলো না শুধু আমরা দুজন মিলে কোথাও যাই? একটাই তো দিন?”
“কী বললে, আরও জোরে বল, শুনতে পাইনি।“
“নাহ, কিছু বলিনি। তুমি যাও, ঘুরে এসো। নয়টার ভেতর চলে এসো, নাহয় বাসায় ফিরতে দেরি হলে মা রাগ করবেন।“
রোমেল বেরিয়ে গেল। নীরা গলা উঁচু করে বলল, “আম্মু, আমি বাবুর পাশে শুয়ে দুই ঘন্টা ঘুমাই, খুব টায়ার্ড লাগছে!”
আম্মু বললেন, “হ্যাঁ, যা না! জামাই কোথায় গেল?”
“গেল একটা কাজে, দুই ঘন্টা পর এসে আমাকে নিয়ে যাবে।“
বাবুকে ভেতরের ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাতি নেভানো। নীরা এসে শুয়ে পড়ল। সারাদিনে ফেসবুকে ঢোকা হয়নি। এখন ঢুকে “ইদ মোবারক” ক্যাপশন দিয়ে বিকেলে তোলা সেলফিগুলো আপলোড করে দিল সে।
কিছুক্ষণ পরেই কমেন্ট পড়ল, “ওয়াও, হ্যাপি কাপল!”
সেই কমেন্ট দেখে অন্ধকার ঘরে বাবুর পাশে শুয়ে শুয়ে নীরার দুই চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল অবিরল ধারায়।
কেন, কে জানে!
লিখা: Moulee Akhund