তারা কে ছিল??
- মামা আমি আর যামু না, আপনেরে এহেনেই নামা লাগবো।
নিলয় মানিব্যাগ থেকে দশটাকা বের করে বললঃ আরে মামা চলো আরও দশটাকা বেশি দিচ্ছি। এই আর দুইটা গলিই তো বাকি।
রিকশাওয়ালা মাথা দু দিকে হেলিয়ে বললঃ না মামা। আমি যামু না। ম্যালা রাইত হইয়া গেসে, আমি এখন বাড়ি যামু।
নিলয় রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলো। শুক্লপক্ষ চলছে। আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চাঁদমামা। চাঁদের আলোয় চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নিলয়ের হাঁটার শব্দ ছাড়া চারপাশে আর কোনো শব্দ নেই। নিলয় ছাব্বিশ বছরের যুবক। রিকশাওয়ালার সাথে এই ঝামেলা নিলয়ের নতুন নয়। সপ্তাহে তিনদিন নিলয়কে এই ঝামেলা পোহাতে হয়। নাইট ডিউটি থাকায় সপ্তাহে তিনদিন নিলয়কে রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। চৌরাস্তা পর্যন্ত আসার পর আর কোনো রিকশাওয়ালা যেতে চাই না। বাকি দুটো গলি নিলয়কে হেঁটেই যেতে হয়। আজও যেতে হবে। এখন রাত প্রায় পৌনে দুটো। নিলয় অলসভাবে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। এমন সময় নিলয় দেখলো গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে কে যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিলয় কিছুটা চমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অবয়বটি কিছুটা এগিয়ে আসতেই নিলয় বুঝলো ওটা একটা নারীমূর্তি। আরও কিছুটা এগিয়ে আসতেই নিলয় মুচকি হাসল তারপর তৎক্ষনাৎ গম্ভীর হয়ে বললঃ তুমি এতো রাতে এখানে কি করছো তন্নি??
- তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছি। তুমি তো ভুলেই গেছো আজ কি?
- আরে না না। ভুলবো কেন আমার দিব্যি মনে আছে। আজ আমাদের থার্ড এ্যানিভার্সারি। আমি ১২টার সময়ই উইশ করতাম কিন্তু আজকে খুব কাজের চাপ ছিল তাই করতে পারিনি। এখন অবশ্য তোমার সাথে দেখা করেই বাড়ি যেতাম। তবে তোমার এতো রাতে এখানে আসা ঠিক হয়নি।
- এখানেই তো বাড়ি। এলে কি বা হবে? ওসব বাদ দাও। আমাকে কেমন লাগছে বলো? তোমার দেওয়া গেরুয়া রঙের শাড়িটা পড়েছি। কেমন দেখাচ্ছে?
নিলয় এতোক্ষণে তন্নিকে ভালোভাবে দেখলো। হ্যাঁ নিলয়ের দেওয়া গেরুয়া রঙের শাড়িটাই পড়েছে তন্নি। চাঁদের আলোয় তন্নিকে মায়াবী রহস্যময়ী নারী মনে হচ্ছে। নিলয় তন্নির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললঃ অপূর্ব লাগছে। একদম উপন্যাসের নায়িকাদের মতো রহস্যময়ী লাগছে।
তন্নি শুধু মুচকি হেসে বললঃ চলো এগোয়।
নিলয় আর তন্নি বাড়ির দিকে রওনা হলো। নিলয় আর তন্নির সম্পর্কের আজ তিন বছর। তন্নিদের দুটো বাড়ি পরেই নিলয়দের বাড়ি। নিলয়ের চাকরি হবার পর ওরা ওদের পরিবারকে ওদের সম্পর্কের কথা জানায়। পরিবার থেকেও ওদের সম্পর্ক ভালোভাবেই মেনে নেয়। ওদের বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গেছে। তন্নির ফাইনাল এক্সামের পরেই বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে।
দুজন প্রায় চুপচাপই হাঁটছিল হঠাৎ তন্নি নিলয়কে বললঃ আচ্ছা নিলয় তোমার কি মনে আছে আগে আমি তোমাকে কি বলে ডাকতাম?
- থাকবে না কেন? ঢের মনে আছে। নিলয় ভাইয়া, নিলয় ভাইয়া তোমার সাইকেলে আমাকে একটু চড়তে দেবে??
দুজনেই সশব্দে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে নিলয় বললঃ আমি তোমাকে কিভাবে প্রপোজ করেছিলাম তোমার মনে আছে?
- আমি তো তোমার কাছে প্রায়ই গল্পের বই আনতে যেতাম। একদিন বিকেলে তোমার কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদ এর ❝নীল অপরাজিতা ❞ বইটা এনেছিলাম। রাতে বইটা পড়তে পড়তে হঠাৎ দেখি বইয়ের মধ্যে একটা ছোট্ট চিরকুট আর তাতে লেখা ❝ভালোবাসি তন্নিকে❞।
নিলয় মুচকি হেসে গাইতে শুরু করলোঃ ভালেবাসি, ভালেবাসি.................................
তন্নিকে ওর বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নিলয় বাড়ি এলো। ফ্রেস হয়ে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ফোন অফ। চার্জ নেই ফোনে। নিলয় ফোন চার্জে দিলো। ২৭% চার্জ হতেই খুলে নিয়ে ফোন অন করলো। অন করতেই তন্নির ফোন আসলো। নিলয় ধরতেই ওপাশ থেকে তন্নি বললঃ ঠিকভাবে পৌছেছো তো?
- হুম। কি করো?
- শুয়ে পরেছি। নদীর পাড়ে বসে তোমার সাথে বকবক করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।
- কি সব বলছো?
- কি বলছি?
- আমরা নদীর পাড়ে কখন গেলাম? আমরা তো শুধু চৌরাস্তার মোড় থেকে হেঁটে বাড়ি আসলাম। নদীর পাড়ের রাস্তা তো চৌরাস্তার ওপারে। তুমি আবার কি বলো এগুলা?
- তুমি কি বলছো পাগলের মতো। তুমি তো আমাকে ফোন দিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে ডাকলে। তারপর আমি আর তুমি নদীর পাড়ে বসে গল্প করলাম। একটু আগেই তো তুমি আমাকে এগিয়ে দিয়ে গেলে।
- তুমি কি আমার সাথে মজা করছো তন্নি? আমি আবার কখন তোমাকে ফোন দিলাম। তুমিই তো চৌরাস্তার মোড়ে এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিলে। আমরা তো নদীর পাড়ে যাই নি।
- নিলয়, তুমি কি ইদানীং নেশাভান করা ধরেছো?এই মাঝরাতে আমি চৌরাস্তায় মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি? কিসব বলো? তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
- আচ্ছা তুমি একটু ছাদে যাও তো আমি আসছি। সামনাসামনি কথা বলা দরকার।
নিলয়দের বাড়ির ছাদ দিয়েই তন্নিদের ছাদে যাওয়া যায়। ছাদগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত।
তন্নিকে ছাদে আসতে দেখেই নিলয় ছাদ টপকে তন্নিদের ছাদে এসে বললঃ কি হচ্ছে এসব বলো তো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তোমাকে ফোন দেইনি তন্নি। তুমি চাইলে কললিস্ট দেখতে পারো। তোমার কাছে কোন নাম্বার থেকে ফোন আসছিল?
- আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। আমি খেয়াল করিনি কিন্তু নদীর পাড়ে তোমার সাথেই ছিলাম।
- সব জট পেকে যাচ্ছে তন্নি। আমরা একসাথেই ছিলাম কিন্তু ছিলাম না। কি করে সম্ভব?
- এটা তো এখন পরিষ্কার যে আমাদের দেখা হয়নি কিন্তু যাদের সাথে দেখা হয়েছে তারা কে? আমার তো একবারের জন্যও সন্দেহ হয়নি যে, ওটা তুমি নও।
- আমারও মনে হয়নি যে, ওটা তুমি নও। আচ্ছা মানলাম যে, আমাদের তথ্যগুলো কোনোভাবে জোগাড় করা সম্ভব কিন্তু অবিকল কন্ঠ, অবিকল চেহারা এটা কিভাবে সম্ভব? আমার মাথা কাজ করছে না তন্নি।
নিলয় আর তন্নি দুজনেই ছাদে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথে ঘটে যাওয়া রোমহষর্ক ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। হঠাৎ নিরবতা ভাঙলো দূর থেকে ভেসে আসা এক নারী কন্ঠ। নিলয় আর তন্নি দুজনেই ভয়ে চমকে উঠলো রক্ত হিম সেই শব্দে। দূর থেকে হুবহু তন্নির কন্ঠে ভেসে আসছে নিলয়ের নাম।
নিলয় ভয়ার্ত কন্ঠে বললঃ তন্নি তুমি তো এখানে। ডাকছে কে?
দুজনের ঘোর কাটার আগেই আবার বাতাসে ভেসে আসলো নিলয়ের কন্ঠে তন্নির নাম। দুজনে ভয়ে শিউরে ওঠে। চাঁদের আলোয় আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে পরিবেশ। আশেপাশে কাউকেই দেখতে পাই না তারা কিন্তু এই রহস্যের সমাধান লৌকিকতায় নেই। সব কিছুর লৌকিক ব্যাখ্যা হয়না, কিছু রহস্য অলৌকিক অস্পষ্টতার বেড়াজালে বন্দি থাকে।
...সমাপ্ত...
লেখিকাঃ নাবিহা নুপুর