SHE HAS WRITTEN HER DEATH SENTENCES
ডাক্তার হবারও অনেক ঝামেলা। তবে আজ অনেকদিন পর এক্টু সময় বের করে সৌরভকে নিয়ে বেরিয়েছে নিলিমা। আপদত নদীর পাড়েই খানিক চিনা বাদাম চিবিয়ে নেয়া যাক। বেশ হাওয়া দিচ্ছে আজ চারপাশে। লাশ কাটা ছেড়া করা আর বিভিন্ন রোগে নুইয়ে পড়া রুগিদের দেখতে দেখতে অনেকটা হাপিয়েই উঠেছিলো নিলিমা। তবে আজ খানিকটা সস্তি।পাশে সৌরভ বসা, মাথার উপর খোলা আকাশ আর নদীর জলে পা ডুবিয়ে রেখে দূরের ছইওয়ালা নৌকা দেখা.....একজন সাধারন প্রেমিকা হিসেবে আর কি চাই ?
-“নীলিমা”......সৌরভের কন্ঠ শুনে আর চোখে নীলিমা তাকালো।
-“হুম...বল।“
-“আমি যদি কখনো তোকে ছেড়ে চলে যাই। তুই কি করবি?”
হঠাত সৌরভের এমন অবান্তর প্রশ্নে নিলিমা খানিক ভুরু কুচকালেও তেমন একটা আমলে নিলো না। তবু উদ্ভ্রান্তের মত উত্তর দিলো –
-“তুই জীবনে আসার আগে যেমন ছিলাম সেরকম থাকবো...আমি সাধারণ মেয়ে ।কারো প্রতি অত ক্ষোভ পুষে রাখি না।“
সৌরভ স্মিত হাসি হেসে বলল,
-“তোর মত আরও একজনও এই কথা বলেছিলো। মেয়েরা অত সহজ জিনিস না। ধোকাবাজদের অত সহজে ছেড়ে দেয় না। সেটা মেয়েরা নিজেরাও জানে না। আচ্ছা তোকে একজনের গল্প বলি। শোন......।“
-“কার গল্প?”
-“নিলুফার ইয়াসমিন। ডা.নিলুফার ইয়াসমিন...তুই ওনাকে সম্ভবত চিনতিস।“
-“হুম,চিনি । তিন বছর আগে আত্মহত্যা করেছিলেন। ফার্স্ট ইয়ারে ওনার দুটো কি তিনটি ক্লাস পেয়েছিলাম। তো হঠাত ওনার কথা কেনো?”
-“আমার এই সাংবাদিকতার জীবনে অনেক মানুষের ইন্টারভিউ নিয়েছি। জানলে তুই অবাক হবি নিলুফার ইয়াসমিন আত্মহত্যা করার আট ঘন্টা আগে আমিই ওনার জীবনের শেষ ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম।“
-“কি বলিস! তুই নিলুফার ম্যাডামের ইন্টারভিউ নিয়েছিলি ?”
-“হ্যাঁ, নিয়েছিলাম। উনি বিখ্যাত মানুষ। ভেবেছিলাম ওনার আপোয়েনমেন্ট নিতে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হবে। কিন্তু তেমন কোনো সমস্যাই হয়নি। তিনি আমায় ডেকেছিলেন ২৭ শে শ্রাবণ বিকেলে। শীতল বৃষ্টিতে চারপাশ ভেজা স্যাঁতস্যাতেঁ, সবকিছু কেমন যেন বিষন্ন ছিল সেদিন। বাড়িতে ঢুকতেই বোঝা গেলো প্রায় বিয়াল্লিশ বছরের কুমারি জীবনে ডাক্তারি করে অনেক টাকাই কামিয়েছেন। বাড়ির বর্ণনা নাইবা দিলাম। সাধারণ ঝারবাতির দিকেই মিনিট তিনেক তাকিয়ে ছিলাম আমি। তার কিচ্ছুক্ষন পরেই বাড়ির মালকিনের দেখা পেলাম। নিলুফার ম্যাডামকে এর আগে দূর থেকেই দেখেছিলাম। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে তার এই পড়ন্ত যৌবনের সৌন্দর্য যেনো মস্তিষ্কে বিধেঁ যায়। তখন সেই সৌন্দর্যের কিছুটা ক্ষয়ে গেলেও বোঝা যায় এক সময় তোর মতই সুন্দরী ছিলেন।“
-“ওনার সৌন্দর্যের গল্প শোনাতে আমাকে বসিয়ে রেখেছিস?”
- “আরে না, শোন। যা বলছিলাম...তখন সবে মাত্র সাংবাদিকতার শুরু। তখনই ওনার মত একজন মানুষের ইন্টারভিউ ...মোদ্দা কথা খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম।
ইন্টারভিউ তে সাধারণ যা প্রশ্ন মোটামুটি সবই করা শেষ।“
-“যেমন?”
-যেমন...এই ধর –ডাক্তারি জীবনে ওনার সফলতা নিয়ে কথা, বিশেষত সবই ডাক্তারি জীবন কেন্দ্রিক। ইন্টারভিউ শেষ করে উঠে যাবো...এমন সময় তিনি বলে উঠলেন, ‘তোমার নামটা যেনো কি?’ খানিক ভুরু কুচকেই উত্তর দিলাম, ‘সৌরভ’। তিনি বললেন, ‘জীবণে এতো ইন্টারভিউ দিলাম। আর সবার মূল আগ্রহ ছিল আমার বৈবাহিক ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে। কিন্তু এই প্রথম দেখলাম কোনো সাংবাদিক আমার বৈবাহিক জীবন নিয়ে প্রশ্ন করলো না।’
আমি বললাম, ‘ম্যাডাম অফিস থেকেই বারণ করে দিয়েছে এই বিষয়ে প্রশ্ন না করতে। আপনি নাকি তাতে বিরক্ত বোধ করেন।‘
‘হ্যাঁ, করতাম। তবে আর কদিনইবা বাচঁবো। তাই না বলা গল্প গুলো কাওকে বলেই যাই। তুমি তো কিছুই খেলে না। চা টাও ঠান্ডা হয়ে গেছে। আচ্ছা দাড়াঁও তোমার জন্য আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসি।‘ তিনি ফিরলেন তবে শুধু চা নিয়ে নয়...সাথে শাড়িটাও বদলে এলেন। এবার আমি আর চোখ সরাতে পারছিলাম। পড়নে সাদা সিফনের শাড়ি, গলায় মুক্তোর মালা আবছা অন্ধকার ঘরে ওনাকে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির মত লাগছিলো।
তিনি আমায় চা দিয়ে নিজেও নিলেন। অতঃপর বলতে শুরু করলেন, ‘আজ আমার জন্মদিন। সেটা অনেকেই জানে না। কারণ অফিসিয়ালি আমার জন্মদিন ২৫ শে ফেব্রুয়ারী কিন্তু সে এই দিনটার কথা কখনই ভুলতো না। প্রতি সাতাশে শ্রাবণ সে আমার জন্মদিন ঘটা করে পালন করতো। এই ঢাকা শহরেও আমার জন্য খুঁজে খুঁজে কদম ফুল নিয়ে আসত। তার নামটা খানিক বাদেই বলি?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম..।তিনি বলতে লাগলেন...’আমার এই বিয়াল্লিশ বছর অবিবাহিত থাকার কারণ সে। মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট সেমিস্টার এর রেজাল্ট অব্ধি খারাপ করেছিলাম তার কথা ভাবতে ভাবতে। কিন্তু একসময় আমি তার কাছে পুরোনো হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেদের রুচি খুব গতিশীল ...ক্ষনে ক্ষনে বদলায়। অতঃপর বর্ষার এক বিকেলেই রেজিস্ট্রি করা চিঠি এলো। তার হাতের লেখা ছিলো অসাধারণ।গোটা গোটা অক্ষরে লেখা- তার নাকি আর আ্মাকে মনে ধরছে না। সে মনপুরা নামের অন্য এক সুন্দরীকে বিয়ে করবে। করুক তাতে কি...।আমি আমার মতো থাকবো...আমি সাধারণ মেয়ে ।কারো প্রতি অত ক্ষোভ পুষে রাখি না। কিন্তু ক্ষোভ ছিলো। খুব সূক্ষ ক্ষোভ। তবে তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করছিলাম।
ডাক্তার হিসেবে জীবনে পোস্ট মর্টেম করতে হয়েছে। এই কাজটাই ডাক্তারী জীবনে খুব খারাপ লাগতো করতে। মৃত মানুষ গুলোর শরীর কাটাছেড়া করা...তাদের অঙ্গ প্রতঙ্গ গুলো কেটে বের করা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিন্তু জীবনে একজনের পোস্ট মর্টেম আমি খুব আগ্রহ নিয়ে করেছিলাম। তার পোস্ট মর্টেম......’
কথাটা বলে খানিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কার পোস্ট মর্টেম?”
-‘তার, যে আমাকে ছেড়ে এক বর্ষার বিকেলে চলে গিয়েছিলো। তার হৃদপিন্ডটা আমি বের করে দেখেছিলাম...তার মনে আদৌ ভালোবাসার কোনো রেশ ছিলো কিনা। তার দেহটা কেটে ছিড়ে দেখতে খুব আনন্দ হচ্ছিলো...হয়তো সেই সূক্ষ ক্ষোভটা উগড়ে দিতে পেরেছিলাম। আর মজার ব্যাপার কি জানো- সে খুন হয়েছিলো তার স্ত্রী মনপুরার হাতেই। হয়তো মনপুরার ওপর থেকেও তার মন উঠে গিয়েছিলো। আর সেটা জানতে পেরে তার স্ত্রী তাকে মেরে দিলো......” কথাগুলো বলে তিনি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। যেনো এতক্ষণ যা বললেন সব পাগলের প্রলাপ।
তারপর নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে বললেন,” তোমাকেই কেনো এতো কথা বললাম জানিনা। হয়তো তার সাথে তোমার খানিক মিল পেয়েছি তাই। আমার পড়নের শাড়ীটাও সে উপহার দিয়েছিলো ,প্রতি জন্মদিনে আমি এই শাড়িটা পড়ি। নিজের জীবনটাকে নিয়ে অনেক জুয়া খেলেছি। আর খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।‘ খানিক বিরতি দিলেন।বললেন, ‘তুমি এবার আসতে পারো।‘
তিনি সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন...এগুলোই ছিলো ওনার জীবনের শেষ কিছু কথা। ইন্টারভিউটি আর ছাপানো হয়নি। অফিস যদি আমাকে রেসকিউ না করতো তাহলে হয়তো ওনার আত্মহত্যার কেসে আমি ফেসে যেতাম। কিন্তু আজও আমার ডাইরিতে ওনার সম্পূর্ন ইন্টারভিউটা লিখা আছে। যার শিরোণাম দিয়েছিলাম -“--she has written her death sentences.....” চল আজ উঠি সন্ধ্যা নেমে আসছে। “
নীলিমা এতক্ষন উদ্ভ্রান্তের মত কথা শুনছিলো। সৌরভের শেষ কথায় সচকিত হয়ে বলল-
-“আচ্ছা নিলুফার ম্যাডামকে যে ঠকিয়েছিলো ম্যাডাম তার নাম বলে যায় নি?”
সৌরভ পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের দিকে ম্লান হাসি হেসে বলল,
-“বলে গিয়েছিলেন বইকি। কাকতালীয় ভাবে তার নামও ছিলো ‘সৌরভ’।“
লেখাঃ শ্রাবণ