চলে যাওয়ার আগে-পরে
ফোন ধরেই এশার বাবা বলল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’
আমি ফোন কেটে দিলাম। আমার প্রয়োজন এশাকে, তাকে না। সুতরাং তার সাথে কথা বলার কোন মানে নেই। এশার বাবা খুবই রাগী মানুষ। বুদ্ধিমানও। সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে কে ফোন করেছে। এখন সে চিল্লাচিল্লি শুরু করবে। এশাও বুঝে যাবে কে ফোন করেছিল— পরমুহূর্তেই সে আমাকে ফোন করবে।
হলোও তাই। কিছুক্ষণ পর এশা ফোন করলো— ‘হ্যালো...’
এই মেয়েটার গলা এমন, শুনলেই মন ঠান্ডা হয়ে যায়। আমার মন ঠান্ডা হলো, কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।
‘কি হলো কথা বলছো না কেন?’
‘শুনছি।’
‘কি শুনছো?’
‘কথা।’ লম্বা করে দম নিলাম— ‘তোমার কথা শুনছি।’
ওপাশে এশাও চুপ করে রইলো। মেয়েটা খুব আবেগি। প্রায়ই আবেগে কেঁদে ফেলে। আমি নিশ্চিত তার চোখে পানি চলে এসেছে।
‘এশা।’
‘হু..’
‘ক'টা বাজে?’
‘দশটা বায়ান্ন।’ একটু থামে এশা তারপর বলে, আমি বুঝতে পারছি তুমি কিছু বলতে চাও— আমি কোন বিশেষ কথা বলবে?’
‘একটা কঠিন কথা বলবো।’
‘তোমার কঠিন কথা কি তা আমি জানি।’
‘সেটা বলবো না, অন্য কথা বলবো। কাজের কথা। এমন কথা যা তোমাকে আগে কখনো বলিনি— শুনবে?’
‘বলো।’
‘কাল সকাল আটটার পরে তুমি আমার বাসায় আসবে। একা আসবে না। তোমার বন্ধু আছে না নীলা; ওকে নিয়ে আসবে। বাইরে চৌকিতে আমি চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকবো। তুমি আমাকে ডাকবে না। আমার শোবার ঘরে পড়ার টেবিলের উপর দেখবে একটা বক্স— ওটা তোমার। বক্সের ভেতরে একটা চিরকুটও পাবে, সেটাও তোমাকেই লেখা। চিরকুটটা তুমি পড়বে কিন্তু কাঁদতে পারবে না। কথা দাও কাঁদবে না!’
‘চিঠিতে তুমি কি লিখেছ আবির— খারাপ কিছু?’
‘তেমন কিছু না। সাধারণ কয়েকটা কথা লিখেছি।’
‘তাহলে কাঁদবো কেন?’
‘তুমি তো অল্পতেই কেঁদে ফেলো।’ একটু থেমে আমি আবার বললাম, ‘তুমি কি জানো আমার সবচেয়ে মন খারাপ কখন হয়? তুমি কাঁদলে। শুধু মন খারাপ না, কষ্টও হয়।’
‘ঠিকাছে কাঁদবো না।’ বলে একটু থামে এশা— ‘আবির, তোমার কি মন খারাপ?’
‘হুমম। বেশী খারাপ না একটু খারাপ।’
এশা জানতে চাইলো না মন খারাপের কারণ কি। কি কারণে আমার মন খারাপ থাকে এশা তা জানে। কিন্তু আজকের মন খারাপের কারণটা আলাদা। যেটা কেউ জানেনা। এশাও না।
আবার কথা বললাম আমি— ‘এশা, শেষবারের মতো সেই কবিতাটা শোনাবে?’
‘শেষবার বলছো কেন?’
‘কারণ আর কখনো আমি কবিতাটা শুনতে চাইবো না।’
‘কেন?’
‘এই কবিতাটা আর ভালো লাগে না এশা। এটা আর শুনবো না। এরপর থেকে তুমি আমাকে প্রতিদিন নতুন নতুন কবিতা শোনাবে।’
পরদিন সকালে এশার ঘুম ভাঙলো নয়টার দিকে। ঘুম থেকে উঠেই সে দেখলো নীলা তার শিউরে বসা— বিষন্নতায় ওর মুখ কালো হয়ে আছে।
‘কি হয়েছে রে নীলা?’ উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে এশা।
সে মুহুর্তে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না নীলা। নিরবে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ওর গাল বেয়ে।
‘কি হয়েছে নীলা— বল আমাকে!’
‘আবির মারা গেছে এশা!’
পাঁচ সেকেন্ড স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে এশা। তারপর বলে, ‘তুই মজা করছিস না! বল তুই মজা করছিস..’ বলতে বলতে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে এশা! একটু পরে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে থাকে ওর শরীর— কাঁপতে কাঁপতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে!
সেদিনের সন্ধ্যা।
দোতলার ব্যালকনিতে হলুদ শাড়ি পরে একটি চেয়ারে বসে আছে এশা। হালকা বাতাসে শাড়ির আঁচল কেঁপে কেঁপে উঠছে কখনো কখনো। উদাসীন মুখ ওর। এলোমেলো চুল চোয়ালের সাথে লেপ্টে আছে। ওর চোখ দূরে— দূরের নদী ছাড়িয়ে আরো অনেক অনেক দূরে। আর ওর হাতে একটা চিরকুট। তাতে কয়েকটা লাইন—
“এশা, জানি তুমি কাঁদছো। তুমি তো জানো, তোমার কান্না আমাকে সবথেকে বেশি কষ্ট দেয়— কাজেই তুমি আর কাঁদবে না। জানো এশা, একবার একটা শাড়ী পছন্দ হয়েছিল— হলুদ রঙের শাড়ি। জানি হলুদ রঙ তোমার পছন্দ না তারপরও ভেবেছিলাম তোমার জন্য কিনবো। দোকানী দাম চেয়েছিল সতেরো'শ আমার কাছে এগারো'শ টাকা ছিলো— কিনতে পারিনি। কাল যখন অনেকগুলো টাকা হাতে পেলাম তখন সে-ই কথাটা মনে পড়ে গেলো। অনেক খুঁজাখুঁজির পরে শাড়িটা পেলাম। এশা, শাড়িটা তুমি পরবে তো?
তুমি নিশ্চয় ভাবছো আমি টাকা কোথায় পেলাম। সাইন্টিস্ট আশরাফ খাঁন। তাকে তো তুমি চেনোই, তোমার বাবার পরিচিত। সম্প্রতি সে একটি ভয়ঙ্কর কেমিক্যাল তৈরি করেছে। কেমিক্যালটি সামান্য মাত্রায়ও যদি মানব শরীরে প্রবেশ করে কোন প্রতিক্রিয়া ছাড়াই আট ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারে। কেমিক্যালটির কার্যক্ষমতা যাচাই করার জন্য আমি আমার শরীর দিয়ে দিয়েছি। বিনিময়ে দশ লক্ষ্য টাকা নিয়েছি। এখন বাবার অপারেশন টাও ঠিকঠাক মতো হয়ে যাবে। সারাজীবন তো পরিবারের বোঝা হয়েই কাটালাম। তাদের সামন্য কোন প্রয়োজনও কোনদিন মেটাতে পারিনি। কিন্তু আজ তাদের জন্য এতটুকু করতে পেরেছি বলে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।
এশা, জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমারও হচ্ছে। স্বপ্ন ছিলো তোমাকে নিয়ে একটি নতুন জগৎ তৈরি করবো। সে-ই জগতটা হবে শুধু তোমার এবং আমার। কিন্তু তা আর হলো না। আজ স্বার্থপরের মতো চলে যাচ্ছি। তুমি কিন্তু আমাকে একদম মনে রাখবে না। আমার স্মৃতিগুলোকে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে। আমি চাই, তোমার একটা সংসার হোক— যেমনটা তুমি স্বপ্ন দেখো ঠিক তেমন। আর হ্যাঁ, আমার মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের আর কোন অকর্মন্যকে তোমার জীবনে জায়গা দেবে না। আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রক্ষা করিনি— আমাকে তুমি ক্ষমা করো না এশা, কখনোই না।
ভালো থেকো।”
লেখাঃ এম.আই আশিক।