জীবন থেকে নেয়া

আজ থেকে নয়/দশবছর আগে আমার মায়ের নাম্বারে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসতো প্রায়ই। মা এমনিতে বেশ খিটখিটে মেজাজের হলেও অপরিচিত কারো সাথে ফোনে কথা বলার সময় সুন্দর করে সালাম দিয়ে কথা শুরু করেন। বলে রাখা ভালো, আমার মায়ের কণ্ঠস্বর ছিল বয়সের তুলনায় বেমানান। মানে সেই বয়সেও তার কণ্ঠস্বর শুনে কেউ আন্দাজ করতে পারতো না যে এই মহিলার স্কুল কলেজ পড়ুয়া তিনটে কন্যাসন্তান এবং একটা পুত্রসন্তান রয়েছে। আমাদের দুই বোনের ধারণা ছিল, সেই আননোন নাম্বারের মালিক মায়ের কণ্ঠ শুনেই হয়তো নিয়ম করে কল দিতে শুরু করেছেন। মায়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে না পারলেও আমি আর বড় আপা সময় পেলেই এটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিতাম। বড় আপা বলতো,

- শোন রুনু, বিয়ের আগে মাকে নিশ্চয়ই কেউ পছন্দ করতো। এ কাজটা সে ব্যক্তিরই। 

বড় আপার কথা শুনে আমি চোখমুখ কুঁচকে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলতাম,

- আমার কিন্তু তা মনে হয় না আপা। ওই লোক মায়ের কণ্ঠ শুনেই ঘায়েল হয়ে গেছে। পূর্বপরিচিত কেউ না। 

আমাদের কথোপোকথন শুনে শিলা অবুঝ দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকতো। বুঝতো না তো কিছু। বয়স ছিল মাত্র সাত কি আট বছর।


একদিন বিকেলে বেলকনিতে বসে বড় আপা আমার চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছিলো, এমন সময় মায়ের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলে আমি আর বড় আপা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলাম। বেলকনি থেকে শুনতে পাচ্ছি মা পরপর দু'বার সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন,

"কে বলছেন? হ্যালো? কে বলছেন?"

ওপাশ থেকে কোনো প্রতিউত্তর না আসায় একসময় মা ফোনের লাইন ডিসকানেক্টেড করে দেন। মায়ের সাথে এ নিয়ে সরাসরি কথা বলতে গেলে মা ভ্রু কুঁচকে বলেন,

- কে কল দেয় না দেয় নিয়ে আমাদের এত ঘাটাঘাটি করার দরকার কি! যখন নিজের প্রয়োজন হবে ঠিকই কথা বলবে তখন। 

মায়ের এ যুক্তি আমাদের অপুষ্টিকর মস্তিষ্কে বোধগম্য হত না। বিপরীতে যদি বলতাম,

- রিসিভ করো কেন তাহলে? এজন্যই তো পেয়ে বসেছে। কিছুদিন রিসিভ না করে দেখো, পরে আর কল দিবে না। 

মা তখন ঝাঁঝালো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠতেন,

- তোকে এত মাতাব্বরি কর‍তে কে বলেছে? দরকারি কলও তো হতে পারে। যা গিয়ে পড়তে বস্। 

মায়ের হুমকিধামকি শুনে আমরা কেউই আর কথা বাড়ানোর সাহস পেতাম না। 

সেসময় কলরেট খুব একটা সস্তা ছিল না, ভালোই ছিল বলা যায়। আমাদের মাথায় ঢুকতো না প্রতিদিন এত এত টাকা খরচ করে কে এমন পাগলামি করছে! সেদিন রাতে বাবা বাড়ি ফেরার পর খাবার টেবিলে আমি কৌশলে এ প্রসঙ্গ টেনে আনলাম। তারপর ইনিয়েবিনিয়ে বাবার কাছে নালিশ জানালাম, 

"জানো বাবা, মাকে না একটা নাম্বার থেকে খুব বিরক্ত করছে ইদানীং। কল দেয় কিন্তু রিসিভ করলে কথা বলে না।" 

আমার কথা শুনে বাবার কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ হল বলে মনে হল না। বাবা অলস ভঙ্গিতে ভাতের প্লেটে কচি লাউয়ের তরকারি দিয়ে ভাত মাখিয়ে যাচ্ছেন। আমার সাথে সাথে বড় আপাও তাল মেলালো,

- হ্যাঁ বাবা, রুনু ঠিকই বলেছে। একটা মানুষ এতদিন ধরে কল করে যাচ্ছে অথচ রিসিভ করলে কথা বলছে না। কি অদ্ভুত না?

বাবা আমাদের দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার ভাতের প্লেটে মনোযোগ দিলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন,

- অদ্ভুত কেন হবে! নেটওয়ার্কের সমস্যা তো হতেই পারে। 

মায়ের যুক্তির মত বাবার যুক্তি শুনেও আমি আর বড় আপা একইরকমভাবে আশাহত হই। আর তারপর এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর ধীরেধীরে এই আননোন নাম্বারের বিষয়টা নিয়ে আমাদের অতিরিক্ত কৌতুহলও দমে যায়।  


আজ বিকেলে বেলকনিতে বসে চা খাওয়ার সময় হঠাৎ করে সেই পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু কি দেখে যেন মনে পড়লো? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। দূরের এক বিল্ডিংয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম, মধ্যবয়সী এক মহিলা ছাদে দাঁড়িয়ে গাছে পানি দিতে দিতে হেসে হেসে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। তারপরই চলে গেছিলাম পুরনো দিনের স্মৃতিচারণে। আজকাল অতীতের কিছু কিছু স্মৃতি খুব তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ কিছু স্মৃতি সুখের আর কিছু কষ্টের। সকাল থেকে শরীর মেজমেজ করছিলো। তাপমাত্রার উঠানামা চলছিলো একটু পরপর। জ্বরের সময় আমার এমন হয়। কারণে অকারণে অনেক তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি।

চা শেষ করে খালি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে রুমে এসেই বড় আপাকে কল করলাম,

- হ্যালো বড় আপা?

- হ্যাঁ বল্, কেমন আছিস?

- ভালো। তোমরা কেমন আছো? 

- ভালো। শাহেদের সাথে ঝামেলা মিটেছে তোর?

আমার হাসিমাখা মুখটা নিমিষেই যেন মিইয়ে গেল।

- নাহ্। তাকে তো আজকাল পাওয়াই যাচ্ছে না। 

ওপাশ থেকে বড় আপা ঠান্ডা গলায় বুঝাতে শুরু করলো,

- অভিমান পুষে রাখিস না রুনু৷ একসময় গিয়ে এটা বড় আকার ধারণ করবে। তখন দেখবি চাইলেও আর আপোষ করতে পারছিস না। 

আমার কণ্ঠেও অভিযোগের সুর ভেসে উঠলো,

- কি করে মিটিয়ে নিব বলো তো? রাত করে বাড়ি ফেরে। খেয়েদেয়ে হয় ল্যাপটপ নিয়ে বসবে নয়তো শুয়ে পড়বে। এসবের মাঝে আমাকে দেয়ার মত সময় তার কোথায় আছে! ভালো আছে তো, খুব ভালো আছে সে। নিজের মত করে থাকছে, চলছে।

- তোরা কোথাও গিয়ে ঘুরে আয় না একদিন। সম্ভব হলে আমাদের এখানে চলে আয়। সময় ভালো কাটবে।

আরো কিছু বলতে নিচ্ছিলাম বড় আপাকে কিন্তু থেমে গেলাম। শুধু বললাম,

- দেখি। জানাব তোমাকে। 


শাহেদের সাথে আমার সংসার জীবন চার বছরের। আমাদের তিন বছরের মেয়ে আরিশা যখন আমার পেটে ছিল, তখন থেকে শাহেদের সাথে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। তখন সে জব সুইচ করেছিলো বলে কাজের প্রেশার আর ব্যস্ততা ছিল বেশি। ওই অবস্থায় আমাকে ওর যতটুকু সময় দেয়া দরকার ছিল, ততটুকু দিতে পারতো না। দূরত্বের সূত্রপাত এখান থেকেই। অন্য সময় হলে হয়তো আমি মানিয়ে নিতে পারতাম সহজেই কিন্তু সেই সময়টা ছিল একেবারেই ভিন্ন। তবে সে দূরত্ব আমাদের ঘুচে গিয়েছিলো আরিশার জন্মের পরপরই। আবার নিজেদের মত করে ভালো থাকতে শুরু করেছিলাম আমরা। পুরনো অভিমান আর অভিযোগগুলো ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু এ সুখের সময়টা খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না। গত তিনমাস ধরে শাহেদ সংসারে মনোযোগ দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমার প্রতি তার সকল দায়িত্ব কর্তব্য থেকে সে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এমন নয় যে, সে অন্য কোথাও ঝুঁকে গেছে। কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটেনি এ আমি নিশ্চিত। তাহলে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে জানি না। শুধু জানি, শাহেদকে আমি আগের মত করে একদমই পাচ্ছি না। 


ছোট ভাই রাতুলের কাছ থেকে মাকে কিছুদিনের জন্য আমার কাছে নিয়ে এসেছি। মা আসতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু আমি এত জোরাজুরি করায় আর মানা করতে পারলেন না। কেন যেন মনে হচ্ছিলো, মাকে আমার কাছে এনে রাখলে আমি অনেকটা স্বস্তি পাব। ক্ষণিকের জন্য হয়তো মুক্তি পাব অকারণ দুশ্চিন্তা থেকে।

দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিলাম,এরমধ্যে মা এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। 

- কি রান্না হবে আজ?

ইলিশ মাছের টুকরোগুলোতে মশলা মাখাতে মাখাতে প্রতিউত্তর করলাম,

- ইলিশা মাছ ভাজা, লাউশাক দিয়ে শিংমাছের তরকারি আর তোমার পছন্দের শুঁটকি ভুনা। 

মা শাড়ির আঁচলটা টেনে কোমরে গুঁজলেন। তারপর আমাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিতে নিলে আমি বাঁধা দিতে চাইলাম কিন্তু মা আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না। বললেন,

- মা মেয়ে একসাথে মিলে গল্প করতে কর‍তে রান্না করলে রান্নার টেস্টই অন্যরকম হবে।

আমি মুচকি হাসলাম। খানিকবাদে মা কথাপ্রসঙ্গে বলতে লাগলেন,

- শাহেদ বাড়ি ফেরার আগে একটু ফিটফাট হয়ে থাকতে পারিস না রুনু? আর ওকে খাবার বেড়ে দিয়েই তুই চলে যাস কেন? সামনে বসে থাকবি। পারলে একসাথে খেতে বসবি। 

- ও এত রাত করে ফেরে যে আমার ক্ষিদে পেয়ে যায়। তুমি তো জানো, আমি ক্ষিদেপেটে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। 

- বেশ তো। ক্ষিদে পেলে অল্প করে খেয়ে নিবি। তারপর ও আসার পর আবার ওর সাথে খেতে বসবি। 

আমি কিছু বলার আগেই মায়ের ফোন বেজে উঠলো। আমি গিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা তুলে নিলাম। ফোনের স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম। 

মা কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

- রং নাম্বার ছিল। 

সাথে সাথে আমি কৌতুহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে বসলাম মাকে,

- আচ্ছা মা, তোমাকে এখনো ওই আননোন নাম্বারটা থেকে কল দেয়?

মা ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি চেপে রেখে লাজুক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন,

- এখন তো আর তোর বাবা নেই। কে কল দিবে বল্! 

বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলাম আমি। কৌতুহল যেন আরো বেড়ে গেল।

- মানে? ওই নাম্বারটা থেকে বাবা কল করতেন প্রতিদিন? 

- হুম। সারাক্ষণ তো আমার খিটমিটে মেজাজের কণ্ঠ শুনে অভ্যস্ত ছিলেন তাই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলে আমি নরম গলায় সালাম দিয়ে কথা বলতাম; এটা তার খুব পছন্দের ছিল। শুধু ওই কণ্ঠস্বর আর সালামটা শোনার জন্যই এই ছেলেমানুষীটা করতেন।

আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। বাবাকে আমরা সবসময় কাঠখোট্টা রূপেই দেখে এসেছি, মিতব্যয়ীও বটে। আর এই মানুষটা কিনা...! বাবা-মায়ের যুগটাই আসলে অন্যরকম ছিল৷ ভণিতা বা অবহেলার কোনো প্রশ্র‍য় থাকতো না সম্পর্কের মধ্যে। আর এখন? এক বিছানায় থেকেও সাথের মানুষটার অস্তিত্ব অনুভব করা যায় না।

মা হয়তো বরাবরের মতো এবারও আমার মনের কথাগুলো ধরে ফেলতে পারলেন। বললেন,

- সম্পর্ক কখনো বদলায় না রুনু। শুধু মন-মানসিকতা আর গুরুত্বটা বদলে যায়। সময়টা এখন এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, আমরা কেবল নিজেরটুকুই ষোলআনা বুঝি। সাথের মানুষের মনের খবর রাখার চেয়ে নিজের মন ভালো রাখার প্রয়োজনীয়তাটা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ গুরুত্ব কে না চায় বল? তুই যেমন চাইবি, শাহেদ তোকে আগের মত সময় দিক; ঠিক তেমনি শাহেদও তো চাইতে পারে বাড়ি ফেরার পর তোর পুরোটা সময় তাকে ঘিরে কাটুক। এটা কি খুব অন্যায় হয়ে যাবে? শাহেদ অফিস থেকে ফেরার পর খাবার টেবিলে তোর সারাদিনের জমানো কথার ঝুলি নিয়ে বসে পড়িস তো একবার, দেখিস সে তোকে ফিরিয়ে দেয় কিনা। 


মায়ের কথা শুনে এক মূহুর্তের জন্য আমার মনে হল, "ঠিকই তো। আমি নিজেও তো কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছি শাহেদের ব্যাপারে। কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আচ্ছা নতুন করে তবে শুরু করে দেখি সম্পর্কের টান অনুভব করা যায় কিনা বা গুরুত্ব ফিরে আসে কিনা।"


সাতদিন পর...

- হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।

-....

- হ্যালো? কে বলছেন?

-...

ফোনের ওপাশ থেকে এখনো কেউ কিছু বলছে না দেখে আমিই এবার মুখ খুললাম।

- শাহেদ, কি ধরনের ছেলেমানুষী এগুলো?

একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শাহেদ বললো,

- আমার শ্বশুরমশাই ধরনের ছেলেমানুষী। কিন্তু ধরে ফেললে কি করে?

- ট্রু কলার বলে একটা এ্যপ আছে, তা হয়তো তুমি ভুলে গেছো৷ 

- তাহলে প্রথমে এমন অপরিচিতের মত সালাম দিলে কেন?

- মন চাইলো তাই। কখন ফিরছো?

- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। 

- বাব্বাহ্, হঠাৎ এত চেইঞ্জ! 

- গুরুত্ব যতটুকু পাচ্ছি, তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছি। মাঝখানে কি যে হয়েছিলো আমার। 

- ছাড়ো তো সেসব কথা। এখন তো ভালো আছি, বেশ আছি। আচ্ছা শুনো...


(সমাপ্ত)




লিখা- Nusrat Khan Ani


Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

রিয়্যাক্টর কিং

একটি মেয়ের গল্প

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]