মাটির ব্যাংক
লিজা আর জাকির এর ছোট্ট সংসার। এক ছেলে এক মেয়ে।ছেলের বয়স সাত বছর আর মেয়ের তিন বছর। জাকিরের খুব ইচ্ছা বাচ্চাদের ভালো স্কুলে পড়াবে। ছেলেদের জন্য মতিঝিল আইডিয়াল তার খুব পছন্দ।এখন লটারির মাধ্যমে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়।তাই সাত বছর হতেই জাকির ভর্তি ফরম নিয়ে আসলো।আর আলহামদুলিল্লাহ জাকির এর ছেলে চান্স পেলো।প্রায় পাঁচ বছর পর লিজা জাকির দম্পতি আবার ঢাকায় এসে বাসা ভাড়া নিলো।
একটু পরিচয় করিয়ে দেই এখন।লিজা আর জাকির দুজনই ছোট বেলা থেকে ঢাকায় বড় হয়েছে। তাদের দুজনের পরিবারের প্রায় সব আত্মীয়রাই ঢাকায় থাকে।দুজনই মধ্যবিত্ত পরিবারের। লিজা দেখেছে তার বাবা খুব হিসেব করে চলতো।তবে মোটামুটি সচ্ছল ভাবেই বড় হয়েছে। বিয়ের আগ পর্যন্ত সংসার এর এসব হিসাব এসবের কিছুই বুঝতো না।দুজন ঢাকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্ৰাজুয়েশন করেছে।লিজা ইচ্ছা থাকলেও সংসার সামলে চাকরি করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।আসলে দরকার হয়নি।আর জাকির একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।যা বেতন পেতো তা দিয়ে তাদের সুন্দর ভাবে চলে যেতো। চাকরির জন্যই লিজা জাকির পাঁচ বছর ধরে নারায়নগঞ্জ ছিলো।তবে পরিকল্পনা ছিলো যে ছেলেকে যখন স্কুলে দেবে তখন ঢাকায় চলে আসবে।তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় বাসা নিলো।
জাকির বেতন পায় চল্লিশ হাজার টাকা। নারায়নগঞ্জে বাসা ভাড়া ছিলো মাত্র ছয় হাজার টাকা।তারপর বাকি টাকা দিয়ে বেশ সচ্ছল ভাবেই কাটিয়েছিলো এই দম্পতি। কিন্তু ঢাকায় বাসা ভাড়া নিলো উনিশ হাজার টাকা দিয়ে। ছোট্ট দুই বেডরুমের বাসার এতো ভাড়া। জাকির সবসময় একটু পরিপাটি আর একটু গোছানো এলাকায় থাকতে পছন্দ করতো। তাছাড়া ঢাকায় আসলে সব আত্মীয়রাও বেড়াতে আসবে যেমন তেমন বাসা নেয়া যাবেনা। জাকিরকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে ।আর ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বাজবে।দুজনই মিরপুর এলাকায় বড় হয়েছে ।এসব এলাকায় একেবারেই নতুন।কয়েকজন অফিস কলিগ এখানে থাকে। অবশ্য তারাও বাচ্চাদের স্কুলের জন্যই এখানে এসেছে। এলাকাটা মোটামুটি নিরাপদ।সব সময় সিকিউরিটি গার্ড থাকে এই এলাকায়।এই সব কিছু বিবেচনা করে লিজা জাকির দম্পতি ভাড়া বেশি হলেও এখানেই বাসা ঠিক করে।
অনেক হিসেব নিকেশ করে অবশেষে লিজার পরিবার নতুন বাসায় উঠেছে। ঠিক করলো একটু হিসাব করে চলবে।কোন ফালতু খরচ করবেনা।জাকির এর বাবার বাড়িটা ছয় তলা বানানো হচ্ছে। এখনও কাজ চলছে। কমপ্লিট হয়ে গেলে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে দিবে,তাছাড়া সামনে একটা প্রমোশন হতে পারে তখন বেতনটাও বাড়বে।তাই কিছু দিন একটু কষ্ট করতে হবে।এটা কোন ব্যাপারনা।এসব চিন্তার মধ্য দিয়েই শুরু করলো নতুন পথচলা।এতো বছর পর ঢাকায় বাসা নিয়েছে তাই ভাইরা,দেবর,ননদরা সবাই দেখতে আসছে। লিজা জাকির বরাবরই অতিথিপরায়ণ।কেউ আসলে আতিথেয়তা করতে একটুও কৃপনতা করেনা কখনো।কিন্তু মাসের বিশদিন যেতেই ঘটলো বিপত্তি।টাকা সব খরচ হয়ে গেছে এখন কিভাবে চলবে বাকি দিন।দুজনই সেই চিন্তায় পড়ে গেল।
অফিসে অনেকেই প্রয়োজন হলে লোন করে কিন্তু এই বিষয়টা জাকির এর কখনো পছন্দ ছিলোনা। খুব চিন্তায় পড়ে গেল জাকির।মান সম্মানের বিষয়।কিন্তু কিছু করার নেই।তাই দুজন মিলে আলাপ করে ঠিক করলো অফিস থেকেই লোন নিবে।প্রথম মাসে তাই করলো।
পরবর্তী মাস থেকে শুরু হলো স্কুল।বাসা ভাড়া উনিশ হাজার টাকা,বুয়া আর টুকটাক মিলিয়ে চার হাজার টাকা,স্কুল এর বেতন যাতায়াত ভাড়া সব মিলিয়ে কমপক্ষে ছয় হাজার টাকা, বাসায় দিতে হয় কিছু সব হিসেব করে লিজা জাকির এর মাথা নষ্ট।এতো হিসেব করে কীভাবে চলবে।এই বাজারে বাকি এই সাত আট হাজার টাকা দিয়ে কীভাবে মাস চলবে।আর যদি মেহমান আসে তাহলেই বা কি করবে।এসব চিন্তায় ঢাকা আসার আগে যেই আনন্দটা ছিলো দুজনের মাঝে সেটা কমতে থাকলো।
বিভিন্ন আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত দিচ্ছে।আজ জন্মদিন তো কাল কারো বিয়ে ,নাহলে এমনি ছুটির দিনে গেট টুগেদার।গেলেই গিফট সাথে ভাড়া।কয়টায় না গিয়ে থাকা যাবে।এক একদিন এক এক ওযুহাত দেখিয়ে যাচ্ছেনা।যেখানে না গেলেই না সেখানে হয়তো যাচ্ছে। শুধু বাবার বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ি।বাবা অসুস্থ তাকেতো দেখতে যেতেই হবে। লিজার ভাইরা বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে শুক্রবার হলেই যাচ্ছে।এইতো একটু ফার্স্টফুড খাওয়া, ঘোরাঘুরি।একটু বিনোদন আর কি। খুব বেশি ঘোরাঘুরি লিজার পছন্দ না হলেও মাঝে মাঝেতো বেড়ানো হতো।এটা দুজনই পছন্দ করতো।কিন্তু এখন আর এটা কোনভাবেই করা সম্ভব হচ্ছেনা।ভাইদের নানা অজুহাত দেখিয়ে না করে দিচ্ছে।
লিজার বাচ্চারা বরাবরই অনেক শান্ত ,ভদ্র। কখনো তেমন কিছু ডিমান্ড করেনা।তবে এখন সব কাজিন দের দেখে মাঝে মাঝে টুকটাক জিনিস চায়। কিন্তু সেটাও দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
তিন/চার মাস যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে মাসের শেষে রিকশা ভাড়ার টাকাও হাতে থাকছেনা।তাই ব্যলেন্স করার জন্য সপ্তাহে চারদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।সপ্তাহে এক দুই দিন স্কুল মিস করাই যাবে।কোন অজুহাত দেখালেই হবে।এটা ভেবেই শত খারাপ লাগলেও এই সিদ্ধান্ত নিলো দুজনে মিলে
প্রতি মাসেই অফিস থেকে লোন নিতে হচ্ছে। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস দরকার কিন্তু কোনভাবেই কেনা সম্ভব হচ্ছেনা।এভাবে যে চলতে হবে সেটা কখনো এই দম্পতি চিন্তাই করেনি।কাউকে বলাও যাচ্ছেনা।জাকির এর আত্মসম্মান বোধটা খুব বেশি। অফিসে অনেকেই লোন নিয়ে চলে তাই সমস্যা নেই।কিন্তু তাই বলে শ্বশুর বাড়ি, বাবার বাড়ির কারো কাছে এ বিষয়ে বলা যাবেনা। কঠিন আদেশ।তাই লিজাও নিরব রইলো।এসব বিষয় নিয়ে দুজনই আস্তে আস্তে হতাশ হতে থাকে।পকেটে টাকা না থাকলে নাকি মনেও শান্তি থাকেনা বিষয়টা দুজনই উপলব্ধি করতে পারছে।সব মিলিয়ে ঢাকায় চলতে হিমশিম খাচ্ছে দুজন।
বছর প্রায় শেষ হতে চলল এখনো বড়ি কমপ্লিট হয়নি,প্রমোশন এর কোন খবর নেই।বিরক্ত হয়ে লিজা বলেই ফেলল যে ভালো স্কুলে পড়াতে হবেনা। আবার নারায়নগঞ্জ চলে যাবে। এত হিসেব করে,লোন করে সত্যি চলা যায়না। কিন্তু জাকির যাবেনা। ছেলের পড়াশোনা সবার আগে।লিজার চিন্তাও ছেলেকে নিয়ে কিন্তু জাকির এর এতো টেনশন,হতাশা দেখে ঐ কথা বলেছিলো। লিজার আর ভালো লাগছিলো না।
এতো হিমশিম অবস্থার মধ্যে হঠাৎ লিজার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো।বাবাকে দেখতে যেতেই হবে।আর গেলেই আবার অনেক খরচ। তবুও জাকির নিয়ে গেল তিন/চার দিন। একটু সুস্থ হওয়ায় ভাবলো পরবর্তি মাসে বাসায় নিয়ে গেলে তখন আবার যাবে দেখতে । কিন্তু হঠাৎ আবারো বেশি অসুস্থ হওয়ায় আবার যেতে হবে দেখতে।মাসের শেষ জাকির এর পকেটে আছে একশ টাকা।পিজি হাসপাতালে যেতে আসতে যে ভাড়া লাগবে সেটাতো নাই। জাকিরকে বলতেও বিবেকে বাঁধছে।এর মধ্যে অনেক লোন করে ফেলেছে তাই এই মাসে আর লোন নেয়াও সম্ভব না।এদিকে লিজার বাবা কে দেখতে যেতেই হবে।কারন ওনার অবস্থাও ভালো না।
হঠাৎ লিজার খেয়াল হলো বাসায় থাকা মাটির ব্যাংক এর কথা।এখানে সব নতুন ছোট টাকাগুলো রাখা হত।বড় টাকার নোট গুলো ঢাকায় আসার পর খরচ করে ফেলা হয়েছে। ছোট নোট আর অনেক পয়সা আছে এই ব্যাংকে।যেই ভাবা সেই কাজ।রাতে সবাই ঘুমানোর পর লিজা ব্যাংক খুলল। দুই টাকা, পাঁচ টাকা, পঞ্চাশ টাকা এভাবে সব মিলিয়ে হলো চারশত চল্লিশ টাকা। হাসপাতালে যেতে লাগবে আড়াইশো টাকার মতো।আর আসার সময় একটা ব্যাবস্থা করাই যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ।লিজা অপেক্ষা করল সকাল হবার। সকাল হতেই লিজা জাকিরকে সবটা বলল। লিজার অবস্থা দেখে জাকির আর না করতে পারলো না।তাই সবাই মিলে হাসপাতালে গেলো।ফেরার সময় জাকির এর আড়ালে লিজা ওর ছোট ভাইর কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে এলো।ওর ছোট ভাই অবাক হলে লিজা অন্যভাবে কাটিয়ে দেয়।যাই হোক না কেন জাকিরকে লিজা কারো সামনে ছোট হতে দিতে পারেনা।
বাসায় এসে দুজনেরই নতুন অভিজ্ঞতা হলো।এতো দিন অবহেলায় ফেলে রাখা ব্যাংক আর ব্যাংকের দুই, পাঁচ,দশ টাকার নোট ওদের অনেক উপকার করল।কখনো ভাবতেই পারেনি লিজা জাকির দম্পতি যে এই ব্যাংক কখনো তাদের মান বাঁচাতে পারে বা প্রিয়জনকে দেখতে এতো কাজে লাগতে পারে।লিজাও সেদিন বুঝতে পারে এক , দুই, পাঁচ টাকারও অনেক মুল্য।বিপদে এই নোটগুলো একসাথে করলেও বড় সংখ্যায় পরিনত হয় আর অনেক কাজে লাগে।
পরের মাসেই জাকির আরো দুটি ব্যাংক কিনে দেয় লিজা কে। লিজার বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
কেটে যায় সাতটা বছর।ভাবছেন নিশ্চই এখন কি অবস্থা এই দম্পতির?এখন আলহামদুলিল্লাহ এই দম্পতি ভালো আছে। দুই বার প্রমোশন হয়েছে জাকির এর।এখন হাই স্যালারি পায়,বাড়িটাও কমপ্লিট হয়ে গেছে।ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।তাই ভাড়াও পাচ্ছে।এখন আরো বড় বাসা ভাড়া নিয়েছে।তাই ভাড়াও অনেক বেশি। আত্মীয়দের সাথে গেট টুগেদার,দাওয়াত এ যাওয়া কোন কিছুতে খুব বেশি ভাবতে হয়না এখন।বাচ্চাদের ইচ্ছাও চেষ্টা করে পুরন করার।
তবে তাই বলে ঐ দেড় বছর সময়টা আর ব্যাংকের কথা দুজনের কেউই ভোলে না।ভাবে এমন সময় একবার জীবনে আসলে মন্দ হয়না অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। হিসাব করে চলা,অপচয় না করা,কিছুটা সন্চয় করা আরো অনেক কিছু।ঐ সময়টা এই দম্পতিকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে।সময় পেলেই দুজন মিলে খারাপ সময়টার স্মৃতিচারণ করে।ছোট বড় সব নোট মনে করে ব্যংকে রাখে।দোয়া করে যাতে সামনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন আর না হতে হয়।আর যদি হতেও হয় তাহলে এই মাটির ব্যাংকতো আছেই।
লেখাঃ মৌমিতা হোসেন।