বিষণ্ণ অবনী
মৃত্তিকার কাফনে মোড়া নিথর দেহের খাটিয়ার সামনে বসে স্তব্ধ হয়ে আছেন শিরিনা জাহান। মেয়েটা যে আর নেই এই কঠিন বাস্তবতা গ্রহণ করতে পেরেছেন নাকি পারেননি তা দর্শকদের বোধগম্য হচ্ছে না। তাকে ডেকেও কেউ সাড়া পাচ্ছেন না। মেয়ে হারানোর শোকে হয়ত তার বাকশক্তি হারিয়ে গেছে। তিনি তাকিয়ে রয়েছেন মেয়ের দিকে নির্নিমেষ, চোখের পলকও পড়ছে না।
" আপা আপনে এবার সরেন, মাইয়ার লাশ তো পরে শক্ত হইয়া যাইবো। " মহল্লার জনৈক মহিলা উক্তিটি করলেন।
" এই কে বলেছে আপনাকে আমার মেয়ে নেই? কেউ বলেছে? আমার মেয়ে ঘুমাচ্ছে আপনারা বেরিয়ে যান। " মুহূর্তেই রণচণ্ডী রূপ ধারণ করে চিৎকার করে উঠলেন শিরিনা। মাত্রাতিরিক্ত রাগে তার শরীর কাঁপছে। স্বামী হাবিব সাহেব এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে ধরতে চাইলেন, কিন্তু শিরিনা এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিলেন। চিৎকার করে বললেন,
" তুই ছুবি না আমাকে? তোর জন্য আমার মেয়েটা আজকে নেই। তুই অমানুষ। "
এটুকু বলে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের লাশের সামনে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সবাই নিশ্চুপ হয়ে একজন সন্তানহারা মায়ের হৃদয়বিদারী আর্তচিৎকারের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে রইল। অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে অলক্ষ্যে, অগোচরে ফোটা কয়েক অশ্রু বিসর্জন করছে। সে এক হাহাকার! এক পর্যায়ে জ্ঞান হারালেন শিরিনা। সেই সুযোগে মৃত্তিকার লাশ সরিয়ে নেয়া হলো। তাকে গোসল করানো শেষ, কাফন পরানোটাও সম্পন্ন, এখন শুধু দাফন কার্য বাকী।
বছর তিনেক পর,
" আমার আম্মু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। তার জুড়ি মেলা ভার। তিনি ছাড়া আমার পৃথিবী তথা অবনী শূন্য, নিস্তব্ধ, নিস্তেজ সর্বোপরি জঘন্য। মামণি বড্ড ভালোবাসি আপনাকে, তবে মুখ ফুটে বলতে আমি অসমর্থ, অক্ষম। তাই আমার অসময়ের সঙ্গী, আপনার দেয়া উপহার, আমার ভালোবাসার ডায়েরির শুরুটায় আপনাকে নিয়ে আমার মনে জমানো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিদের লিপিবদ্ধ করছি। এই প্রথম পাতার সকল লেখা আপনার চরণে উৎসর্গ করলাম আম্মু। এই ডায়েরির খোঁজ আমি দিয়ে রাখব, তবে আমার বর্তমানে কখনো তাতে হাত লাগাবেন না। যদি কখনো আমি না থাকি, আমার অবর্তমানে এগুলো পড়বেন আর অনুভব করবেন আমাকে। আর লিখব না কেমন জগাখিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে যেন!
মামণির রাজকুমারী
মৃত্তিকা (মাটি) ~ ২০শে জুলাই "
ডায়েরিতে লেখা আত্মকথার এটুকু পড়তেই নিঃশ্বাস আটকে আসছিল শিরিনা জাহানের। এই লেখাটুকু যে তিনি কতবার পড়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। আজ তিনটা বছর অতিক্রম হলেও কন্যা হারানোর দুঃসহ অতীত আজও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তিনি ঘুমাতে পারেন না, বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করতেই মেয়ের হাসিমাখা মুখের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে আর কানে বাজতে থাকে মেয়ের মিষ্টি সুরের "আম্মু" ডাক। সব কিছুই চলছিল আর পাঁচটা স্বাভাবিক পরিবারের মতো। দিন কাটছিল হাসি, আনন্দে। কিন্তু হঠাৎ আধারে বিষণ্ণতার চাদরে ছেয়ে গেল শিরিনা জাহানের নিজ হাতে গড়া সুখনীড়ের প্রতিটি মানুষের হৃদয়। হঠাৎ চাকরি হারালেন হাবিব সাহেব। সঞ্চয়ে থাকা টাকা পয়সাতে বেশ সাচ্ছন্দে দিনানিপাত করলেও এক সময় তা ফুরিয়ে গেল। এসবের কিছুই জানতেন না শিরিন বেগম ও তার একমাত্র কন্যা মৃত্তিকা। কিন্তু অর্থাভাবে পরিবারে সবটা জানাতে বাধ্য হন হাবিব সাহেব। চাকরি বাজারের হাহাকার দশার কারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে, পরিবারসহ চরম অনিশ্চয়তায় পড়েন হাবিব সাহেব। মৃত্তিকা বুদ্ধিমতী, তাই সে বাড়তি খরচ কমাতে প্রাইভেট পড়া ছেয়ে দেয়। যাতে অন্তত কিছু টাকা হলেও বেঁচে যায়। সবে সে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল। স্বপ্নেরা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল মনের গহীনে। সব ভুলে দারিদ্রতায় পূর্ণ জীবনকে হাসি মুখে বরণ করে নেয় সে। তবে মা, বাবার মাঝে রোজ রোজ অশান্তি দেখে তার হৃদয়ে হতো বিষাদের রক্তক্ষরণ। তার উপর দেশে এক বিভীষিকাময় অবস্থা, করোনার সংক্রমণে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। নিত্য অশান্তি, অভাব, অনটন যেন ডাল ভাতের মতো সহজলভ্য হয়ে পরেছে। এসব ঘটনাই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ফেলছিল বিরাট প্রভাব। মেয়েটা যে তার মাঝে কী পরিমাণ যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে রেখেছিল, তা কেউ জানে না। হাসি মুখে বাবা, মায়ের সাথে কথা বললেও তারা প্রত্যুত্তরে মেয়েকে করেছেন শুধুই তিরষ্কার। মৃত্তিকাকে শিরিনা বেগম ভালোবেসে মাটি ডাকতেন। মাটি তো তীব্র খরায় ফেটে চৌচির হয়ে যায়, ঠিক তেমনি মৃত্তিকার হৃদয়ও যত্নের অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেছিল। মৃত্যুর আগের দিন হাবিব সাহেব মেয়ের সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করেছিলেন। কোমল মন তা নিতে পারেনি, রাতেই হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় মৃত্তিকার। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয় সে দু'হাতে। তবে মায়া কাটানোর পূর্বক্ষণে অসময়ের সঙ্গী ডায়েরিতে কিছু আক্ষেপের বাণীকে লিপিবদ্ধ করেছিল সে। সেই পাতাটি ছিল মৃত্তিকার লেখা শেষ আত্মকথা, যার অবস্থান ডায়েরির ৩১শে ডিসেম্বর তথা শেষ পাতা।
" আহা জীবন, বড়ই বিচিত্রময়ী জীবন। হাজারো প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির গল্পগাথা। আমার লিখতে গিয়ে হাত কাঁপছে, লেখা জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ জলে ভরে উঠছে। এমনটা কখনো হয়নি। তবে আজ কেন হচ্ছে? রোজ আল্লাহর কাছে নামাজে বসে মোনাজাতে চেয়েছি একটু শান্তি নতুবা আমার যেন মৃত্যু হয়। আল্লাহ হয়ত আমার দোয়া কবুল করবেন। কেন যেন মনে হচ্ছে এটাই হতে চলেছে আমার শেষ লেখা। শ্বাস আটকে আসছে, বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। আজকে আব্বু বললেন, আমি নাকি বসে বসে শুধু খাই, এতে অনেক টাকার অপচয় হয়। আচ্ছা আমার তো কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। আমি কী করে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হতে পারি? যেই আব্বু কোনো দিন আমাকে বকা দেননি, সেই আব্বুর মুখে এসব কথা আমি নিতে পারছি না। বিষাক্ত তীরের মতো কথাগুলো বুকে যেন করছে আঘাত। আম্মু তো আব্বুর উপরে সৃষ্ট অভিমান থেকে আমায় পর করে দিয়েছেন। আজকাল আমায় দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেন, একটা কথাও বলেন না। ভালোবেসে বুকে আগলে নেন না। তো এই বিষণ্ণ অবনীতে আমি কিসের আশায় বেঁচে থাকতে চাইব? আর ভালো লাগছে না, চোখে ঝাপসা দেখছি সব। ঘুমাতে চাই শান্তির ঘুম, তবে আত্মহত্যা আমি করব না। প্রত্যাশা করব আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন। (আমিন)
মৃত্তিকা (আজ আর মাটি লিখলাম না, আম্মু তো আর ডাকেন না মাটি বলে)
~ ১.৪২মিনিট
এরপর সে ঘুমিয়েছিল অনন্তকালের ঘুম। ঘুমের মাঝে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে মৃত্তিকার। অত্যধিক বিষণ্নতা, মানসিক চিন্তাই তার মৃত্যুকে তরান্বিত করেছে। আজ মেয়ের লেখা ডায়েরির প্রথম ও শেষ পাতা আবারও পড়ে কান্নায় বুক ভাসালেন শিরিনা। সেদিন মেয়েকে হারিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, মেয়ের মনের গহীনে চাপা আর্তনাদ। হাবিব সাহেবের সাথেও সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন সেদিন থেকেই, একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও তাদের মাঝে যোজন যোজনের দূরত্ব। দিন কাটে তার স্মৃতিচারণ করে। মেয়ের সাথে তারও ধারণা জন্মেছে বিষণ্ণ এই পৃথিবী, বিষণ্ণ অবনী। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে ফোটা কয়েক অশ্রু বিসর্জনের মাধ্যমে মৃত্তিকাকে খুঁজে ফেরেন তিনি। হাবিব সাহেব অসহায় চোখে স্ত্রীকে মুষড়ে পড়তে দেখেন শুধু।
_________
সমাপ্তি
লেখনীতেঃ নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা