চিকিৎসক ও লেখক

ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “এই, এই, তোমাদের কারো কাছে লিটম্যান আছে? আমাকে একটা দাও তো! পরীক্ষা শেষে ফেরত দিচ্ছি!”

আমার বন্ধুদের কারো ব্যাগে লিটম্যান স্টেথোস্কোপ নেই। অগত্যা ব্যাগ থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে স্টেথোস্কোপটা বের করে এগিয়ে দিতে হলো। 

ব্যাগ থেকে বের করতে যতটুকু দেরি, ছেলেটার ছোঁ মারতে দেরি হলো না। একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলো না! আশ্চর্য! এইজন্য লোকের উপকার করতে হয় না।


আমার প্লেসমেন্ট এখন মেডিসিন ওয়ার্ডে। ফিফথ ইয়ারের ক্লাস চলে। অবশ্য আজকে ক্লাস বন্ধ। ওয়ার্ডে আজকে ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা চলছে। দূর থেকে দেখছি, পরীক্ষা হচ্ছে। সিনিয়র ভাই-আপুরা পরীক্ষা দিচ্ছে, টেনশনে ঘামছে, স্যাররা বেডে বেডে ঘুরে লং কেইস নিচ্ছেন। পুরো ওয়ার্ডের সবাই পরীক্ষা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায় আজকে আমাদের ক্লাস নেবার মতো কেউ নেই। পরীক্ষার জায়গাটা একটা সাদা পর্দা ঘিরে আলাদা করে দেয়া আছে। তার ফাঁকফোকর দিয়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, আমরা সেইটা দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এক কোণায় জটলা করে আছি, মানে ছিলাম আর কী। এর মধ্যেই সেই পর্দা ফুঁড়ে ছেলেটার আগমন, আবার স্টেথোটা হাতে নিয়েই সেই পর্দার আড়ালে অন্তর্ধান। বোঝা গেলো, ভদ্রলোক ফাইনাল প্রফ দিচ্ছেন। পুরোপুরি ভদ্র বলা যাচ্ছে না, ভদ্র হলে ‘থ্যাংকস’ অন্তত বলতো। আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ফাইনাল প্রফ পরীক্ষার্থী যখন মেডিসিন পরীক্ষায় স্টেথো আনতে ভুলে যায়, তখন তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে স্বাভাবিক। সে তখন ভদ্রতার ধার ধারবে না এটাও স্বাভাবিক। তাই তার ওপর যতটুকু মেজাজ খারাপ করা উচিত, ততটুকু মেজাজ খারাপ করতে বাঁধছে। আমার তাই নিজের ওপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে!


আমার ওয়ার্ড শেষ হয়ে গেছে দুপুর বারোটায়। পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। কাজেই, আমি আমার স্টেথো এখনও ফেরত পাইনি। এদিকে লেকচার ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমার বন্ধুরা উসখুস শুরু করে দিয়েছে। আমার জন্য তাদের ক্লাস মিস হয়ে যাচ্ছে। আমি ওদের বললাম চলে যেতে। আজকে আমার ক্লাস মিস হবে, ধরেই নিয়েছি আমি। ওরা চলে যাবার পর বসে রইলাম আরো দুই ঘণ্টা। পরীক্ষা আর শেষ হয় না। ক্লান্ত হয়ে ডেস্কে মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবো না। ডেস্কের ওপর খটখট শব্দ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসতেই দেখি, শ্রীমান দাঁড়িয়ে আছেন স্টেথোস্কোপসহ। হাসিমুখে বললেন, “সরি! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম। এই যে তোমার স্টেথো। থ্যাংক ইউ সো মাচ!”

আমি এই কথার উত্তর দিলাম না। সকাল দশটায় ওয়ার্ডে ঢুকেছি, এখন বাজছে আড়াইটা। এই সাড়ে চার ঘণ্টায় দুইটা ক্লাস মিস হয়েছে, ক্ষুধায় পেট জ্বলছে- আর এই লোক বলতে এসেছে সরি? এক সরিতে সব পুষিয়ে দেবে?

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম, “ফাইনাল প্রফ দিতে কেউ স্টেথো ছাড়া আসে নাকি?”

সে কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “আসে না, আমারও এমন ভুল হয় না কখনও। আজকে কীভাবে কীভাবে হয়ে গেছে।”

আমি মুখ বাঁকা করে উত্তর দিলাম, “আপনার এমন ভুল হয় না মানে কী? প্রতিদিন একবার করে মেডিসিন পরীক্ষা দেন নাকি?”

সে হো-হো করে হেসে বললো, “আমি খুবই দুঃখিত। নিশ্চয়ই তোমার দুপুরে খাওয়া হয়নি? চলো আমার সাথে, লাঞ্চ করবো বাইরে।”

চিনি না জানি না একজন আমার স্টেথো নিয়েছে বলে বিনিময়ে আমি তার কাছে লাঞ্চ দাবী করবো, এতোটা ছোটলোক আবার আমি নই। কিন্তু এই লোক কোনো কথাই শুনছে না। রীতিমতো জোর করে নিয়ে গেলো কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া শেষে একটা রিকশাও করে দিলো। খেয়েদেয়ে রিকশায় করে অনেকখানি এগিয়ে আসার পরে মনে হলো, এই যা! লোকটার নাম তো জানা হলো না!


*

আজকে আমার ফাইনাল প্রফ পরীক্ষার ভাইভা শুরু। মেডিসিন দিয়েই শুরু হয়েছে। এতোদিন নাক-মুখ বইয়ে গুঁজে অনেক পড়েছি, কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠামাত্র আমি বুঝতে পারলাম, আমি সব ভুলে গেছি। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর মনে করার চেষ্টা করলাম, কিছুই মনে পড়ছে না। আমার হঠাৎ করে গা গুলিয়ে বমি এলো। বেসিন ভাসিয়ে বমি করার পর টের পেলাম, এবার আমার পেট ব্যথা শুরু হয়েছে। পরীক্ষার আগে আমার একটু-আধটু নার্ভাস সবসময়ই লাগে, আজকে একদম মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। রুমমেটরা কোনোমতে আমার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে-গাছিয়ে দিয়ে আমাকে ধরে ধরে ওয়ার্ডে নিয়ে গেলো। 


ওয়ার্ডে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম ঠিকই, কিন্তু যখনই রেজিস্ট্রার স্যাররা রোগী ভাগ করে দেয়ার জন্য লটারি করা শুরু করলেন, আমার পেট ব্যথার তীব্রতা বাড়তে শুরু করলো। সাদা রঙের পর্দাটা টেনে যখন পরীক্ষার জায়গাটা আলাদা করে দেয়া হলো, আমি টের পেলাম, আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে শুরু করলাম। আমাকে দেখে এখন যে কেউ বলবে, এই মুহূর্তে ডাঙায় তোলা একটা বোয়াল মাছ আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! আমি খপ করে আমার পাশে বসা বান্ধবীর হাত ধরে বললাম, “আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।”

শুরু হয়ে গেলো হইচই। প্রফ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্যানিক অ্যাটাক হতে দেখে স্যাররা অভ্যস্ত। তাঁরা এসে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বোঝালেন, “এটা কোনো জীবন-মরণ পরীক্ষা না। জাস্ট যাবা, এক্সাম দিবা, চলে আসবা!” আমি তাদের কথা শুনি, মাথা নাড়ি আর হাঁ করে শ্বাস নিই। 


এদিকে পরীক্ষা শুরুর সময় চলে এসেছে। আমাকে নিয়ে সবাই বসে থাকলে চলবে না। আমার বন্ধুরাও নিজেদেরকে নিয়ে ভেবেই কূল পাচ্ছে না, এর মধ্যে আমার এই ঝামেলা কীভাবে সামলাবে তারা! একসময় আমি তাদের বলতে বাধ্য হলাম, “স্যারদের জানা, আমার নেবুলাইজেশন লাগবে!”

তারা ছুটোছুটি করে স্যারদের জানাতে গেলো। নেবুলাইজেশন পরীক্ষা চলাকালীন দেয়া সম্ভব হবে না। ওয়ার্ডের মেশিন একটাই, সেখানে বসে এক সিওপিডির রোগী নেবুলাইজেশন নিচ্ছে। রোগীর নেবুলাইজেশন শেষ হলে আমাকে নিতে হবে। আমাকে বলা হলো, আমার জন্য বাড়তি দশ মিনিট সময় দেয়া হবে; আমি যেন একটু অপেক্ষা করে নেবুলাইজেশন শেষে পরীক্ষা দিতে আসি। অগত্যা আমি ওয়ার্ডের ভেতরে গিয়ে সিওপিডি চাচার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম, যথারীতি হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছি, আর দুশ্চিন্তায় আমার ঘাম হচ্ছে, এই বুঝি পরীক্ষাটায় ফেইল হয়ে গেলো!


“আরে, তুমি এইখানে কেন? তুমি এক্সামিনি না? পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো তো!”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, কাঁধে স্টেথোস্কোপ আর ব্লাড প্রেশার মেশিন, হাতে একটা ফাইল নিয়ে মূর্তিমান সেই ভদ্রলোক, যিনি তার প্রফের ভাইভায় স্টেথোস্কোপ নিতে ভুলে গিয়ে আমাকে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখেছিলেন! তিনি পাশ করে ইন্টার্ন ডাক্তার হয়েছেন তাহলে!

হাঁ করে বোয়াল মাছের মতো খাবি খেতে খেতে কোনমতে বললাম, “আমার প্যানিক অ্যাটাকে শ্বাসকষ্ট হয়। একটু নেবুলাইজেশন দরকার।”

“হোয়াট! এইজন্য তুমি পরীক্ষা ডিলে করবা নাকি? দাঁড়াও দাঁড়াও!” বলেই কোথায় উধাও হয়ে গেলো কে জানে!

বিশ সেকেন্ডের মাথায় আবার উদয় হয়ে বললো, “এই নাও, ক্যানিস্টারটা ঝাঁকিয়ে দুই পাফ ইনহেলার নাও ঝটপট, নিয়ে পরীক্ষা দিতে যাও, কুইক!”

আমি ক্যানিস্টার হাতে নিয়ে থ মেরে গেছি, খাবি খেতেও ভুলে গেলাম। 

সে অভয় দিয়ে বললো, “আরে, আমার অ্যাজমা আছে। সবসময় ব্যাগে রাখতে হয়। যাও যাও, তাড়াতাড়ি করো। পরীক্ষা অর্ধেক হয়ে গেলো!”

আমি ক্যানিস্টার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বেডের দিকে এগোলাম।

পরীক্ষা দিয়ে বের হলাম নির্বিঘ্নে। বেশ ভালো হয়েছে পরীক্ষা। অতোটা নার্ভাস না হলে আরো ভালো হতো। শ্বাসকষ্টও একবার পরীক্ষা শুরু হতেই উধাও হয়ে গেছে। ইনহেলারটা হাতে নিয়ে ওয়ার্ডের মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক খুঁজছি অবতারকে, আবারও কোত্থেকে উদয় হলো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন হলো ভাইভা?”

“ভালো। থ্যাংক ইউ।”

থ্যাংক ইউ বলেই মনে পড়লো, ইনহেলারটা নেয়ার সময় তো তাকে ধন্যবাদ বলতে মনে ছিলো না। এক বছর আগে তারও নিশ্চয়ই এই অবস্থাই হয়েছিলো! শুধু শুধু বেচারার ওপর সেদিন মেজাজ খারাপ করেছিলাম। 

সে ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ফাইনাল প্রফ দিতে কেউ ইনহেলার ছাড়া আসে নাকি?”


এক বছর আগের কথা এমনি করে ফিরিয়ে দিলো! লজ্জায় মনে হলো, মাটিটা দুই ভাগ হোক, আমি ঢুকে যাই! জিভ কেটে বললাম, “লাঞ্চ অন মি? আজকে নাম জিজ্ঞেস করতে ভুলবো না!”


*

দেবজ্যোতির নাম এরপর আমি আর কখনও ভুলিনি। সেদিনের সেই লাঞ্চ শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে তিনবেলার ডাল-ভাতে। সেই দুইদিনের কথোপকথন থেকে হয়েছে অগ্নিসাক্ষী পবিত্র মন্ত্র “যদিদং হৃদয়ং তব...!” আমাদের ভাগাভাগির সংসারে সুখ আছে, দুঃখ আছে, হাসি আছে, কান্না আছে, ভালোবাসা আছে, খুনসুটি আছে। একটা স্টেথোস্কোপ আর একটা ইনহেলারের ক্যানিস্টার আমাদের দুইজনকে বেঁধে দিয়েছে সাত পাকে।


*

কোভিড ওয়ার্ডের ডিউটি রোস্টারে দেবজ্যোতির নাম দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠেছিল আমার। ছেলেটার অ্যাজমা আছে। সারাবছরই একটু আধটু কাশি, শ্বাসকষ্ট লেগেই আছে। তার ওপর ক্যারিয়ারটা করলো মেডিসিনেই। এই প্যান্ডেমিকের সময় নিজে ডাক্তার হয়ে নিজেই বা ঘরে থাকি কী করে, আর ওকেই বা আটকে রাখি কীভাবে! দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। নিজে বাঁচি বা মরি, রোগীর সেবাটুকু তো দিতেই হবে! এই গরমের মধ্যে দুইটা মাস্ক, গায়ে পুরো পিপিই পরে ডিউটি করতে করতে নিজেও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা অতো হয় না, ওকে নিয়েই যা ভয়। সে আমাকে অভয় দিয়ে বলে, “কিচ্ছু হবে না, তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না তো! এই দুঃসময় কেটে গেলে কোথাও ঘুরে আসতে হবে। এতো মৃত্যুর ভার আর নিতে পারছি না।”

***


এই প্যান্ডেমিকে অজস্র চিকিৎসক দম্পতির জীবনটা এভাবেই মোড় নিয়েছে অনিশ্চয়তার দিকে। অনেকে ফিরে এসেছেন প্রিয় মানুষ এবং পরিবারের কাছে, অনেককেই পথে হারিয়ে ফেলেছি আমরা। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তাঁদের প্রিয়জনদের, একইসাথে আমাদের চিকিৎসক সমাজেরও। লিখতে বসে এই গল্পগুলিকে অগ্রাহ্য করে যেতে পারি না। নিজের কাছেই একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায়। দেবজ্যোতি আর অরুন্ধতীর গল্পটা লেখা হয়েছে সেই ভাবনাটা থেকেই। সম্পূর্ণ গল্পটা এখানে দিলাম না, কারণ বইটা এখনও প্রকাশিতব্য। গল্প 'অক্সিজেন' থাকছে আমার চতুর্থ বই '#নিছক_গল্প_নয়' তে। পড়ার আমন্ত্রণ রইলো। বইটা প্রি-অর্ডার করতে মেসেজ দিতে হবে Satirtho Prokashona পেইজে।


লেখাঃ তাসনিয়া আহমেদ


Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]

ডিপ্রেশন

এক চালাক ব্যক্তি [ post no: 11 ]