অ-প্রেমিক
প্রিয়তমা মায়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর চোখ থেকে গড়গড় করে পানি ঝড়ছে দেখে আমার প্রচণ্ড লাগলেও আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক যেন একটা মূর্তি আমি। কত কথা বলার কথা আমার অথচ আমি চুপ।
মায়ার কান্না আমি কখনওই সহ্য করতে পারিনা। ওর সামান্য মন খারাপ বা একটু অসুস্থতা আমি মেনে নিতে পারিনা। আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগে। অথচ এই মেয়েটা আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
সুন্দর মুখটা লাল হুয়ে আছে। চোখের নিচ টা কালোরঙ ধারণ করছে। চেহারা দেখে বোঝায় যাচ্ছে কয়েকদিন ঠিকমতো খাবার খায় না। টইটম্বুর মুখখানা আর রক্তে পরিপূর্ণ হাতের আঙুল গুলো একদম শীর্ণ। মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আর কাঁদছে।
এতক্ষণে আমি মায়ার দিকে তাকালাম তারপর একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললাম।
- মায়া বাস্তবতা মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। তুমি বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে, তোমাকে যে মেনে নিতেই হবে।
- আমি আপনাকে হারাতে পারবোনা।
- মায়া তোমাকে পাবার যোগ্যতা আর তোমাকে দেবার মতো স্বামর্থ যে আমার নেই।
- আমি তো আপনার কাছে কিছুই চাইনি। শুধু আপনাকে চেয়েছি, আমার কিছুই লাগবেনা। শুধু আমাকে ভালোবেসে আপনার বুকে রাখলেই হবে।
[বলেই আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছিনা। আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম, নিজেকে সামান্য সংযত করে বললাম]
- দেখো তোমার বাবা-মা আমাকে মেনে নেইনি আমার কী করার। সবে অনার্স শেষ করলাম। এখনো নিশ্চিত না রেজাল্ট কী হবে। সেখানে তুমি ব্রিলিয়ান্ট একটা ছাত্রী। ভালো একটা স্থানে পড়ছো। আবার আমার আর্থিক অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। আগে ভাইয়া টাকাপয়সা দিতো, বিয়ের পর চেঞ্জড হয়ে গেছে। বেশ খারাপ যাচ্ছে আমাদের দিন। তুমি সব-ই জানো। এখন আমি কী করব বলো?
(মায়া চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে আছে টপটপ করে পানি মাটিতে পড়ছে)
বিকালবেলা এসেছে। এখন প্রায় সন্ধ্যা লাগবে মায়াকে বললাম ‘বাসায় চলে যাও’
আমি ওখানে বসেই ছিলাম। মায়াকে দেবার মতো কোনো কথা, বা নিজেকে বোঝানোর মতো কোনো শান্তনা বাণী আমার জানা নেই।
দুদিন পর ওর মামা আমাকে আবার ডাক দেন। আমাকে ডেকে বলে,
- মেঘ তোমাকে তুমিই বলি, আমার বাড়ির দারোয়ান কে আমি তুমি বলেই ডাকি। আজকে ওর গল্প শোনাব, বাংলাতে অনার্স করে ভেবেছিল লেখক হবে। আজ দারোয়ান হয়েছে ওর বাবা কাজ করতে পারেনা। ওর ভাই আছে তেমন টাকাপয়সা বাড়িতে দেয়না। ছেলেটা নিজেই নিজের কাজকে বেছে নিয়েছে। কাজকে ছোটো মনে করতে নেই। ছেলেটার জন্য খারাপ লাগে। ওর বেতন ১৮হাজার হলেও আমরা পুশিয়ে দেই আহারে বেচারা। আচ্ছা এখন যদি এই ছেলে আমাদের পরিবারের কোনো মেয়েকে বিয়ের স্বপ্ন দেখে কী করা উচিত বলো তো?
- মামা আজকে আমি উঠি আমার টিউশনির সময় হয়ে গেছে। ভুল করলে ক্ষমা করবেন।
রাস্তায় বের হয়ে নিয়নবাতির সাথে নিয়ে হাটছি। আজ আকাশ টা মেঘলা। অনেকদিন বৃষ্টি হয়না শহরে। আর কিছুক্ষণ হাটলেই আমার ছাত্রের বাসা। ওখানে গেলেই খাবার দেবে অন্তত রাতের খাবার টা হয়ে যাবে। মায়ার জন্য খারাপ লাগছে সামান্য। মেয়েটার কপাল খারাপ ভুল মানুষ কে ভালোবেসেছে। আর মামার গল্পের নায়কের কথা ভেবে খুব হাসি পাচ্ছে। আহারে বেচারা!
সামান্য এগোতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। এমন আচমকা বৃষ্টি হবার কথা ছিলোনা। কথা ছিলো পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে বিদ্যুৎচমকে দিয়ে তারপর বৃষ্টি আসবে অথচ তা হয়নি। প্রকৃতি বেঈমানি করেছে আমার সাথে। আমার ভাগ্যের সাথে।
বৃষ্টিতে ভিজলে মনের কষ্ট কমে। আমার মনে অনেক কষ্ট জমে আছে। আমার বুকের ভেতর যে কষ্টটা জমা হয়েছে তা ধুয়েমুছে ফুটপাতের ধূলোজমা ডাস্টবিনে জমা হোক। এই শহরের ইট কাঠ আর কংক্রিটের ভেতরে থাকা মানুষ গুলো ভালো থাক। মায়া আমাকে তুমি ভুলে যেও। ভালো থেকো।
লেখাঃ স্বপ্নীল মেঘ