দূর পাহাড়ের সন্ধানে
এ্যাই পিটু!ওঠ না জলদি।দেখ বাইরে দেখ কি সুন্দর জোঁছনা!
পিটু ছোখ মলতে মলতে ওঠে পড়লো ঘুম থেকে।ইদানীং বাবার পাগলামি বেশ বেড়েছে।রাত বিরাতে ছাদে ঘোরাফেরা করেন।
এখন মধ্যরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছেন। পিটুর সাথে এই জোঁছনার আলোতে কফি খাবেন।ব্রাজিলিয়ান কফি।তারপর পিটুকে গল্প শোনাবেন।যদিও পিটু খুব বিরক্ত।কিন্তু পিটু জানে বাবার পাগলামি আর ভালোবাসার কাছে একটু পরই তার বিরক্তি হার মানবে।
একবার হয়েছে কি!পিটুর বেশ সর্দি হলো।বুকে কফ বসে গিয়ে গড় গড় করে আওয়াজ করছে।পিটুর মা বেশ চিন্তিত।ইতিমধ্যে কয়েকবার ডাক্তার এসে চেকআপ করে গেছেন।কিন্তু পিটুর বাবা নির্বিকার।পিটুর মা যখন বকাঝকা শুরু করলেন তখন পিটুর বাবা মবিন সাহেব হ্যাঁচকা টানে পিটুকে বিছানা থেকে তুললেন।তারপর কাধে করে নিয়ে বের হয়ে গেলেন।পেছনে পিটুর মা রেহানা বেগম চিল্লাচিল্লি করছেন।সেদিকে মবিন সাহেবের কোনো খেয়াল নেই।
বাপ বেটা মিলে সাত মাইল হাটলেন।পিটু এখন বেশ ক্লান্ত।সে বললো,বাবা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি ভেবেছি তুমি আমাকে কাধে করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছো!কিন্তু তোমার সাথে বের হয়ে তো জানটাই যাবে বোধয়!!হাটতে হাটতে প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে।
মবিন সাহেব বললেন,ধূর ব্যাটা।তোর এই সর্দির আবার হাসপাতাল কিরে!তবে হ্যাঁ। তোকে সাতমাইল দূরে এনেছি বিশেষ এক চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্যে।
পিটু বাবার সাথে একটা ছোটখাটো পাহাড়ে ওঠে গেলো।তারা অবশ্য চা বাগানে থাকে।মবিন সাহেব ঐ বাগানের সরকারি কর্মকর্তা।পাহাড়ে ওঠার পর পিটু দেখলো বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা মিন্টুর স্পেশাল চা!
বাবা বললেন এখানে টুলটাতে বোস।আগে কখনো পাহাড়ের উপর বসে চা খেয়েছিস??
পিটু আগ্রহভরে জবাব দিলো খায়নি।
মিন্টু খুব স্পেশাল করে দুটো চা দাও তো।আর এটা হল পিটু।আমার ছেলে।এখন থেকে তোমার নিয়মিত ক্রেতা।
মিন্টু পিটুর দিকে তাকিয়ে বেশ আন্তরিক একটা হাসি দিলো।
বাবা বললেন শোন পিটু।পৃথিবীতে যদি সেরা কোনো তরল পদার্থ থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই সেটা হল মিন্টুর এই স্পেশাল চা।
সেই মিন্টুর স্পেশাল চা খেয়ে পরদিন পিটু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলো।ব্যাপারটা কীভাবে হলো তা পিটুর মাথায় ঢুকলো না।বাবাকে জিজ্ঞেস করাতে বাবা বললেন এটা হল ম্যাজিক।মিন্টুর স্পেশাল লেবু চায়ের ম্যাজিক। বলেই বাবা হাসলেন।
বাবার সাথে পিটু হাটছে।বাবার মন খারাপ।একদিন আগে পিটুর মায়ের সাথে বেশ ঝগড়া হয়েছে।পুরো চব্বিশঘন্টা পার হয়ে গেলো কিন্তু পিটুর মা তার বাবা মবিন সাহেবের সাথে একটা কথাও বলেননি।বাবার মন খারাপ তাই পিটুরও মন খারাপ।কিছু একটা তো করতেই হবে পিটু ভাবছে!
বাবা!বুদ্ধি পেয়েছি।তুমি একটু দাড়াও আমি আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো।আমি ঘরে গেলাম।
চুপি চুপি পিটু ঘরে ঢুকলো।মা তখন বিছানায় শুয়ে আছে।পিটু একটা খাতা আর কলম নিয়ে লিখতে বসেছে।
৯ বছরের পিটু মা কে চিঠি লিখছে,
প্রিয় মা
আমি পিটু বলছি।আমার বাবা মবিন সাহেব নির্দোষ।যদি দোষ থাকেও তাহলে আমরা গতকাল থেকে তোমার পেছন পেছন ঘুরছি আপোষ করার জন্যে। তুমি আমাদের পাত্তা দিচ্ছ না।বাবা নাকি তোমার উপর অনেক অনেক বিরক্ত।বাবার নতুন জায়গায় পোস্টিং হয়েছে।জায়গার নাম তোমাকে কেনো বলবো?আমরা আজ সেখানে চলে যাচ্ছি।তুমি নানুর বাড়ি চলে যাবে।আর কখনো দেখা হবে না।বাড়ির সবকিছু তোমাকে দিয়ে গেলাম।
ইতি
তোমার স্নেহের
পিটু
পিটু চিঠিটা মার চোখে পড়ে এমন জায়গায় রাখলো।তারপর পুরো প্ল্যান বাবাকে জানিয়ে বাপবেটা দুদিনের জন্যে গায়েব।তাদের কোনো খোঁজ নেই।
রেহানা বেগম পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন।টেবিলের ওপর দেখা গেলো পিটুর চিঠি।সেটা পড়েই বাচ্চাদের মত কান্না শুরু করে দিলেন।সব জায়গায় তড়িঘড়ি খবর দিলেন।এমনকি থানায় মিসিং কেস পর্যন্ত হলো।কিন্তু মবিন সাহেব আর পিটুর কোনো পাত্তা নেই।সবশেষে বিরতিহীন ভাবে কাঁদতে লাগলেন।
একটু পর ঘরে টিভির আওয়াজ শুনে চমকে ওঠলেন।তিনি তো টিভি ছাড়েন নি।তাহলে শুধু শুধু টিভি চলছে কেনো?
টিভি রুমে ঢুকেই রেহানা বেগমের মুখ হা হয়ে গেলো!!বাপ বেটা বসে দিব্যি পপকর্ন খাচ্ছে। টিভিতে চলছে বিখ্যাত সেই মনপুরা ছবি।রেহানা বেগম মিনিট দুয়েক ধরে স্তব্ধ।বাপবেটা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।
তারপর পিটু আর তার বাবা মবিন সাহেব গিয়ে রেহানা বেগমকে জড়িয়ে ধরলেন।রেহানা বেগম কাদঁছেন।অনেক্ষণ সময় ধরে কান্না পর্ব চললো।আর ততক্ষণ মবিনুর রহমান স্ত্রীকে জড়িয়ে রেখেছেন নিজ বুকে।
সপ্তাহখানেক পর মাঝরাতে মায়ের প্রচন্ড ঝাকুনিতে পিটুর ঘুম ভাঙ্গলো।ও পিটু ওঠ না।তোর বাবা কেমন জানি করছে!
তড়িঘড়ি পিটু বাবার কাছে গেলো।বাবার চোখমুখ উল্টে গেছে।বেশ কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে।বুকে হাত দিয়ে মোচড়াচ্ছেন।বোধয় বুকে ব্যাথা।পিটু না বুঝেই বাবার বুক মালিশ করতে লাগলো।ও বাবা ও বাবা তোমার কি হয়েছে??তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে?বলে পিটু কাঁদতে লাগলো।
বাবাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।তিনদিন ধরে পিটুর বাবা মবিন সাহেব লাইফ সাপোর্টে।জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।রেহানা বেগমের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।সুযোগ পেয়ে পিটু বেশ ভয়ে ভয়ে আই সি ইউ রুমে ঢুকলো।বাবার বুকে বেশ গড়গড় করে শব্দ হচ্ছে।পিটু অনেক্ষণ ধরে বাবাকে ডাকার পরও বাবা সাড়া দিচ্ছেন না।
হাসপাতাল থেকে বের হয়েই পিটু দৌড়াচ্ছে।ছোট্ট পিটু প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।তার অশ্রুবিন্দুগুলো বাতাসের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে।পিটুকে যেতে হবে দূর পাহাড়ের উপর মিন্টুর স্পেশাল চা আনতে।অবুঝ পিটু ভাবছে যদি সেই চা খাইয়ে বাবাকে ফিরিয়ে আনা যায়।
লেখকঃ আবদুল্লাহ ইবনে আলী