অন্ধকার পেরিয়ে
লন্ডনে পড়তে গিয়ে জনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে ছিলো আমার সহপাঠী। স্থানীয় ছেলে। পড়ার চাইতেও তার ঝোঁক ছিলো বেশি শিকারের প্রতি। তার বাবার কাছ থেকে এ ঝোঁক সে পেয়েছে। তার বাবা ছিলো নাম করা শিকারী। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গলে শিকারে গিয়ে সেও শিকারের নেশায় পড়ে যায়। মাত্র বিশ বছর বয়সে সে প্রথম সিংহ শিকার করে। সে ছিলো এক ভয়াবহ ঘটনা। অবশ্য জনের জন্য নয়।
জন বলেছিলো,"হায়দার ঘটনাটি ঘটেছিলো মধ্য আফ্রিকার এক জঙ্গলে। আমি আর সিংহ মুখোমুখি। মাঝখানে পনের গজের মতো দূরত্ব। আমার দলের সঙ্গীরা পেছনে। সেদিন বাবাও ছিলো সঙ্গে। বাবা বললো,'জন পারবে তুমি? না পারলে পিছিয়ে এসো।' আমি শীতল কণ্ঠে বাবাকে বললাম,'তুমি ভুলে যাচ্ছো কেনো, আমি যে তোমার ছেলে। পিছিয়ে যাওয়া আমাদের রক্তে নেই। বাবা বললো,'সাবাস বেটা।' আমি স্থির চেয়ে আছি সিংহটার দিকে। সিংহটা চেয়ে আছে আমার দিকে। ওর শরীরের ভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে কোনো সময় ও আমার দিকে দৌড়াতে শুরু করবে। আমার হাতে হান্টিং রাইফেল। আমি ধীরে রাইফেলটি দু হাতে ধরে ওটার দিকে তাক করলাম। আমার পরিকল্পনা হলো, ওটা যখন আমার দিকে তেড়ে আসবে তখন আমি গুলি ছুঁড়বো। আমি স্থির হয়ে নিশানা ঠিক করে ওটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সিংহটা কিছুক্ষণ গরগর শব্দ করলো গলার ভেতর। একটু একটু করে দাঁত বের করতে লাগলো। ওটার শরীর টান টান হতে লাগলো। অর্থাৎ আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন করে তীব্র গতিতে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। হায়দার এমন পরিস্থিতিতে আনাড়ি শিকারীর কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। আর সাধারণ মানুষ তো এমন পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতেও ভয় পাবে। হায়দার তুমি আমার জায়গায় হলে কী করতে?"
আমি চোখ বড়ো বড়ো করে ওর কাহিনী শুনছিলাম। ওর প্রশ্ন শুনে ঢোঁক গিলে বললাম,"নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেতাম। আচ্ছা আমার কথা থাক। এরপর বাকিটা বলো।"
জন তারপর বললো,"সিংহটা উন্মাদের মতো ধুলো উড়িয়ে তেড়ে আসতে লাগলো আমার দিকে। আমি এক চুল না নড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম রাইফেল হাতে। আমার চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপলো না। ওটা কাছাকাছি আসতেই চাপ দিলাম ট্রিগারে। ব্যাং..! সঙ্গে সঙ্গে ওটা আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো। গুলিটা লেগেছে একেবারে ওর খুলিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিংহটা নিশ্চল হয়ে গেলো। হায়দার এরপর থেকে একের পর এক বড়ো অভিযানে গেছি। সামনে আরো যাবো। এ এক মাতাল করা টান হায়দার।"
বললাম,"এই নির্দোষ পশুগুলোকে হত্যা করতে তোমার খারাপ লাগে না?"
"খারাপ শব্দটা আপেক্ষিক। তোমার কাছে যেটা খারাপ অন্যের কাছে সেটা খারাপ নাও হতে পারে। তার চেয়ে বড়ো কথা হলো, ভালো খারাপ নয়, জীবনে প্রয়োজন রোমাঞ্চ উত্তেজনা। এসব না থাকলে জীবনকে পানসে মনে হয়। বাঁচতে হবে বাঁচার মতো। টিমটিমে জীবন আমার সহ্য হয় না।"
আমি বুঝেছিলাম ও অন্য ধাতুতে গড়া। তাই ওর সঙ্গে শিকার নিয়ে আর কথা বলি নি। তাছাড়া আমার পছন্দ ছিলো না ওর শিকারের ব্যাপারটা। শুধু শুধু পশু হত্যার মধ্যে আমি কোনো বীরত্ব দেখি না।
বছর ছয়েকের মতো আমি লন্ডনে ছিলাম। এ ছয় বছরে ও বহু দেশে বহুবার শিকারে গেছে। এসে বলতো ওর শিকারের কাহিনী। বিন্দু মাত্র মায়া মমতা ওর মধ্যে ছিলো না। ও যখন শিকারের গল্প করতো তখন পরিষ্কার টের পেতাম ওর মধ্যে যেনো জেগে উঠতো এক পশু। প্রথম কয়েকবার শোনার পর আমি আর আগ্রহ বোধ করি নি ওর পশু হত্যার গল্প শুনতে।
একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম,"পশু হত্যা করে লাভ কী? শুধু কি রোমাঞ্চ উত্তেজনার জন্য এটা করো, নাকি নাকি অন্য কোনো কারণও আছে?"
জন প্রশ্নটার জবাব দেয় নি। কিন্তু পরে আমি আরেকজনের কাছ থেকে জেনেছিলাম জন অবৈধ পশু ব্যবসার সাথে জড়িত। ওর বাবাও তাই ছিলো। এসব নিয়ে কখনো ওর সাথে কথা বলি নি। এতে ওর ক্ষেপে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। শেষে কী হতো বলা মুশকিল। আমি তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা মানুষ। এমনিতে ওরা আমাদের পছন্দ করে না। ওদের রাগ আরো বাড়ুক এটা আমি চাই নি। তাই জনের গোপন অবৈধ কারবার নিয়ে কোনোদিন মুখ খুলি নি। আমি এখানে পড়তে এসেছি। পড়া শেষ করে দেশে চলে যাবো। এর মধ্যে অন্য কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই নি।
লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর জনের সাথে আমার আর যোগাযোগ হয় নি।
এরপর পনের বছর পর জনের সাথে আমার পুনরায় দেখা হয় দিল্লিতে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম একটা বিজনেস ট্রেইনিং প্রোগ্রামে ট্রেইনার হিসেবে। আর ও দিল্লিতে গিয়েছিলো ওর প্রতিষ্ঠানের কাজে। ওর প্রতিষ্ঠান কী, কী নিয়ে কাজ করে, জেনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ওর প্রতিষ্ঠানের নাম 'আন্তর্জাতিক পশু রক্ষণ সংস্থা'। ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে পশু রক্ষণের ব্যাপারে প্রচারণা চালায়। সামনে সে বাংলাদেশে আসবে। আমি কোনো ভাবে বুঝতে পারছিলাম না, ওর এই পরিবর্ত হলো কী করে? যে মানুষটা ঠান্ডা মাথায় পশু হত্যা করতো তারপর সেটা কালো বাজারে বিক্রি করতো, সে কী করে আজ পশু রক্ষণের জন্য নিরলস কাজ করছে? আরো জানতে পারলাম, পশুদের জন্য যাতে বাধাহীন কাজ করতে পারে, এজন্য সে বিয়ে পর্যন্ত করে নি।
এক রোববার সন্ধ্যায় আমরা এক ক্যাফেতে বসেছি।
আমি কোনো ভাবে কৌতূহল দমাতে না পেরে জনকে জিজ্ঞেস করলাম,"তুমি কি আমাকে বলবে তোমার এই বদল কী করে হলো? পশু হত্যাকরী থেকে পশু রক্ষাকারী কীভাবে হলো এটা?"
জন মুচকি হাসলো।
বললো,"আমি জানতাম তুমি আমাকে এ প্রশ্ন করবে। হায়দার আমি বিভিন্ন জায়গায় আমার এই পরিবর্তনের গল্পটা বলেছি। একটি মাত্র ঘটনা আমাকে সম্পূর্ণ বদলে দিলো। এক সকালের একটি ঘটনা। গল্পটি আমি এ পর্যন্ত হাজারবার বলেছি। কিন্তু আজো যখন ঘটনাটি বর্ণনা করি আমি শিউরে উঠি। আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।"
আমি গাঢ় আগ্রহ নিয়ে জনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
জন বলতে লাগলো,"তুমি দেশে চলে যাওয়ার পর আমি আরো বছর পাঁচেক শিকারের সঙ্গে হরদম যুক্ত ছিলাম। তুমি তো জানোই, আমি শুধু পশু হত্যা করতাম না, ওগুলো কালো বাজারে বিক্রিও করতাম। প্রচুর আয় হতো আমার। একবার বল্গা হরিণ শিকার করার জন্য গেলাম কানাডার উত্তরাঞ্চলে। আমরা পাঁচজনের একটা দল। সবার হাতে হান্টিং রাইফেল। এক সকালে স্থানীয় একজন গাইড নিয়ে একটা পিক আপে করে আমার রওনা দিলাম বরফে আবৃত জঙ্গলে। তুমি হয়তো ভাবছো কানাডার মতো একটা দেশে কী করে দিনে দুপুরে জঙ্গলে যাচ্ছি পশু শিকার করতে? হায়দার তোমাকে একটা কথা বলি শোনো, অবৈধ ব্যবসার নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী। সরকারের উচ্চ মহল পর্যন্ত যোগাযোগ থাকে। তাই সব ম্যানেজ করা যায়। তো আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম। বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজছি বল্গা হরিণ। যেতে যেতে এক জায়গায় দুটো পেয়ে গেলাম। একটা ছেলে একটা মেয়ে। পিক আপকে সুবিধাজনক জায়গায় রেখে আমি তাক করলাম নিশানা। আমার দক্ষ হাতের গুলি মিস হয় না কখনো। পরপর দুটো গুলি ছুঁড়লাম। মেয়ে হরিণটা জায়গাতেই মারা গেলো। ওটার মাথায় গুলি লেগেছিলো। কিন্তু পুরুষ হরিণটার গুলি লাগলো পায়ে। ওটা এক দৌড়ে ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়লো। ওটাকে আর খুঁজে পেলাম না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে মৃত হরিণটাকে পিক আপে তুললাম। তারপর আরো কয়েকটা হরিণ মেরে আমরা যখন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ঘটলো আশ্চর্য সেই ঘটনা। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, পায়ে গুলি লাগা পুরুষ হরিণটি হঠাৎ একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমাদের চলন্ত পিক আপের পেছন পেছন প্রচণ্ড দৌড়াতে শুরু করলো। আহত পা নিয়ে কী করে এতো দ্রুত দৌড়ানো সম্ভব বুঝতে পারলাম না। প্রথমে ধরতে পারি নি এটা কোন হরিণ? আর কেনই বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোঁড়া পা নিয়ে আমাদের মতো খুনে শিকারীদের গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে? কিন্তু একটু খেয়াল করতেই আমরা হরিণটাকে চিনতে পারলাম। আমরা যে ওর মেয়ে সঙ্গীটাকে নিয়ে যাচ্ছি, এটা ও মেনে নিতে পারছে না। ওটা জানে যে, আমাদের পিক আপে ওর সঙ্গিনী রয়েছে। যদিও মৃত। কিন্তু ওটা তো আর মৃত বোঝে না। তাই ওটা ছুটছে আর ছুটছে। আমি বন্দুক তুলেছিলাম ওটাকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু ওটার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি থেমে যেতে বাধ্য হই। জীবনে এই প্রথম আমি কোনো পশুর দিকে গুলি ছুঁড়তে পারি নি। হায়দার তুমি বিশ্বাস করবে না, কী প্রবল আকুতি, বিষাদ আর বিশুদ্ধ ভালোবাসা ওটার দু চোখে ছিলো! আহত পা থেকে রক্ত ঝরছে। তবু ওটা প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে তার সঙ্গিনীর জন্য। আমার দলের কেউ কেউ বন্দুক তুললে আমি তাদের নিষেধ করি। তুমি ভাবতে পারো হায়দার, কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকলে একটা প্রাণী রক্তাক্ত পা নিয়ে মরে যাওয়ার ভয় উপেক্ষা করে খুনে শিকারীদের গাড়ির পেছনে দৌড়াতে পারে? আমি যখন ওকে হত্যা করার জন্য বন্দুক তাক করেছিলাম, ও তবু থামলো না। ও তবু খোঁড়া পা নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। ওটার চোখে মৃত্যুর কোনো ভয় ছিলো না। ছিলো শুধু ভালোবাসা। মৃত্যুঞ্জয়ী ভালোবাসা। আমি গোটা জীবনে এমন ব্যাকুল, বিষণ্ণ কিন্তু ভয়হীন বিশুদ্ধ ভালোবাসাময় চোখ দেখি নি। হরিণটি আমাদের গাড়ির পেছনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটছে তো ছুটছে। আমরা ভেবেছিলাম আহত হরিণটা এক সময় থেমে যাবে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ওটা শুধু দৌড়াতেই লাগলো। ঐ রক্তাক্ত ছুটন্ত ব্যাকুল হরিণটির দিকে নির্বাক পলকহীন চেয়ে থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কোনোদিন শিকারের নামে পশু হত্যা করবো না। আর কোনো পশুকে এভাবে তাদের সঙ্গী থেকে বিচ্ছিন্ন করবো না। এই সিদ্ধান্তের পরপরই আমার হাতে ধরা হান্টিং রাইফেলটি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। তারপর থেকে আর কোনোদিন আমার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ওঠে নি।"
জন থামলো। এবং কেমন নিশ্চুপ হয়ে মাথা ঝুঁকে বসে রইলো। বুঝতে পারছিলাম ঘটনাটির প্রভাব এখনো তার ওপর কাজ করছে।
আমি আস্তে করে বললাম,"ঐ আহত হরিণটার শেষে কী হলো?"
জন আচ্ছন্ন দশা থেকে নিজেকে টেনে এনে বললো,"ঐ আহত হরিণটাকে আমি শহরে নিয়ে আসি। ওটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। ওটাকে সুস্থ করে তুলি। এরপর থেকে ওটা আমার সঙ্গে আছে। ওটার নাম দিয়েছি সান্তা। এই দেখো তার ছবি।"
বলে মোবাইল বের করে সে আমাকে সান্তার ছবি দেখালো। সে আর সান্তা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। জনের মুখে হাসি। তার হাত সান্তার পিঠে।
ছবি দেখাতে দেখাতে জন বললো,"যদি কখনো লন্ডনে আসো, তাহলে আমার বাড়িতে এসো। সান্তার সঙ্গে তোমাকে দেখা করিয়ে দেবো। সান্তার চেয়ে ভালো বন্ধু এ পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।"
"আর তারপরই তুমি এই পশু রক্ষণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করলে?"
"হুম। এবং যতোদিন বাঁচবো তাদের হয়ে কাজ করে যাবো। যে অন্যায় করেছি জীবনে তার প্রায়শ্চিত্ত হবার নয়। সারাক্ষণ এক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগি। শুধুমাত্র পশুদের সাথে থাকলে এ যন্ত্রণা কিছুটা কমে। নতুবা আর কোনো ভাবে এ যন্ত্রণা কমে না।"
টেবিলে রাখা জনের হাতের ওপর হাত রেখে আলতো চাপ দিয়ে বললাম,"বহুদিন পর একজন খাঁটি মানুষের সান্নিধ্য পেলাম।"
জন বিষণ্ণ কিন্তু বিশুদ্ধ ভালোবাসাময় চোখে তাকালো। ঠিক আহত হরিণটির চোখের মতো।
লেখা- রুদ্র আজাদ