ভালোবাসার শুরু
- হ্যালো, কেমন আছুইন?
এই 'কেমন আছুইন' শুনেই কেমন যেন বিতৃষ্ণা চলে আসলো মানুষটার প্রতি। আমার সুন্দর ছেলেই পছন্দ কিন্তু তার সাথে চাই ভরাট গলা আর সুন্দর বাচনভঙ্গি। নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছে। একটা মানুষ দেখতে এত সুন্দর আর তার কথায় এমন আঞ্চলিকতা, মানতেই কষ্ট হচ্ছে। আবার ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
- হ্যালো, হুনতাছুইন না?
- হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।
- তাইলে কইয়া লাইন, কেমন আছুইন?
- আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
- আমি তো বালাই আচি। দুপুরে কি দিয়া খাইছুইন? না কি এহনো খাইছুইন না?
- না, খাই নি। খাব একটু পর।
- ও মায়া-মায়া গো, কি কইন, বেলা বাজে পরায় সাড়ে তিনডা, অহনো খাইছুইন না?
- খেয়ে নিব। আপনি খেয়েছেন?
- হুম, আমি খাইছি। কি দিয়া খাইবাইন?
- জানি না। রান্নাঘরে যাই নি। আম্মু কি রান্না করেছে জানি না। আপনি কি দিয়ে খেয়েছেন?
- ভাত, চ্যাপা ভর্তা, মুরগীর সালুন আর মাশের ডাইল দিয়া। আফনেরে দেইখা তো বাচ্চা পোলাপান মনে অয় না, তয় যে মায়ে কি রানছে তাও কইতে পারলেন না।
- পিঞ্চ কেটে কথা বললেন? রান্নাঘরে যাই নি বলে ঘরের কাজে হাত দেই না ব্যাপারটা এমন না। আমি ঘর গুছিয়েছি।
- ও, তাই কইন। আমি আবার ভাইবা বইয়া আচি আইন্নে ঘরের কাম কাইজে কোন খেয়াল রাহুইন না।
- না, ব্যাপারটা আসলে এমন না। অনেকদিন ধরে আপনার সাথে ফেসবুকে পরিচয়, চ্যাটিং নিয়মিত হলেও কখনো কথা হয় নি। তাই আজ আর কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। কল দিয়েছি বলে কিছু মনে করেন নি তো আবার?
- দূর, মিয়া। কি যে কইন! আমি আবার কি মনে করতাম? আইন্নের লগে কতা কইয়া ভালোই লাগতাছে।
- আপনি কি এমন আঞ্চলিক ভাষায়ই কথা বলেন?
- হ, আমি আমগোর ময়মনসিংগা ভাষায়ই কতা কইতে ভালোবাসি। আমি মমিনসিংগা পুলা, আইন্নে কি আমারে সিলেট্টা ভাষায় কথা কইবার কন?
- না, তা কেন? আচ্ছা, আম্মু ডাকছে। আজ থাকেন। পরে কথা হবে।
ফোনের লাইন কেটে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণ কেমন যেন হাসফাস লাগছিলো। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম আর ছেলেটাকে নিয়ে ভাবা বাদ দিয়ে দিলাম। না, এর সাথে আমার কিছু হবে না।
বেশ কিছুদিন আর ছেলেটার সাথে কোন মেসেজ চালাচালি হয় নি। ছেলেটাও নিজে থেকে আমাকে কোন নক দেয় নি। কিন্তু হঠাৎ মেসেঞ্জারে গেলে ছেলেটাকে অনলাইনে দেখলেই কেমন যেন বুকের ভিতর ধুকপুক করে। ছেলেটার চোখে খুব মায়া। কিন্তু তার চোখের মায়ার চেয়ে কথার তিক্ততা আমাকে তার প্রতি নিরুৎসাহিত করেছে বেশি। কথা বলাও একটা আর্ট। আর ছেলেটা এভাবে কথা বলে!
এই যে অভদ্রের মতো 'ছেলেটা ছেলেটা' বলে যাচ্ছি। তার নাম নিশো। তার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকেই। কথা হয় নি কখনো তবে মেসেজ আদান-প্রদান হয়েছে। নিশোকে অনলাইনে দেখলে নক দিতেও ইচ্ছে করে, আবার সেই কথার বিরক্তিতে নক দেই না। এর মাঝে নিশো একদিন মেসেজ দিলো।
- কেমন আছেন?
- ভালো। আপনি কেমন আছেন?
- আমি ভালো আছি। আপনি আমার বিয়ের দাওয়াত চেয়েছিলেন, সামনের মাসের পাঁচ তারিখ শুক্রবার আমার বিয়ে।
- ও, অভিনন্দন। (কিন্তু কেমন যেন একটু কষ্ট পাচ্ছি।)
- আসবেন না? ঢাকা থেকে তো মাইমেনসিং বেশি দূরে না। আপনি আসতে পারেন চাইলে।
- আচ্ছা, আমি বিয়েতে আসতে না পারলেও বিয়ের আগে বা পরে এসে দেখা করে যাব।
- তাই? তাহলে, বিয়ের আগেই আসেন। আপনাকে নদীর পাড়ে ঘুরতে নিয়ে যাব।
- আচ্ছা। আপনার ফোন নম্বর দিয়ে রাখেন, আমি আসলে জানাবো।
সেদিন আর কথা বাড়াই নি। নিশো ফোন নম্বর দিয়েছে। নম্বর রেখে দিলাম। যাব কি যাব না তাই নিয়ে দ্বিধায় আছি। নিশোকে আমার সত্যিই বেশ ভালো লেগেছে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে আমি ঠিক করলাম মাইমেনসিং যাব। যাই, যার ছবি দেখে এতটা ভালো লেগেছে সে দেখতে কেমন দেখে আসি।
শুক্রবার করে বেড়িয়ে পড়লাম ভোরে। কিন্তু নিশো অফলাইনে। এদিকে আমি গাজীপুর চলে এসেছি। নিশো অনলাইনে এলো আটটা পয়ত্রিশে। আমিই নক দিলাম।
- আছেন?
- জি, আছি। শুভ সকাল।
- শুভ সকাল। কোথায় আপনি?
- বাসায়। ঘুম থেকে উঠেছি মাত্র।
- থ্যাংকস গড! আমি বাসে। আপনার শহরে আসছি। আপনাকে দেখতে।
- ও, মা! না বলেই?
- কেন সমস্যা? চলে যাব?
- না, তা না। চলে যাবেন কেন? কোথায় আছেন এখন?
- গাজীপুর পাড় হচ্ছি। আমার আর হয়তো, দুই ঘণ্টা লাগবে।
- আমি বাসস্ট্যান্ডে থাকবো। আপনি আসেন।
- না, আপনার বাসস্ট্যান্ডে আসার দরকার নাই। আপনি বেস্ট বাইটের নিচে থাকলেই হবে। আমি মাইমেনসিং চিনি। আমি বেস্ট বাইটে চলে আসবো।
- আপনার ফোন নম্বর দেয়া যাবে?
- আচ্ছা, কল দিচ্ছি।
কল দিতেই নিশো কল রিসিভ করলো।
- হ্যালো!
- নিশো আমি রুনু।
- আইচ্ছা। বুজবার পারছি। আইন্নে হাছাই আইতাছুই।
- হুম।
- ঠিক আছে। কোন বাসে উঠছুইন।
- এনা।
- আইচ্ছা। থাহুইন। আমি বাইর অই।
ফোন রেখে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। চোখ খুলে দেখি আমি মাইমেনসিং চলে এসেছি। বাস মাসকান্দা এসে থেমেছে। আমি বাস থেকে নামতেই দেখি নিশো বাস কাউন্টারে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নিশো ছয় ফিটের মতো লম্বা, হ্যাংলা পাতলা শরীরের গড়ন। আমাকে দেখেই হেসে দিলো।
- কত বার কল দিয়েছি?
মোবাইল চেক করে দেখি পুরো দশটা মিসড কল।
- সরি, ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
- ব্যাপার না, বাইকে উঠুন।
বাইকে উঠে নিশোর কাধে হাত রাখলাম। নিশো পিছন ফিরে চেয়ে দেখে ওর কাধে আমার হাত। মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিলো। জ্যাম ট্যাম কাটিয়ে আমরা সোজা চলে আসলাম জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালার পার্কে। নিশো বাইক থামিয়ে নামতে বললো, আমি নেমে গেলাম। দেখলাম নাদীতে এখন তেমন পানি নেই। নিশো বাইক থেকে নেমে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
- সো, মাইমেনসিং-এ চলেই আসলেন?
- হুম, আপনাকে দেখতে।
- আচ্ছা। আপনি দেখতে ঠিকঠাক আছেন। চোখে কাঁজল, ঠোঁটে লিপস্টিক শুধু একটা কালো টিপের অভাব।
- আচ্ছা, আমি মাত্র খেয়াল করলাম। আপনি স্বাভাবিক বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারেন?
- ও মা, বলতে না পারার কি আছে? আমাকে কি বাবা-মা চায়না থেকে ইমপোর্ট করে এনেছে? দেশের মানুষ দেশের ভাষা জানি। তবুও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই যা। ঢাকা থেকে আমার জন্য কিছু আনেন নি?
- আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি। আমি আপনার জন্য একটা রিস্ট ওয়াচ এনেছি। জানি না ভালো লাগবে কি না আপনার।
ব্যাগ থেকে বের করে নিশোকে রিস্ট ওয়াচটা দিলাম। নিশো স্বভাবতই ধন্যবাদ দিলো। কিন্তু এখন নিশোর মুখে শুদ্ধ ভাষা শুনে আবার কেমন যেন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, ছেলেটাকে পেলে মন্দ হতো না।
- আপনি মাইমেনসিং চিনেন কিভাবে?
- থেকেছি ছোটবেলায় এখানে।
- আচ্ছা। আমি ভাবতেও পারি নি, আপনি আসবেন। আমি সত্যি খুব খুশি হয়েছি।
- হ্যাঁ, আসতেই হলো। আপনার বিয়ের উপহার দিতে।
- (মুচকি হেসে) আসলে আমার বিয়ে ঠিক হয় নি। আপনার সাথে বেশ কিছুদিন কথা হয় নি। কিছু একটা বলে তো কথা শুরু করতে হবে। তাই মিথ্যে বলেছি।
আমি আসলে বুঝতে পারছি না, খুশি হবো কি না। আর তার উপর নিশোর মনে আমার জন্য কি চলছে তাও তো ঠিক জানি না।
- কি ভাবছেন?
- কিছু না। মিথ্যে বললেন কেন?
- বিশেষ কোন কারণ নেই। আমার কাছে মনে হয় জীবন হলো অসংখ্য ছোট গল্পের সমন্বয় গঠিত। তাই একটা ছোট গল্পের সূচনা করার চেষ্টা মাত্র। আর কিছু নয়। ক্ষুধা লাগে নি আপনার? আমি আপনার জন্য নাশতা করি নি।
- (পেটে হাত দিয়ে বললাম) হুম, ক্ষুধা তো লেগেছেই।
- চলেন, রুম থ্রিতে খিচুড়ি খাই।
- চলেন।
দু'জন মিলে রুম থ্রি তে খিচুড়ি খেলাম। নিশো হঠাৎ বললো...
- চা খাওয়া দরকার। চলেন আপনাকে মুকুলের দোকানে চা খাওয়াবো।
- ঠিক আছে।
দু'জন মুকুলের দোকানে গেলাম৷ নিশো দুটো চা দিতে বললো।
- না, একটা চা দিবেন আর একটা খালি কাপ দিবেন।
- কেন?
- চা ভাগ করে খাবো। সমস্যা?
- আমি চায়ের ভাগ কাউকে দেই না।
- আচ্ছা, তাহলে আমি মুকুলের চা খাই আর আপনার জন্য আমি ছোট ফ্লাক্সে চা এনেছি। আপনি এটা খান। ভালো না লাগলে মুকুলের চা কিনে দিব।
ব্যাগ থেকে ছোট ফ্লাক্স বের করতে দেখেই নিশো বললো,
- মেয়েদের ব্যাগ হচ্ছে ম্যাজিক বক্স। এর ভিতর রহস্যের শেষ নেই। কত কি যে থাকে!
- হুম, ক্যাঙ্গারুর থলের মতো।
- আসলেই তো।
চা খেতে খেতে নিশো বললো...
- আমার বিয়ে হচ্ছে না শুনে, আপনি খুব খুশি হয়েছেন, তাই না?
- না, তো। আমার কি খুশি হবার কোন বিশেষ কারণ আছে?
- অবশ্যই আছে। আমার ধারণা, না ঠিক ধারণা না বিশ্বাস আপনি আমাকে খুব পছন্দ করেন। বলেন করেন না?
- আমি মুচকি হেসে বললাম, না। করি না পছন্দ।
- ইহ, আইছে। পছন্দ করে না। আমি মানুষ পড়তে পারি।
- তাই?
- হুম। কিন্তু, আপনার সাথে আমার হৃদয়ঘটিত কোন ব্যাপার ট্যাপার হবে না৷ কারণ, আপনি মানুষের বাহ্যিক বিষয়গুলোকে বেশি প্রাধান্য দেন।
- কে বললো?
- আবিষ্কার করেছি। কারণ, আপনি রোজ আমাকে একবার নক দিতেন। যেদিন প্রথম ফোনে কথা বললাম সেদিনের পর আর নক দেন নি।
চা শেষ করে আমি বললাম...
- আমার যেতে হবে।
- তা তো অবশ্যই যাবেন। আপনাকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। চলেন আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে দিয়ে আসি।
আবার নিশোর বাইক ছুটলো। কিন্তু কেমন যেন নিজেকে অপরাধী লাগছে। সত্যিই কি আমি শুধু মানুষের বাহ্যিকরূপটাই দেখি? ভালো লাগছে না। নিশো বাসস্ট্যান্ডে বাইক থামিয়ে বললো...
- আমার বাসায় পুরোপুরি আঞ্চলিকতা বা পুরোপুরি শুদ্ধ কোনটাই বলা হয় না। এই দুইয়ের মিশ্রণে এক ভাষায় আমরা কথা বলি। এটা যদি মানতে পারেন, তবে আপনাকে চলেন বাসায় নিয়ে যাই। আম্মার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
এর মাঝেই সুন্দর একটা মেয়ে আমাদের সামনে দিয়ে গেলো৷ আর নিশো তার দিকে তাকিয়েই আছে। নিশোর শার্টের কলার চেপে ধরে বললাম...
- ফাইজলামি পাইছো? যদি দেকছি আমি ছাড়া অন্য কোন মাইয়ার দিকে তাকাইছো বিশ্বাস করো, এক্কেরে মাইরালবাম। তুমি কি মনে করছো আমি মমিনসিংগা ভাষা পারি না? পারি ঠিকই তয় কই না। টিক মাইরা থাকি। ছুডু বেলায় এই মমিনসিংগা ভাষায় কথা কইয়া আম্মুর হাতে বিরাট মাইর খাইছিলাম। চলো, কই যাইবা যাই।
নিশো, এবার সবগুলো দাঁত বের করে একটা ক্লোজআপ হাসি দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। আমিও যাচ্ছি। হবু শ্বশুরবাড়ি। সবাই দোয়া করবেন।
লেখাঃ jasmin Ruby