ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ

 হাতজোড় করে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে রঙ্গন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এমন কিছু বলতে চাচ্ছে যেটা সে বলতে ভীষণ সংকোচ বোধ করছে। এই বাড়ির কর্ত্রী গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

-কি হয়েছে, রঙ্গন?

-আজ্ঞে গিন্নি মা, কথাটা যে কীভাবে বলি...

-ভনিতা করবে না। যা বলার সরাসরি বলো।

-সুনীল দাদা বাবু আর বৌদিকে দেখলাম উঠোনে বৃষ্টির মধ্যে নাচছে। 


রুপাঞ্জনা দেবীর মনে হলো তিনি শুনতে ভুল করেছেন। নিশ্চিত হবার জন্য আবার জিজ্ঞেস করলেন,

-কি করছে?

-আজ্ঞে গিন্নি মা, বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে নাচছেন।


ইশারা দিয়ে চলে যেতে বললেন রুপাঞ্জনা দেবী। তিনি উঁচু স্বরে পামেলাকে ডাকলেন। পামেলা এখানে কাজ করছে আজ প্রায় ৮ বছর হতে চলল। 


-কিছু বলবেন, গিন্নি মা?

-তোমার দাদা বাবু আর বৌদিকে এক্ষুণি আমার সামনে হাজির হতে বলো। 

-জি আজ্ঞে।


পামেলা দুইজনকে ডাকতে গিয়ে দেখল সুনীল দাদা আর সুহাসিনী বৌদি হাত ধরে উঠোনে গোল হয়ে ঘুরছেন। সুহাসিনী বৌদির মুখ সিঁদুরে লাল হয়ে আছে।


দুইজনেই ভিজে জবজবে হয়ে আছে। মনে মনে একবার ছিঃ ছিঃ বলে উঠলো পামেলা। হঠাৎ হাত পিছলে সুনীল দাদা বাবু পড়ে গেলেন। মাটিতে মাখামাখি হয়ে গেছে তার শরীর। অমনি খিলখিল শব্দে হেসে ফেলল সুহাসিনী বৌদি। পামেলার মনে হলো এভাবে বেহায়ার মত উঁচু স্বরে হাসার জন্য একবার বুঝি ধমক দেবে সুনীল দাদা বাবু। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে সুনীল দাদা বাবুও হেসে ফেললেন। 


পামেলা চেঁচিয়ে ডাকলো,

-দাদা বাবু...

বৃষ্টির শব্দের জন্য সেই ডাক কারোর কানেই ঢুকলো না। আরো কয়েকবার ডাকার পর সুহাসিনীর কানে সেই ডাক পৌঁছালো। 


-এই উঠুন, পামেলা দিদি ডাকছে। 


সুনীল হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-আমাকে তুলো। 

-ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছেন! অন্য মানুষের সামনে আমি আপনার হাত ধরব?

-এতকক্ষণ হাত ধরেই ঘুরছিলে। আর আমরা স্বামী স্ত্রী। হাত ধরতে লজ্জা কিসের? আর নয়ত আমি এভাবে মাটিতেই পড়ে থাকব বলে দিলুম।


সুহাসিনী লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিলো সুনীলের দিকে। তার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো সুনীল। পামেলা অনেকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কোনো ছেলে আর মেয়ে অন্যকারোর সামনে হাত ধরেছে এটা কেউ ভাবতেই পারে না। যতই সে স্বামী স্ত্রী হোক না কেন।


পামেলা চোখ ঢেকে ফেলল। সুনীল হাঁক দিলো।


-কি হয়েছে, পামেলা? ডাকছিলি কেন?

-গিন্নি মা আপনাদের ডাকে। 

-গিয়ে বল পরে আসছি। বৃষ্টি শেষ হোক। 

-এখনি যাইতে বলসে। আর অনেক রেগে  আছে বইলা মনে হইলো। 


অনিচ্ছাস্বত্বেও বৃষ্টি ছেড়ে ঘরে চলে আসলো দুইজনে। সুহাসিনীর মুখে ভয়ের ছাপ। তাকে অভয় দিয়ে সুনীল বলল,

-আরে ভয় পাচ্ছো কেন? মা কি বাঘ না ভাল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলবে?


সুহাসিনী জবাব দিলো না। সে একবার সুনীলের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো। এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে এভাবে মাথা নিচু করেই হাঁটে সে। 


রুপাঞ্জনা দেবী জিজ্ঞেস করলেন,

-তোমরা নাকি বৃষ্টিতে ধেই ধেই করে নাচছিলে, সুনীল?

সুনীল কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল, তার আগেই সুহাসিনী বলতে থাকল,

-কর্তা মা, ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেন।


রুপাঞ্জনা দেবী হুংকার ছেড়ে বললেন,

-কথাটা আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, বৌমা। তুমি চুপ থাকো। 

সুনীল সহজ গলায় বলল,

-হ্যা, মা। বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। তবে নাচছিলাম না। আমি আর আপনার বৌমা কেউ ই নাচতে জানিনা। জানলে অবশ্যই নাচতাম। 


ছেলের মুখে এমন কথা শুনে রুপাঞ্জনা দেবীর মনে হলো ছেলের গালে একটা কষে চড় লাগান। কিন্তু বৌমার সামনে এমনটা করা ঠিক হবে না। রাগ সামলে তিনি আবার বললেন,


-এমন বেহায়াপনার মানে কি? 

-বেহায়াপনার কি হলো? আমি আমার নিজের স্ত্রীর সাথেই ভিজছিলাম। অন্য কারোর সাথে তো...

-চুপ করো বেয়াদব ছেলে। দ্বিতীয়বার যেন এই ভুল না হয়। 


সুহাসিনী, ধমক শুনে একটু কেঁপে উঠল। ঘোমটার জন্য তার মুখের অর্ধেকটা ঢেকে গেছে। সে ঘোমটাটা আরেকটু নামিয়ে মুখটা প্রায় পুরোটাই ঢেকে ফেলল। তাকে এই অবস্থায় দেখে সুনীলের হাসি পেয়ে গেলেও সে হাসি গিলে ফেলল। 


-বৌমা, তুমি যাও। আমার খোকার সাথে কথা আছে। 

সুহাসিনী একবার মাথা কাত করে আচ্ছা বলে ধীর পায়ে চলে গেল। সুনীল, সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে তার চলে যাওয়া দেখল। এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,


-বলুন, মা।

-তোমার স্ত্রীকে নিয়ে তুমি বাড়াবাড়ি করছো বলে মনে হয় না?

-না।


 তার সাথে এরকম সহজ স্বাভাবিক ভাবে কেউই কথা বলে না। সবার মধ্যেই কাঁচুমাচু ভাব থাকে। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই জমিদারি তিনি একা হাতে সামলেছেন। একমাত্র সুনীল ছাড়া অন্য কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলার কথা ভাবতে পারে না। সুনীল আবার বলল,


-মা, আপনি আমাকে এক জ্যান্ত প্রতিমা এনে দিয়েছেন। তার শখ-আহ্লাদ পূরণ করা তো আমারই দায়িত্ব।

-বৌমা তোমাকে নিজে বলেছে সে বৃষ্টিতে এমন ধেই ধেই করে নাচতে চায়?

-না মা। সে এক ধ্যানে জানালার শিক ধরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখ দেখে মনে হলো সে বৃষ্টিতে ভিজতে চায়।


তাকে থামিয়ে দিয়ে রুপাঞ্জনা দেবী বললেন,

-আজকাল কি মুখ দেখে সবার সব মনের কথা বুঝতে পেরে যাও নাকি?

সুনীল একটু হাসল। এরপর বলল,

-সবার টা পারি না। তবে সুহার টা পারি।

-সুহা টা আবার কে?

-সুহাসিনী।


বৌকে আবার আদর করে সুহা ডাকা হচ্ছে। রুপাঞ্জনা দেবী বললেন,

-এখন যাও। আমার বিশ্রামের সময় এখন। 

-ঠিক আছে, মা।


সুনীল ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতেই মন টা কেমন হুহু করে উঠল রুপাঞ্জনা দেবীর। ঘরের দোর টা বন্ধ করে দেয়ালে লাগানো তার কর্তার বিশাল ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। 


অপলক তাকিয়ে আছেন ছবিটার দিকে। একবার তার কর্তা লুকিয়ে তার জন্য একটা বেনারসি শাড়ি এনেছিলেন। খবর পাওয়ার পর সেই শাড়িটা আগুনে জ্বালিয়েছিলেন তার শ্বাশুড়ি মা। এই বাড়িতে বৌদের জন্য আলাদা করে তাদের স্বামীরা কিছু কিনে না। আর সেটা যদি হয় এই বাড়ির কর্ত্রীর অগোচরে, তাহলে তার পরিনতি এমনই হয়।


অস্ফুটস্বরে রুপাঞ্জনা দেবী জিজ্ঞেস করলেন,

'নিজের অর্ধাঙ্গিনীর প্রতি ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশে এত বাঁধা আর লজ্জা কেন?'

ছবিটি নিশ্চুপ হয়ে যেন তাকিয়ে রইল রুপাঞ্জনা দেবীর দিকে। কোনো উত্তর পাওয়ার আশা অবশ্য রুপাঞ্জনা দেবীর নেই।


(সমাপ্ত)


 

লেখাঃ  অরণী মেঘ

Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

রিয়্যাক্টর কিং

একটি মেয়ের গল্প

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]