হেরে যাওয়া প্রহর

 


আদ্রিতার ঘর থেকে কথোপকথনের আওয়াজ ভেসে আসছে।মাঝেমাঝে চাপা হাসির শব্দ। মনে হচ্ছে দুজন খুব কাছের মানুষ কথা বলছে। আদ্রিতার বাবা আতিক সাহেব মেয়ের রুমে উঁকি দিলেন। কিন্তু বরাবরের মতোই ফলাফল শূন্য।আদ্রিতা একহাতে টেডিবিয়ার জড়িয়ে ধরে হেসে হেসে একাই কথা বলছে।ঘরে আর কেও নেই। আতিক সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিজের রুমে ফিরে এলেন।খাটের পাশে দেয়ালে টানানো আদ্রিতার মায়ের ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

আতিক সাহেবের বিশাল ব্যবসা। ধন-সম্পদের কমতি নেই।পরিবার বলতে একটা মাত্র মেয়ে। ওনার স্ত্রী আদ্রিতার জন্মের সময় মারা যান। সেই থেকে মেয়েটাকে একা একা বড়ো করেছেন।মেয়ের ছোট থেকে বড়ো সব রকমের চাওয়া পূরণ করেছেন।তিনি আদ্রিতাকে যেটা দিতে পারেননি সেটা হলো সময়। একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে এতোটাই ব্যস্ত থেকেছেন যে বাড়িতে অপেক্ষারত ছোট্ট মেয়েটার কথাও ভুলতে হয়েছে।আতিক সাহেব যখন বাড়ি থেকে বেরোতেন তখন আদ্রিতা ঘুম থেকে উঠতো না।আবার রাতে যখন তিনি ফিরতেন তখনও সে ঘুমিয়ে যেত।কাজের মেয়ের সাথে কথা বলে বলে বড়ো হল আদ্রিতা।

আদ্রিতা অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর একদিন ওর রুম থেকে কথাবার্তার আওয়াজ পান আতিক সাহেব।প্রথমে ভেবেছিলেন ওর কোন বন্ধু হবে হয়ত।কিন্তু পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে রুমের দরজা আস্তে করে খুললেন।ভেতরে আদ্রিতা খাটের ওপর ঘুমিয়ে আছে আর ঘুমের মাঝেই বিরবির করছে।আতিক সাহেব গিয়ে আদ্রিতার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন।একটু বাদেই আদ্রিতা কথা বন্ধ করে দেয়।সেদিন নেহাতই স্বপ্ন ভাবলেও ধীরে ধীরে যখন বিষয়টা বাড়তে লাগলো তখন আতিক সাহেব এড়াতে পারলেন না।আদ্রিতার সমস্যাটা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল।আগে ঘুমের মধ্যে কথা বলতো,এখন জেগে থেকে সজ্ঞানেই কথা বলে হাসে।ওকে দেখে মনে হয় ওর সামনে কেও বসে আছে।বাধ্য হয়ে আতিক সাহেব সাইক্রিয়াটিস্ট এর স্মরনাপন্ন হলেন।।।


নিজের চেম্বারে বসে আছে দেশের অন্যতম নামকরা সাইক্রিয়াটিস্ট আদিল ইনতিশার।সামনে রাখা একটা রোগীর ফাইল খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে।দরজায় টোকা পরতেই ওপরে না তাকিয়ে ভেতরে আসার অনুমতি দিল।আতিক সাহেব ও আদ্রিতা ভেতরে প্রবেশ করল।আদিল সালাম দিয়ে বসতে বললো।তারপর আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বলল,

-কেমন আছো আদ্রি?

- জি ভালো আপনি?

- ভালো।আচ্ছা নীল কেমন আছে??

আদিলের প্রশ্ন শুনে আদ্রিতার গাল লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।যা সামনে থাকা দুজন মানুষেরই চোখে পড়ল।মুচকি হেসে আদ্রিতা বলল,

-ভালো আছে।

- কথা হয়?

- হ্যাঁ 

-বেশ বেশ।

আদ্রিতাকে বাইরে বসতে বলে আদিল আতিক সাহেবের দিকে তাকালো।আতিক সাহেব আদিলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে আতিক সাহেব বলে উঠলেন,

-কি বুঝছেন ডক্টর??আমার মেয়ের বড়ো কোন অসুখ করে নি তো।

- আরে না না আংকেল।সেরকম কিছুই হয়নি।

- তাহলে আপনিতো প্রায় দুই বছর ধরে ওর ট্রিটমেন্ট করছেন।ওর কোন পরিবর্তন আসছে না কেন?

-আসলে আংকেল আদ্রি ছোটবেলা থেকেই একা থাকতে থাকতে নিজের ভেতর অন্য একটা সত্তা তৈরি করেছে।একাকিত্ব থেকে দূরে থাকতে ও নিজের কল্পনার সাথেই কথা বলে।এটাতো খারাপ কিছু নয়।ও ওর নিজের পৃথিবী নিয়ে নিজের মতো ভালো আছে।

- কিন্তু ডক্টর,উঠতি বয়সী মেয়ে।আমারও বয়স হচ্ছে।বেঁচে থাকা অবস্থায় মেয়েটার সংসার দেখে যেতে চাই।কিন্তু এরকম অবস্থায় কে ওকে বিয়ে করবে।

-আংকেল আপনি অনুমতি দিলে আমি আদ্রিকে বিয়ে করতে চাই।আসলে ওর একজন সঙ্গী দরকার।তাহলে ও কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

আতিক সাহেব আদিলের প্রস্তাবটা একপ্রকার লুফে নিলেন।আদিল ভালো ছেলে,এতোবড় ডাক্তার।তারওপর দেখতে শুনতেও মাশাআল্লাহ।আতিক সাহেব খুশিমনে বাড়ি ফিরলেন।


আদ্রিতা বিছানায় বসে হাতের নখ কামড়াচ্ছে।পাশেই ওর বান্ধবী নেহা বিরক্ত মুখে বসে আছে।বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর নেহা বলে উঠল,

- কি হচ্ছে টা কি আদ্রি। তোর নীল আসবে কখন,নাকি আসবেই না?

- আরে আসবে আসবে। নীল খুব ভালো ছেলে।ওর সাথে দেখা করে তোর খুব ভালো লাগবে।

-ভালো লাগানোর জন্য দেখাটা হতে হবে।তুই নীলকে একটা ফোন কর।তারাতাড়ি আসতে বল।

- আসলে ওর না ফোন নেই।

আদ্রিতার কথায় নেহা যেন আকাশ থেকে পড়ল।চোখ কপালে তুলে বললো,,

-সে কি,নীল আদৌ মানুষ তো নাকি এলিয়েন?এই যুগের ছেলে হয়েও তার নাকি ফোন নেই।

নেহা জোরে জোরে হাসতে লাগলো।আদ্রিতা চোখ গরম করে তাকাতেই নেহা চুপ মেরে গেল।নেহার বিরক্তি এবার সপ্তম আসমানে।ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আদ্রিতার বাসায় এসেছিল।কিন্তু এই মহারানী নীলের নাটক করে নিজে তো গেলই না।নেহারও যাওয়া হল না।নেহা বুঝলো ওকে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই।তাই নরম সুরে বলল,,

- আদ্রি দোস্ত,ভার্সিটির সময় তো প্রায় শেষ।আমি বাসায় যাই,নাহলে আম্মু বাড়ি ঢুকতে দিবে না।তুই আমার হয়ে নীল ভাইয়াকে সরি বলে দিস।আমি ওনার সাথে অন্য একসময় দেখা করব প্রমিজ।

- সত্যি বলছিস তো?

- হ্যাঁ একদম সত্যি।

নেহা মানে মানে কেটে পরলো।আদ্রিতা একা একাই বকবক করতে থাকলো,,

- আজকে তুমি কথা রাখলে না নীল।আমার বন্ধু বিরক্ত হয়ে চলে গেছে।ওর কাছে কতটা ছোট হলাম বলো তো।ঠিকআছে তুমি যখন আমাকে লেকের ধারে ডাকবে আমিও যাব না।পাক্কা রিভেঞ্জ নিব হুম।


আতিক সাহেব অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আদ্রিতাকে আদিলের সাথে বিয়েতে রাজি করিয়েছেন।আতিক সাহেবের ইচ্ছা অনুযায়ী খুব কম আয়োজনে ঘরোয়া পরিবেশে আদ্রিতা ও আদিলের বিয়ে হয়ে যায়।বিদায়ের সময় আদ্রিতা বাবাকে জড়িয়ে খুব কাঁদলো।আদিল কোনমতে দু'জনকে শান্ত করে আদ্রিতাকে নিয়ে বাসায় ফিরল।

আদিলের রুমটা আজ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।বেশ লাগছে দেখতে।আদ্রিতা কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।তাই আদিল ওকে আর না ডেকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে।কম্বলটা গায়ে টেনে দিয়ে ওর মাথার কাছে বসে রইল কিছুক্ষণ।তারপর বারান্দায় এসে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।আদিলের চোখ বন্ধ,কিন্তু কয়েক মূহুর্ত পরেই আদিলের মুখে ফুটে উঠলো ক্রুর হাসি।সে জিতে গেছে।চোখ বন্ধ করেই ভাবতে লাগলো সেদিনের কথা।কলেজে পড়ার সময় থেকেই আদিল আদ্রিতাকে পছন্দ করত।কিন্ত অফিসিয়ালি বিয়ের প্রস্তাব দিলে আতিক সাহেব কখনও রাজি হতেন না।তাই আদিল ছোট্ট একটা নাটক করল আদ্রিতার সাথে।ওর আবেগি বয়সটার সুযোগ নিয়ে ওর মধ্যে আরেকটা সত্তা তৈরি করতে বাধ্য করল।একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হওয়ায় এ বিষয়টা আদিল খুব ভালোভাবেই সামলে নিল।আদ্রিতাকে বোঝাতে লাগলো ওর একলা জীবনে কাওকে দরকার।কথা বলার জন্য,ভালোবাসার জন্য।যে কখনও ওকে ছেড়ে যাবে না।আদিলের ভালো ব্যবহারের জন্য আদ্রিতা ওকে বন্ধু ভাবত।তাই ওর কথায় নিজের মধ্যে দ্বিতীয় সত্ত্বা নীলের সৃষ্টি করে।সেই থেকে শুরু হয় নীলের সাথে আদ্রিতার কথোপকথন।যখন আদ্রিতা দু-এক দিনের জন্য স্বাভাবিক হতো তখন আদিল ওর সাথে দেখা করে ওকে আবার বোঝাতো।যার ফলে আদ্রিতার সুস্থ হয়ে ওঠেনি।আদিল চোখ খুলে উঠে দাঁড়ালো।ধীর পায়ে রুমে গিয়ে আদ্রিতাকে দেখতে লাগলো।তারপর ওর কপালে আলতো পরশ দিয়ে পাশে ফিরে শুয়ে পরলো।ওর মুখে তখনও সেই ক্রুর হাসিটা রইল।


আদ্রিতা আদিলের বিয়ের প্রায় একবছর হতে চললো।সবকিছু আগের নিয়মেই চলছে।আদ্রিতাও হাসিখুশি সংসার করছে।কিন্তু ভালো নেই আদিল।তার জীবন থমকে গেছে।আদ্রিতার ভাবনায় আদিল কোথাও নেই।তার সবটা জুড়ে রয়েছে নীল।আদ্রিতাকে পাওয়ার জন্য নীল নামের যে সত্ত্বা আদিল সৃষ্টি করেছিল তার বিনাশ সে করতে পারেনি।আদ্রিতা গুছিয়ে সংসার করলেও দিনশেষে নীলকে নিয়েই তার যত ভাবনা।আদিল ছুটির দিনে আদ্রিতাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যায়।কিন্তু আদ্রিতা বলে,

- চলো লেকের ধারে গিয়ে বসি।নীলের সাথে দেখা করিয়ে দেব।

আদিল কয়েকবার বকে ধমকে আদ্রিতাকে বোঝাতে চেয়েছে নীল বলে কারও অস্তিত্ব নেই।কিন্তু তাতে ও আদিলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।তাই আদিল আর এ বিষয়ে কথা বাড়ায়নি।কারন আদ্রিকে সে হারাতে পারবে না।

অনেকদিন পর আবার বারান্দায় চেয়ারে এসে বসলো আদিল।আদ্রিতা রান্না করছে।মাঝেমাঝে একা একাই হাসছে।তার খুশির শেষ নেই যেন।আদিল ওকে পেয়েও পেল না।জিতে গিয়েও যেন সে হেরে গেল।।


সমাপ্ত

লেখাঃ নিমিশা জান্নাত



Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

রিয়্যাক্টর কিং

একটি মেয়ের গল্প

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]