ভালোবাসার দায়ভার

মাজেদ ভাইকে দেখতাম রোজ রাতে তার বারান্দার গ্রিল ধরে চিল্লিয়ে কাঁদতেন।মানুষটার জন্য আমার ভয়ংকর কষ্ট হতো।একসময় তার কাছে পড়তে যেতাম,বড় ভাইয়ের মতো। পাশাপাশি বিল্ডিং এ থাকায় দুজনের খুব জমতো।ভারি মজার মানুষ ছিলেন।

মাজেদ ভাইয়ের ব্যাচ শুরু হতো বিকাল ৪ টায়। আমরা সব দলবল মিলে ৩ টার ভেতর হাজির হতাম।কখনো মাজেদ ভাই হয়তো ঘুমাচ্ছেন দেখতাম,কখনো খাচ্ছেন। কখনো রাগতেন না। দরজা খুলে হাসিমুখে বলতেন,

 "শয়তানের দল হাজির?"

সবার ভেতর আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন।সবসময় সাথে সাথে রাখতেন।

আমাদের ব্যাচ শেষ হলে সন্ধ্যার পর আরেকব্যাচ পড়ত। ওনারা আমাদের বড় ছিলেন।বেশি আদরের ফলে মাজেদ ভাই আমার কানে ধরে সেই ব্যাচের সাথেও বসিয়ে পড়াতেন। আমি ঢুলুঢুলু চোখে বই খুলতাম।গাল টেনে বলতেন,

"বই দেখলেই ঘুম না? আবির তুই ম্যাট্রিক পরিক্ষায় কি করে পাস করবি বলতো?

আমি মাথা চুলকাতাম।অসহায়ভাবে বলতাম,

"মাজেদ ভাই পড়তে ভালো লাগেনা যে।'

বিনিময়ে পেতাম মাজেদ ভাইয়ের হাতের কানমলা। 

নিতু আপা সেই ব্যাচেরই। পুরোদস্তর বাঙালি মেয়ে। একটা লম্বা বেনিতে লাল ফিতা আর চোখে কাজল।এর বাইরে কোনো দিন নিতু আপাকে সাজে দেখিনি। মাথানিচু করে আসত, আবার মাথানিচু করে চলে যেত।পুরো ক্লাশে কোনোদিন তাকে হাসতে দেখিনি।বইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথানিচু করে থাকতেন।

সাদামাটা এই মেয়েটাকে মাজেদ ভাই অসম্ভবরকম ভালোবাসতেন।প্রায়ই চিঠি দিতেন যার মাধ্যম ছিলাম আমি। চিঠি দেয়ার জন্য মাজেদভাই দশটাকা দিতেন।আমার কাজ ছিল একদৌড়ে চিঠি নিশি আপার কাছে দিয়ে, সে যদি কিছু দেয় নিয়ে আসা।

আমার হাতে চিঠি দিয়ে মাজেদ ভাই লজ্জায় লাল হয়ে যেতে যেতে বলতেন,

 "তোর নিতু আপা আমার জন্য কিছু দিলে নিয়ে আসিস।"

আমি হাসতে হাসতে বলতাম,

"নিতু আপাতো নাই এখানে এত লজ্জা পাচ্ছো কেন?"

কান টানা দিয়ে মাজেদ ভাই বলতেন,

"পাকনা ছেলেরে প্রেমে পড় বুঝবি তখন যা ভাগ।"

আমি যতক্ষুণ না ফিরতাম মাজেদ ভাই রাস্তায় চিন্তা চিন্তা মুখ করে হাঁটতেন।আমার খালি হাতে ফিরতে খারাপ লাগত।একদিন নিতু আপাকে বলেছিলাম,

 "আপা আপনার চিঠির জন্য রোজ মাজেদ ভাই অপেক্ষা করে।"

নিতু আপা মাথানিচু করে চিঠি নিতে নিতে বলল,

"তাকে জিজ্ঞেস করো,সে কেমন আছে?"

এই ঘটনা মাজেদ ভাইকে যেদিন বলেছিলাম খুশিতে বেচারা সেদিন কান্না করে দিয়েছিলেন।সন্ধ্যার ব্যাচ পড়াতে গিয়ে কতবার যে কথা আটকে গিয়েছিল।ভালোবাসা যে কতটা মধুর আমি দেখেছিলাম মাজেদ ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে।

নিতু আপা এরপর থেকে মাঝেমাঝে ছোট্ট একটু কাগজে দু'তিন লাইন লিখে দিতেন।বিনিময়ে মাজেদ ভাই খুশিতে আমাকে বিরিয়ানি খাওয়াতেন বা তেহারি। 

এক রাতে মাজেদ ভাই আমার ঘরে এলেন চোখ লাল করে,গায়ে ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে।এসে বললেন,

"তোর কাছে একটু ঘুমাই আবির।একা একা ঘরে ভয় করছে।"

আমি অবাক হয়ে গেলাম হাসিখুশি একটা মানুষকে এমন হুট করে থমকে যেতে।সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম,

"ভাই কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন?"

মাজেদ ভাই মুচকি হাসি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।মাঝরাতে হুটহাট কান্না করে উঠতেন।লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়তেন।আমি বুঝলাম যে নিতু আপার সাথে কোথাও হয়তো ঝামেলা হয়েছে।

   পরের এক সপ্তাহ নিতু আপা পড়তে এলেন না।নিতু আপার কথা জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেতেন। তার পরের সপ্তাহে নিতু আপার বিয়ে হয়ে গেল।আমি দৌড়ে মাজেদ ভাইয়ের কাছে এলাম।

 "ভাই,নিতু আপার বিয়ে হয়ে গেলো।আপনি একটাবার আটকালেন না? "

বইয়ের মুখ গুঁজে মাজেদ ভাই বললেন,

"টেবিলের উপরে চিঠি আছে।যা পড়ে নে।"

আমি কপালকুঁচকে টেবিলের উপর রাখা চিঠিটা পড়লাম। খুব বেশি কিছুই লেখা নেই।কাটাকাটা হাতে কিছু লাইন লেখা।

"আব্বা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।আপনার কথা আব্বাকে বলেছি।আব্বা রাজি না।আশা করি কোনো ঝামেলা করবেন না। আব্বাকে কষ্ট দেবার মতো কাজ আমি করতে পারবো না।মাফ করে দেবেন। শেষ একবার দেখতে ইচ্ছা করছিল।এই ইচ্ছাকে ভালোবাসা বলে?

ইতি,নিতু।"

চিঠি পড়ে আমি থ হয়ে বসে রইলাম। মাজিদ ভাই মুখে বই চাপা দিয়ে কাঁদছেন। কান্নার শব্দেও কষ্ট থাকে।সেই কষ্টে আমার চোখে পানি এসে গেল।

এরপরে মাজেদ ভাই আমাদের আর পড়াতেন না।একদম পাগলের মতো হয়ে গেলেন।রাত হলে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যেত।কান্নার শব্দে প্রবল কষ্টেরা দেয়ালে দেয়ালে বারি খেত। কেউ আশেপাশে যেত না।আমি পরম মায়া নিয়ে তার পাশে বসে থাকতাম।মাজেদ ভাই এই হাসেন,এই কাঁদেন। ছোট্ট ছোট্ট কাগজ হাতের ভেতরে,নিতু আপার দেয়া সেই চিরকুট। আমি জিজ্ঞেস করতাম,

"রাতে ওভাবে কাঁদবেন না মাজেদ ভাই।লোকে পাগল বলে আপনাকে।"

হাত চেপে ধরে বলত,

"কষ্ট হয় আবির।নিতুর জন্য মন কেমন করে । সবাই আমারে কাঁদতে দেখে,আমিতো কাউরে বলতেও পারিনা আমার নিতুর জন্য কষ্ট হয়।"

মাজেদ ভাই হাত চেপে ধরে ঢুকরে কেঁদে ওঠেন।আমি তার চোখের পানিতেও নিতু আপার জন্য সম্মান দেখি।ভালোবাসা দেখি কিভাবে মানুষকে কাঁদায়। নিতু আপার বিয়ের পরের বছর মাজেদ ভাই মারা গেলেন।গলায় দড়ি দিলেন মাঝরাতে।

লোকজনের আওয়াজ শুনে মাঝরাতে দৌড়ে গিয়ে দেখলাম কেমন ছটফট ছটফট করতে করতে মানুষটা চোখের সামনে মরে গেল।

কত কষ্ট নিয়ে মানুষটা চলে গেল সেদিন কেউ বোঝেনি। সবাই হায় হায় করছিল। 

ভালোবাসার দায়ভার সবাই নিতে পারেনা।ভালোবাসাকে বয়ে চলা ভীষণ কঠিন।ভালোবাসা কত ভয়ংকর অথচ কত শান্তির!



লিখা: অর্না খান

Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]

ডিপ্রেশন

এক চালাক ব্যক্তি [ post no: 11 ]