হাসি
কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি , মার্কেটর কাছে আসতেই হঠাৎ কে যেন পিছনের দিকে জামা টেনে ধরলো। আচমকা এমন হ্ওয়াতে ভয় নিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি একটা টোকাই। আমাকে তাকাতে দেখে হাত বাড়িয়ে বললো
- আফা দুইডা টেহা দেন।
ওর নির্লিপ্ত চাওয়াকে প্রধান্য না দিয়ে ওর দিকে তাকালাম। বয়স পাঁচ কিংবা ছয় বছর, একটি মলিন ফ্রক পরা,চুল গুলো রোদে পোড়ে কেমন লালচে হয়ে গেছে।এই শহরটাতে টোকাইয়ের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরো মার্কেট খুঁজে পঞ্চাশ জন পথশিশু পাওয়া যাবে। এদিক দিয়ে যাওয়াটা খুবই সমস্যাজনক হয়ে উঠেছে। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত ছাড়া পাওয়া যায় না। হাতে পায়ে ধরে আবার কেউ কেউ জড়িয়ে ধরে থাকে।কি এক বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মেয়েটির দিকে রাখি চোখে তাকিয়ে বললাম
- এই মেয়ে জামা ছাড়, টাকা নেই আমার কাছে।
- না, ছাড়তাম না। কয়ডা টেহা দিয়া যান আফা।
- বললাম তো টাকা নেই আমার কাছে, ছাড় বলছি আমাকে।
মেয়েটি জামা ছেড়ে এবার হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছে।আমি আবার ও বলছি ছাড়তে কিন্তু সে নাছোড়বান্দা টাকা না নিয়ে ছাড়বেই না।পথে হাজারো মানুষের আনাগোনা,এক বৃদ্ধা লক্ষ্য করে এগিয়ে এসে দিলো এক ধমক। মেয়েটি ভয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যায়, আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হাঁটতে শুরু করলাম। কলেজ থেকে যাওয়া আসা করার জন্য গাড়ি ভাড়া হলো দশ টাকা করে বিশ টাকা। কিন্তু সপ্তাহের ছয় দিন ই আমি হেঁটে যাই। আমার বাবা একজন দিনমজুর প্রতি দিন টাকা দিতে পারে না।সাত দিনের মধ্যে ৪ দিন টাকা দেয় গাড়ি ভাড়া হিসেবে।
আমার তেমন ভালো বন্ধু বা বান্ধবী নেই। যারা আছে তারা নামেই আছে কাজে নেই। আমার মনে হয় আমার ক্লাসে আমি ছাড়া সবাই ধনী। তারা খুব বিলাসীতা করেন, ধনীদের আদরের কন্যা সন্তান আছে কতগুলো, তাদের একটা দল আছে যেখানে সব ভালো ভালো ছাত্রী ও আছে।ওরা প্রতিদিন সবার গাড়ি ভাড়া দেয়, ফুসকা না খেলে যেন তাদের কলেজে আসাটাই বৃথা। প্রতি মাসে বাড়িতে পার্টির ব্যবস্থা করা আরও কতো কি। আমার সাথে কখনো কথা হয়নি তাদের, তাদের সম্মানে লাগে কথা বলতে।এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি অতোটা ভালো ছাত্রী ন্ই আবার খারাপ ও না। কিভাবে যেন এটাতে চান্স পেয়ে যাই সেটা আকাশ কুসুম ভাবনার বিষয়। দূরসম্পর্কের এক চাচার সুপারিশে আমি বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পাই। ক্লাসে মেয়েদের বিষয়গুলো ভাবলে আনমনেই হাসতে মন চায়।
মাথার উপর সূর্যটা যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁচ বাড়িয়ে দিচ্ছে, হাঁটতে গিয়ে ঘেমে একাকার অবস্থা। খুব ভালো লাগে একা একা হাঁটতে, চারপাশে কতো ব্যস্ততা, ছুটে চলছে হাজারো অচেনা মুখ,একেক জনের মুখ ,মন একেক রকম, আবার তাদের চিন্তা ভাবনা ও আলাদা। রাস্তার একপাশে খুব ঝামেলা হচ্ছে,কতো মানুষ উৎসাহের সাথে ব্যাপারটি উপভোগ করছে অথচ প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই। একবার ইচ্ছে করছে গিয়ে দেখতে কি হচ্ছে? কিন্তু মেয়ে মানুষ একা পুরুষের ভিড়ে যেতে সাহস করিনি।
কতো মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় নেই, দোকানপাটে ব্যস্ততা। ফুটপাতে বসেছে হাজার রকমের অস্থায়ী দোকান যেমন ঝালমুড়ি, ফুসকা,চানামুঠ ও লেবুপানি দিয়ে সরবত আরো কতো কি।আমি প্রত্যেক দিন একটা দোকান থেকে লেবুপানি পান করে যাই, ঠান্ডা পানির সরবত গলায় গেলে কি রকম একটা তৃপ্ততা অনুভব করি তা ভাষার বাইরে। কিন্তু আজতো আমার কাছে টাকা নেই,গুটি গুটি পায়ে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ছেলেটা আমাকে দেখেই মুখে হাঁসি ফুটিয়ে বললো
- কেমন আছেন আফা?
- ভালো।
- কি পানি দিমো?
- আজকে আমার কাছে টাকা নেই।
ছেলেটি চুপ থেকে বললো
- প্রতি দিন তো টাহা দিয়াই খান । আজকে না হয় ফ্রি তে খাইবেন।
- ফ্রি লাগবেনা।কাল টাকা দিবো তুমি আমারে বাকিতে দিবা?
- বাকি দেইনা।তয় আফনেরে ফ্রিতে দিমো,খাইবেন না?
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। ছেলেটার মুখে হাঁসি নিয়ে বানাতে লাগলো। মনে হচ্ছে কি মহৎ কাজ করছে। সত্যিই তো মহৎ কাজ করছে, আল্লাহ বলেছেন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিকে পানি পান করানো মহৎ কাজ। ছেলেটি সেই কাজটি করে পূন্যের খাতায় নাম লিখছে। গ্লাসটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে
- নেন আফা খান।
হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম আজকের স্বাদ টা অন্যরকম। ফাঁকা গ্লাসটি তার কাছে দিয়ে বললাম
- থ্যাংকস। ছেলেটি হাসি দিয়ে আধো আধো গলায় বললো
- ও ওয়েল কাম।
বলেই হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। তার মুখে এক পূর্নতার হাঁসি। হুঁ হুঁ করে হেসে বললো
- আমি ইংলিশ পারি না আফা।
বিষ্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে "ঠিক আছে বলে তাকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
কি অমায়িক হাঁসি ছেলেটার। বয়স তেরো চৌদ্দ হবে কিন্তু এই বয়সে রোজগার করে। বাড়ির উঠানে পা রাখতেই ছোট বোন এসে বললো আমি যেন পিছনের দরজা দিয়ে ঘরে যাই।কারন টা জিঙ্গেস করতেই বলে উঠলো আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে,আর তারা সামনের ঘরেই বসে আছে।বড্ড ক্লান্ত লাগছে, পিছনের দরজা দিয়ে ঘরে আসতেই মা এসে বলে
- তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আয় নূরী। ওনারা ৩ ঘন্টা আগে এসেছে।
হাত মুখ ধুয়ে আসতে না আসতেই পাত্রপক্ষের একজন এসে কলেজ ড্রেসেই তাদের সামনে নিয়ে বসিয়ে দেয়।এই নিয়ে নয় বার যাচ্ছি পাত্রপক্ষের সামনে,তাই আগের মতো অসস্তি নেই। সালাম দিয়ে বসতেই একেক জনে একেক রকম প্রশ্ন শুরু করছে, আমি সব ঠিক ভাবে বিনয়ের সাথে উত্তর দিতেই তারা আমাকে যেতে বললো। আমি পাশের ঘরে গিয়ে বসলাম। যেহেতু টিনের ঘর তাই স্পষ্ট তাদের কথা শুনা যায়।ওরা বলছে
- দেখুন পাত্রি আমাদের পছন্দ হয়েছে কিন্তু আমাদের কিছু দাবি আছে।
- বলুন
- তিন লক্ষ টাকা , তিন ভুরি স্বর্ন আর কিছু ফার্নিচার দিতে হবে।
কথাটি শুনা মাত্রই যেন বাবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তার সামর্থ্য নেই যে এতো কিছু দিবে। আমাদের বসতবাড়ি আর আবাদ করার একটি মাত্র জমি ছাড়া আর কিছুই নেই।বড় আপুর বিয়ের সময় অর্ধেক জমি বিক্রি করে দিয়েছে। তাদের চাহিদা পূরণ করতে গেলে আমাদের নিঃস্ব হতে হবে। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না, সোজা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আর বললাম
- আমাকে কি আপনারা গরু ছাগল পেয়েছেন যে কেনাবেচার দরদাম করছেন, আমাদের অবস্থা দেখে কি মনে হয় আপনাদের চাহিদা গুলো পূরণ করার সামর্থ্য আছে আমার বাবার? পরিষ্কার করে শুনে রাখুন আমি এই বিয়ে করবো না, আপনারা আসতে পারেন।
হঠাৎ একটা হট্টগোল পরে গেল। নানা রকম খারাপ মন্তব্য করতে করতে বিদেয় হয়ে যায়। বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে, মা এসে আমাকে যা তা কথা শুনাচ্ছেন। নিজেকে খুব নিচু প্রানী মনে হচ্ছে,এই সমাজে আমার অবস্থান কতোটা নিম্নে তা বুঝতে পারছি। নির্লজ্জের মত রান্না ঘরে গিয়ে নিজের ক্ষুধার্ত পেটকে শান্ত করলাম।
পরের দিন কলেজে যাওয়ার পথে নির্জন রাস্তায় একটা মানিব্যাগ দেখতে পেলাম। আসেপাশে কাউকে না দেখে ব্যাগটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেলাম,এতে অনেক টাকা রয়েছে,এতো টাকা একসাথে দেখনি আমি।এখানেই অপেক্ষা করতে লাগলাম যদি কেউ খুঁজ করতে আসে এই রাস্তায়। প্রায় তিন ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। আবার ব্যাগটি হাতে নিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলাম পেয়েও গেলাম কাঙ্খিত জিনিস টি,একটা কার্ড এর মধ্যে নম্বর আছে। পাশের দোকান এ গিয়ে একটা মোবাইল চেয়ে নিয়ে কল দিলাম, সাথে সাথে রিসিভ হলো সালাম দিয়ে টাকার কথাটি বলতেই লোকটি বললো
- টাকাটি আমার ই। কিন্তু এখন আমার সময় নেই যাওয়ার। আপনি টাকা টা কোনো মসজিদ বা এতিমখানায় দান করবেন।
কথাগুলো বলেই কল কেটে দিলো। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম এতো গুলো টাকা দিয়ে দিলো, সময়ের জন্য সে টাকাটা নিবে না? হয়তো অনেক টাকা আছে লোকটির। কমপক্ষে বিশ হাজার টাকা হবে এখানে। ভাবতে লাগলাম কি করবো , মসজিদে দেওয়ার জন্য প্রভাবশালীরা আছে। সঠিক পরিকল্পনা করে টাকা টা নিয়ে হাঁটা ধরলাম মার্কেটের দিকে, দেখলাম ওই ছেলেটা আজকে আবার লেবুপানি বিক্রি করছে। হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম
- কেমন আছো?
- জে আফা ভালা।
- তুমি আজকে সারাদিন আমার সাথে থাকবে? আমাকে সাহায্য করবে একটু?
- ঘরে চাইল ডাইল নাই ,মার জ্বড়, কাইল বেশি বেচা হয়নি।আইজ পারুম না আফা।
- সব গুলো কত টাকার হবে এখানে?
- ৪০০ টাহার মতো হ্ইবো।
- আমি যদি তোমাকে তিন হাজার টাকা দেই । আর চাল ডাল ও কিনে দেই তাহলে যাবে আমার সাথে?
ছেলেটি যেন আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। বিষ্ময়ে বলে উঠলো
- সত্যি আফা?
- হুম । চলো তাড়াতাড়ি আর এই নাও তোমার টাকাটা।
সবগুলো পথশিশুদের জড়ো করলাম অনেক কষ্টে।সবাই কে মাঠের মধ্যে থাকতে বলে মার্কেট এ গেলাম, সবার জন্য কাপড় কিনতে সাথে আমির ( ছেলেটি) আছে।এই প্রথম এতো কাপড় একসাথে কিনলাম যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা। কাপড় কিনেও আরো পাঁচ হাজার টাকা আছে, হোটেল এ গিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট অর্ডার দিয়ে তা নিয়ে মাঠের দিকে অটো নিয়ে গেলাম সাথে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র আছে। মাঠে গিয়ে সব নামাতেই সবাই কাছে এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে।তাদের সামলে সবাই কে এক এক করে জামা কাপড় দিলাম।ওই দিন যে মেয়েটাকে বিরক্ত লাগেছিলো আজ তার দিকে তাকাতেই তার মুখে হাঁসির ঝলকানি দেখতে পেলাম। সবাইকে ঘাসের উপর বসিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট দিলাম ,আমি আর আমির ও বসলাম। খোলা মাঠে ঘাসের উপর বসে খাওয়ার স্বাদটা যেন অমৃত।সবাই গাপুস গুপুস করে খাচ্ছে, যেন কতোদিন খায়নি। আজকের খাওয়া যেন কি শান্তিপূর্ণ তা কেবল মহান আল্লাহ একমাত্র জানেন। সবকিছু করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে,মা হয়তো চিন্তা করছে।সবার দিকে তাকালাম কি পূর্ণতা প্রকাশ পেয়েছে মুখগুলোতে। অমলিন হাসিমুখ গুলোকে বিদায় দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।
লিখাঃ ফাতেমা নূর