বেলা শেষে
নয়নের চাচাতো ভাই আকাশের বিয়ে দু'দিন পরে। আকাশের জোর দাবি নয়নকে যেতেই হবে। সে না গেলে বিয়েই করবে না। কিন্তু নয়ন একা যাবে না, আমাকে সাথে নিয়ে যাবে। কোন উপায় না পেয়ে আমিও রাজি হলাম। বিয়েতে গেলে ভালোই আনন্দ ফুর্তি হবে। এমনিতেও নয়নের মন খারাপ কিছুদিন ধরে, বিয়ের সুবাদে ওর মনটাও ভালো হয়ে যাবে।
আগে আমাদের ফেনী যেতে হবে নয়নের বাড়িতে। সেখান থেকে বর যাত্রী হিসেবে বরিশালে যেতে হবে। অনেক বড় জার্নি যদিও আমি যেতে চাইছিলাম না, এখন আমি চরম এক্সাইটেড।
রাত্রের বাসে উঠে কানে হেডফোন লাগিয়ে দিলাম ঘুম। এক ঘুমে রাত কাবার। ভোর ছয়টা দিকে ফেনী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। তারপর সিএনজি দিয়ে নয়নের বাড়িতে যেতে লাগলো মাত্র পনেরো মিনিট।
বিয়ে বাড়িতে ঈদের থেকে বেশি আনন্দ। যাওয়া মাত্রই মানুষ গুলো আমাদের সাদরে গ্রহণ করে নিজের মানুষের মতো আপন করে নিলো।
পরদিন সকাল।
নানান ধরনের লোকজনের আনাগোনা দেখতে ভালোই লাগছে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সবাই মেতে আছে বরকে নিয়ে। আজকে বরের গায়ে হলুদ, নয়ন বরকে নিয়ে খুব ব্যাস্ত। আমি বরের গায়েহলুদের স্টেজের পাশে চেয়ারে বসে আছি।
আকাশকে হলুদ দিয়ে গোসল করানো হচ্ছে। এদিকে ছোট ছেলে মেয়ে হলুদ নিয়ে খেলছে। একে অপরকে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। অনেকে রঙ আর জরি ছেঁটাচ্ছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ দু'টো বন্ধ করলাম। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতেছি ছোট সময় কতোই না দুষ্টামি করেছি। আমার জন্য কেউ শান্তিতে থাকতে পারেনি। মিস করি সেই ছেলেবেলাকে।
হঠাৎ চোখে মুখে তরল ঠান্ডা কিছু অনুভব করলাম। চোখ খুলে দেখি আমি পুরো লাল হয়ে গেছি। কেউ অনেকটা রঙ আমার উপর ঢেলে দিয়েছে।
এদিক-সেদিক তাকিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কে এই কাজ করেছে বুঝতে পারলাম না৷ সম্ভবত ইচ্ছে করেই করেছে নয়তো সরি বলার জন্য হলেও সে দাঁড়িয়ে থাকতো।
এক ছোট ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
- “কে আমার গায়ে রঙ ঢেলে দিয়েছে?”
ছেলেটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো, বালতি হাতে একটা মেয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। মেয়েটির চেহারা দেখতে পেলাম না। মেয়েটার জামায় এতো প্রকারের রঙ লেগেছে বুঝতেই পারছি না কি রঙের জামা।
সারা শরীরের রঙ নিয়ে নয়নের সামনে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে হাসতে শুরু করেছে। এমন ভাবে হাসছে যেন জীবনের প্রথম এবং শেষ হাসি। ওর হাসি দেখে তো আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। বরের গায়ে হলুদ শেষে আমিও গোসল করে নিলাম।
বাইরে সবাই আনন্দ-ফুর্তি করতেছে। নয়ন কাজে ব্যাস্ত। আমি নয়নের রুমে শুয়ে শেষের কবিতা উপন্যাসটার পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি। এমন সময় ছোট একটা ছেলে রুমে প্রবেশ করলো। এসে একটা চিরকুট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“ভাইয়া আপু আপনার জন্য এটা পাঠিয়েছে৷”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোন আপু? নাম কি তার?”
কিছু না বলেই দৌড়ে পালালো ছেলেটা। আমি বইটা রেখে চিরকুট হাতে নিয়েই ভাবতে লাগলাম কি লিখা থাকতে পারে এই চিরকুটে।
তখনই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না, তাই রিসিভ করলাম না। তারপরেই মেসেজ আসলো৷ মেসেজে লেখা,“কল তো রিসিভ করলেনই না। চিঠি পড়েছেন? আশা করি চিঠির উত্তর মেসেজে দিয়ে দিবেন৷”
ছ'মাস ধরে রোজ এমন একটা চিরকুট পাই। কিছু চিরকুটে প্রেমের ছন্দ লিখা আবার কিছুতে কেমন আছি, কি করছি, দিনকাল কেমন চলছে এসব প্রশ্ন করা। কে পাঠায় এগুলো জানি না। জানার আগ্রহ আছে কিন্তু বড্ড অলস আমি। জানার চেষ্টা করি না। সে চিঠি তো পাই ঢাকাতে এখানে কে চিঠি পাঠালো ভেবেই পাচ্ছি না। চিরকুটটা খুলে দেখলাম। চিরকুট লিখা, “অনেক দিন আগে থেকেই আপনাকে আমি খুব পছন্দ করি৷ কিন্তু কখনো বলার সাহস করতে পারিনি।”
হাতের লিখা দেখে কিছুটা বুঝলাম ঢাকায় যে চিঠি পাঠাতো সেই মেয়ে। কিন্তু, এখানে এমন কে হতেপারে যে আমাকে চিনে। ভেবে পাচ্ছি না৷ যাইহোক তাকে ভেবে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। হয়তো বা কেউ ফাজলামো করছে। কারণ এখানে আমার পূর্ব পরিচিত কেউ আছে বলে মনে হয় না। আর আরেক জনের হাতের লিখার সাথে মিল থাকতেই পারে। রিপ্লাই দিলাম না।
পরদিন,
সবাই বরযাত্রী যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। আমি যাব না, নয়ন আমাকে ছেড়ে যাবে না। তবু জোর করে তাকে পাঠালাম। এখন একা একা বোরিং লাগছে।।
ভাবছি একটু হাঁটতে বের হবো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঠিক করতে পারছি না কোন দিকে হাঁটতে যাব।
–এই যে হ্যালো। -ডাকছে এক নারী কন্ঠ। পেছন ফিরে তাকালাম। বেশ মায়াবতী, মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি। একদম কাছে আসতে দেখে বললাম,“দূরত্ব বজায় রাখুন৷”
স্বভাবত আমার এমন ব্যবহারে সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কিন্তু সে স্বাভাবিক, সামান্য বিরক্তির ছাপও নেই। সে একহাত দূরত্ব রেখে জিজ্ঞেস করলো,“বরযাত্রী গেলেন না যে?”
মেয়েটাকে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না।
–তিন হাত দূরত্ব বজায় রাখুন তারপর উত্তর দিচ্ছি।
এবার মেয়েটা বিরক্ত বোধ করলো। সম্ভবত মনে মনে আমাকে গালি দিতেছে। সে ঠিক তিন হাত দূরে দাঁড়াল।
আমি বললাম, “ভাল্লাগছিলো না, একটু মাথা ব্যাথা করছিল তাই যাইনি। কিন্তু আপনি যাননি কেন?”
–আমারও ভাল্লাগছিলো না তাই যাইনি। চলুন আমরা হাঁটি।
মেয়েটার হাঁটার প্রস্তাব পছন্দ হলো। তার সাথে তিন হাত দূরত্ব রেখে হাঁটতেছি।
–একটা প্রশ্ন করবো? -জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা।
–করুন।
–সব মেয়েদের থেকে তিন হাত দূরত্ব বজায় রাখেন? নাকি শুধু আমার বেলায় এমন? আসল রহস্য কি?
–আসলে দাদি বলেছেন আমি যেনো কোন মেয়ের খুব কাছে না যাই। অন্ততপক্ষে তিন হাত দূরত্ব রাখতে হবে।
মেয়েটার ভ্রু কুঁচকে গেছে। সে সম্ভবত হতভম্ব হয়েছে। দেখতে আমার ভালোই লাগছে। মনে মনে একটু আনন্দ পাচ্ছি। দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা একটু বেশি করে ফেলেছি, সরি বলা উচিৎ।
–আরেকটা প্রশ্ন ছিলো।
–জি করুন।
–আপনি এতো চুপচাপ থাকেন কেন?
–আসলে দাদি বলেছে কোন জায়গায় যেয়ে যেন বেশি কথা না বলি। আমি বেশি কথা বললে নাকি মেয়েরা ইম্প্রেস হয়ে আমার গলায় ঝুলে যাবে।
মেয়েটা এবার হাসলো। এতো সুন্দর করে যে কেউ হাসতে পারে আমি জানতাম না। সুন্দর হাসি এর আগে অনেক দেখেছি কিন্তু এতো সুন্দর হাসি এর আগে আমি দেখিনি। হাসি থামিয়ে বললো,“ছেলে বাড়ির বিয়ের মূল মজাই তো বর পক্ষ থেকে কন্যা বাড়ি যাওয়া। আর আপনি বিয়েতে এসে এটাই করলেন না! বড় মিস করলেন।”
–কিছু কিছু সময় মিস করতেও ভালো লাগে। তা আপনি মিস করলেন কেন?
–ঐ যে আপনি বললেন কিছু সময় মিস করতেও ভালো লাগে।
আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। মেয়েটা বেশ রসিকতা জানে। এতোক্ষণ কথা হলো অথচ নামটাও জানা হলো না। জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করলাম না।
–কিছু জিজ্ঞেস করবেন?-জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা। সে সম্ভবত বুঝে ফেলেছে।
–উহু।- উত্তর দিলাম আমি।
–আমার নামটাও জিজ্ঞেস করবেন না?
এই মুহুর্তে আমি নিজে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছি। একটু আগে তার নাম জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করলাম না। আমার লজ্জা লাগছে। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,“আপনার নাম টা কি?”
–মাইমুনা।
–নয়নের কি হোন?
–চাচাতো বোন।
–ওহ আচ্ছা।
বিকেলে বের হয়েছিলাম অনেকক্ষণ হেঁটে মাগরিবের আজানের আগে বাড়ি ফিরলাম৷ নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে ভালোই লাগে কিন্তু মেয়ে মানুষ হলে একটু ইতস্তত বোধ হয়।
আকাশের বিয়ে করে ফিরতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। এতো ক্ষন জেগে থাকতে হবে। বিছানায় বসে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে শেষের কবিতা উপন্যাস পড়ে সময় পার করছি। সবার কাছে নাকি এই উপন্যাস খুব ভালো লেগেছে। আমার মনে হচ্ছে রবী ঠাকুর নিজের প্রশংসা করতে এই উপন্যাস লিখেছেন।
–ভাইয়া আসতে পারি?
বই থেকে চোখ সরিয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম। কালকে যে ছেলে চিরকুট নিয়ে এসেছিলো সে এসেছে। আমি ভেতরে আসার অনুমতি দিলাম। আজ বড্ড ভদ্রতা দেখাচ্ছে। ভেতরে এসে বিছানার উপর নীল খামেত একটা চিঠি রেখে দৌড়ে পালালো। আমি পারলে আজকে খপ করে ধরে ফেলতাম। তারপর জিজ্ঞেস করতাম এই চিঠি কে পাঠাচ্ছে৷ কিন্তু হাতের নাগালেই আসেনি।
বই রেখে এখন চিঠি খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। চিঠি না খুলে আবার বই পড়া শুরু করলাম। চিঠি তার জায়গায় পড়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। মাইমুনা এসেছে ভেতরে আসতে বললাম। ভেতরে এসে চেয়া টেনে নিয়ে ঠিক তিন হাত দূরে বসলো। দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টা মনে আছে দেখে ভালো লাগলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি মনে করে এখানে আসা?”
–ভাবলাম একা একা বোরিং হচ্ছেন নাকি তাই দেখতে এলাম। এখন দেখি আপনার সময় তো আমার থেকে ভালো কাটছে৷- বললো মাইমুনা।
–খারাপ কাটবে কেন?
বিছানার উপর চিঠির দিকে মাইমুনার নজর পড়েছে। চিঠিটা হাতে নিলো। আমি কিছু বললাম না। আমার তো সন্দেহ হয় সেই এই কাজ করছে কিনা।
–বাহ্ নীল খামের চিঠি! প্রেম পত্র নাকি? - বললো মাইমুনা।
আমি বই থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম,“জানি না এখনো খুলে দেখিনি।”
তার চোখেমুখে অনেক আগ্রহ লেপ্টে আছে। হয়তো সে চিঠিটা খুলে দেখতে চায়৷ কিন্তু আত্মসম্মানবোধ তাকে আটকিয়ে রেখেছে। এই আত্মসম্মানবোধ যার মধ্যে আছে সে কখনো খারাপ কাজে মননিবেশ করতে পারে না। মুগ গোমড়া করে চলে গেল মাইমুনা। আমিও চিঠিটা ব্যাগে তুলে রেখলাম। যেখানে আমার গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকে। এই চিঠিটার প্রতি কোন আগ্রহ আমার নেই তবু কেন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের সাথে রাখতে মন চাইলো জানি না।
বিয়ের পর আরো দু'দিন থেকে গেলাম নয়নের বাড়িতে। এই দু'দিনে চারটা চিঠি এবং চারটা কল এসেছে আননোন নাম্বার থেকে। চিঠি গুলো সেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের সাথে রেখেছি। একবার কল রিসিভ করেছিলাম শুধু নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়, কোন কথা বলে না। তারপর আর রিসিভ করিনি। আমি যদি তার প্রেমিক হতাম তাহলে বোধহয় তার নিশ্বাসের শব্দে তাকে চিনে ফেলতাম।
ঢাকায় ফেরার পরেও রোজ একটা করে চিঠি আসতো। ঠিকানা বা কোন নাম লেখা থাকে না৷ কুরিয়ার বয় বলতে পারে না কে পাঠিয়েছে। যাস্ট একটা নীল খামে প্রাপকের ঠিকানা। মানুষটার প্রতি আমার আগ্রহ অনেক বেড়েছে। এই ডিজিটাল যুগে সে আমাকে চিঠি দেয়। কিন্তু আমার চিঠি পড়তে ইচ্ছে করে না। চিঠি পড়ার বদলে একটা বড় উপন্যাস পড়ে ফেলতে কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু কয়েক লাইনের চিঠির ভাজ খুলে দেখতেও ইচ্ছে করবে না।
ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ মাইমুনার সাথে দেখা হয়ে যায়। এই মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে, জানি না। মাইমুনার সাথে তার এক বান্ধবীও ছিল। মেয়েটা আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিলো।
–কেমন আছেন ভাইয়া?-মাইমুনা জিজ্ঞেস করলো।
–জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
–এইতো ভালো।
–তা আপনি আমাদের কলেজে কি করেন?
–আমি এই কলেজেই পড়ি। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে।
–ওহ আচ্ছা,তাহলে তো আমার জুনিয়র।
–চলেন না ক্যানটিনে বসে এক কাপ কফি খাই৷-মাইমুনার বান্ধবী বললো।
অদ্ভুত মেয়ে। কোন কথা নাই ,পরিচয় নাই কফির অফার দিয়ে বসলো। আমার ইতস্তত বোধ হচ্ছে। আমি কিছু বলতে যাব ওমনি মাইমুনা বলে উঠলো,“উনার দাদি মেয়েদের সাথে কফি খেতে না করেছে। কথা বলতেই না করেছে। আর তুই কফির অফাস দিস!”
আমি আহাম্মক হয়ে গেলাম। মাইমুনার বান্ধবী মুচকি হাসতেছে। এর উচিৎ জবাব দিব কিন্তু কি জবাব দিব সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না। কোন কিছু না ভেবে দাদির কথা অমান্য করে কফির জন্য রাজি হয়ে গেলাম। সচারাচর দেখে এসেছি কফির বিল ছেলেরাই দেয় কিন্তু এখানে ব্যাতিক্রম হলো।
মেছে ফিরে টেবিলের উপর একটা চিঠি দেখতে পেলাম। নিশ্চয়ই সেই মেয়েটি চিঠি পাঠিয়েছে। আজকে পড়তে ইচ্ছে হলো। নীল খামের ভেতরে লাল কাগজে লিখা,
“আপনি এটা ঠিক করেননি। কোনদিন আমার চিঠির উত্তর দিলেন না। কিন্তু আজকে অন্য এক মেয়ের সাথে কফি খেলেন কেন? স্ত্রীর হক নষ্ট করলেন। এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। এর পর ভুলেও আমি ছাড়া অন্য কারো সাথে কথাও বলবেন না।”
বড় হাস্যকর চিঠি। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা করছে। এই একটা চিঠি পড়ে বাকি চিঠি গুলো পড়ার আগ্রহ হলো। চিঠি গুলোর প্রতি কোন আগ্রহ ছিলোনা তবু কেন যত্নে রেখেছি তা জানি না। চিঠি গুলো বের করলাম।
চিঠি গুলোতে খুব যত্নে একটা শব্দই লেখা হয়েছে। কিছু চিঠিতে এক শব্দ সুন্দর করে আর্ট করেছে। আবার কিছু চিঠিতে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে ঐ এক শব্দ লিখেছে। শব্দটা হলো, ভালোবাসি।
আমার বাবা-মা ছাড়া কেউ যে আমাকে এতটা ভালোবাসতে পারে এটা আমি আগে বিশ্বাসই করতাম না। এখন বিশ্বাস করে পড়েছি দোটানায়। এদিক দিয়ে মাইমুনাকে আমার খুব পছন্দ সেও সম্ভবত আমাকে পছন্দ করে। অন্যদিক দিয়ে কেউ আমাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসে। এখন যাকে আমি ভালোবাসি তাকে গুরুত্ব দিবো নাকি যে আমাকে ভালোবাসে তাকে আমি গুরুত্ব দিব!
নয়ন রুমে প্রবেশ করলো। আমাকে বিষন্ন ভগ্নহৃদয় নিয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,“কি মহারাজ! মন খারাপ কেন?”
–তোকে একটা প্রশ্ন করি তুই ঠিক ঠিই উত্তর দিবি৷
–কি প্রশ্ন?
–আমি যাকে ভালোবাসি তার সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখবো? নাকি যে আমাকে ভালোবাসে তার সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখবো?
–এটা বাচ্চা পোলাইপানকে জিজ্ঞেস করলেও বইলা দিব।
–আমি তোরে জিজ্ঞেস করছি তুই বল।
–দেখ ভালোবাসা জিনিসটা খুবই ক্রিটিক্যাল।একতরফা ভালোবাসা হলে দূর থেকে ভালোবাসাই ভালো। ভালোবাসা কখনো স্পর্শকাতর হয় না। যদি স্পর্শকাতর হয় তবে বুঝতে হবে ওটা ভালোবাসা না শারীরিক সুখ মেটানোর উপায়।
নয়নকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করলেই জ্ঞান দেওয়া শুরু করে। ওর জ্ঞান দেওয়া বিষয়টা আমি পছন্দ করি না। যেটা জিজ্ঞেস করছি সেটার উত্তর না দিয়ে জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছে।
আমি বিরক্ত সুরে বললাম,“যে প্রশ্ন করছি তার উত্তর দে ওসব ভালোবাসা সম্পর্কে আমিও জানি।”
–শোন,তুই যাকে ভালোবাসিস তাকে সব সময় খুশি রাখতে চাইবি। যেকোন মূল্যে তাকে সুখি রাখার ইচ্ছে পোষণ করবি। আর যে তোকা ভালোবাসবে সে চাইবে তুই যেন ভালো থাকস, সুখে থাকস৷ এখন তুইই ভেবে দেখ কি করবি, কাউকে সুখি রাখবি নাকি নিজে সুখে থাকবি। তোর ইচ্ছে।
–তুই হলে কি করবি?
–কোন কিছু না ভেবে তাকে বেছে নিবো যে আমাকে ভালোবাসে।
আমার ব্রেন কাজ করছে না কি করবো। আমি মাইমুনাকে হারিয়ে আফসোস করতে চাই না। আবার যে আমাকে ভালোবাসে তাকেও ধরে রাখতে চাই। এটা নিছক স্বার্থপরের মতো চিন্তাভাবনা। এক্ষেত্রে আমি একটু স্বার্থপর হতে চাই। নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে।
স্বীদ্ধান্ত নিয়েছি মাইমুনাকে সব খুলে বলবো। পরেরদিন কলেজে গিয়ে খুঁজে পেলাম না। পরপর তিন দিন খুঁজে না পেয়ে আমি বেশ চিন্তিত। ওদের ডিপার্টমেন্টের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ মাইমুনার খবর জানে না৷
মাইমুনাকে খুঁজে না পেয়ে বিষন্ন ছিলাম। প্রতিদিনের চিঠিগুলো বিষন্নতায় সতেজতা এনে দিতো।
সপ্তাহ খানিক পরে মাইমুনার বান্ধবীর সাথে দেখা। সে বললো, মাইমুনা গ্রামে গেছে, ক'দিন কলেজে আসবে না। সেমিস্টারের সময় এসে শুধু পরীক্ষা দিয়ে যাবে৷ সেমিস্টারের আরো এক মাস আছে। এতো দিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। নয়নকে বললে অন্য কিছু মনে করতে পারে। হাজার হলেও তার চাচাতো বোন তো! তাই নয়নকে কিছু না জানানো ভালো মনে করলাম।
একমাস পরেও মাইমুনার দেখা নাই। পরীক্ষা দিলো না সে। তার বান্ধবীর হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে লিখা,“আমার খোঁজ না করাই উত্তম। ভালো থাকবেন।” লেখা গুলো অনেক পরিচিত মনে হচ্ছিলো। সেদিনের পর থেকে চিঠি পাওয়া বন্ধ হলো। আমারও বুঝতে বাকি রইলো না, মাইমুনাই সেই মেয়ে যে আমাকে রোজ চিঠি পাঠাতো। সে আমাকে এতো ভালোবাসে তবু খোঁজ নিতে মানা করার কারণ বুঝলাম না। সে যেহেতু না করছে সেহেতু আমার খোঁজ না নেওয়াই উচিৎ।
কয়েকদিন পরে,
-“দোস্ত সুখবর আছে রে।”-বললো নয়ন।
আমি বই পড়ছিলাম। বইটা রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
–কি সুখবর?
–তোর জন্য আরেকটা বিয়ের দাওয়াত আছে। এবার মেয়ের বিয়ে।
–তাই নাকি? তা কার বিয়ে?
– আমার চাচাতো বোন মাইমুনার বিয়ে। তুই সম্ভবত চিনিস আমাদের কলেজেই পড়ে অনার্সে।
আমার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিমিষেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো৷ নয়ন যেন কিছু বুঝতে না পারে মুখের হাসিটা ধরে রাখলাম।
বললাম,–বেশ তো যাবি বিয়েতে৷
–তোকেও নিয়ে যাবো। এবার খুব মজা হবো।
–আরে না দোস্ত আমার বাড়িতে যেতে হবে। এবার বাড়িতে দু-মাসে থেকে আসবো।
–এতোদিন কেন?
–এমনি আম্মা যাইতে বলছে।
আম্মা যাইতে বলছে এটা তো শুধু মাত্র অজুহাত ছিলো। হঠাৎ নিজেকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছে। আবাগে তরান্বিত হচ্ছি। এখানে থাকলে কান্না করতেও পারবো না। মেছে থেকে বেশি শব্দে হাসাও যায় আবার উচ্চশব্দে কাঁদাও যায় না। আমি বিষন্ন হয়ে বসে থাকবো এজন্য অনেকে হাজার প্রশ্ন ছুড়ে মারবে যার উত্তর দিতে পারবো না। গ্রামে গিয়ে নিরিবিলিতে নির্জন একটু কাঁদলে কেউ খেয়াল করবে না। মনটাও হাল্কা হয়ে যাবে।
বছর পাঁচ কেটে গেল।
কিভাবে সময় চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে ভেবেছি তাকে। রোজ কল্পনায় এঁকেছি তাকে। কেউ আমাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসতো কিন্তু সময় মতো আমি বুঝতে পারিনি। সারাটা জীবন আফসোস করে কাটাতে হবে।
স্টেশনে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেন আজকে অনেকটা লেট করেছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম মাইমুনার মতো দেখতে এক মেয়ে তার সন্তানের কপালে চুমু দিচ্ছেন। দেখে আমার হ্রদ স্পন্দন তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিবাহিতা রমনীকে মেয়ে সম্বোধনে মানায় না, মহিলা ভালো শোনায়। একবার ভাবলাম নাম ধরে ডাক দিবো, তারপর ভাবলাম অনেকটা বছর কেটে গেছে হয়তো আমি এখন তার লাইফে কেউ না তাই ডাক দেওয়া ঠিক হবে না৷ তাকে তার মতো বাঁচতে দেওয়া উচিৎ। ছেলেটা খুবই দুষ্ট মেয়েটির কোলে থাকতেই চাইছে না। আমি এখনো শিউর না যে ইনি মাইমুনা৷
স্টেশন মাস্টারের রুমের দিকে রোওনা দিয়েছি তখনই কে যেন পেছন থেকে আমার নাম ধরে
ডাকলো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়েটি হাত তুলে ইশারা করছে। আমি কাছে গেলাম।
–আমাকে চিনতে পারছেন? –মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো।
আমার উত্তর দেওয়া ঠিক হবে না। এতোক্ষণে বুঝে গেছি ইনিই মাইমুনা। সে বললো,“চেনার পরেও কথা বলতে এলেন না! তাহলে বোধহয় ডাক দিয়ে আমার ভুলই হলো। দুঃখিত।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম,“তোমার ছেলে?”
–ছেলে না মেয়ে।
–কি নাম রেখেছো?
–আলিফ, নামটা ওর বাবাই রেখেছে।
–তোমার হাসবেন্ড বোধহয় সাথেই আছেন নাহ?কোথায় ওনি? পরিচয় করিয়ে দিবা না?
–আমার বর নেই।
হতভম্ব হওয়ার মতো অবস্থা হলো আমার৷ নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,“তাহলে এই বাচ্চা কার?”
–বোনের।
–তোমার না বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো।
–হয়েছিলো।
সে এমন করে কথা বলছে কেন বুঝতে পারছি না। হয়তো আমার প্রতি অনেক রাগ অভিমান জমে আছে।
–তারপর?- জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–এক্সিডেন্টে আমাদের গাড়িতে থাকা আমার বর সহ সবাই মারা যায়, একমাত্র আমি বেঁচে গেছি । তারপর আর কি! সবার কাছে অলক্ষুণে ডাক নাম পেয়ে গেলাম। এরপর কি আদৌও বিয়ে সম্ভব?
–তোমার আপা আর দুলাভাই কোথায়?
–দুলাভাই আপাকে টয়লেটে নিয়ে গেছে। কেন?
–না, এমনি। আমাদের বিয়ের কথা বলতাম এই আর কি!
সে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। অনেকটা নার্ভাস ফিল করছি।
–তোমার দাদি এ ব্যাপারে কিছু বলে নাই?-মাইমুনা জিজ্ঞেস করলো।
–হুম বলেছে তো। সে মারা যাওয়ার আগের বলেছে, তোর জীবনেও একদিন ভালোবাসা আসবে, সত্যিকারের ভালোবাসা। তাকে একবার পেয়ে হারাস না যেনো। আমার মনে হয় তোমাকেএএ আমি ভালোবাসি।
–ভালোবাসা কি বুঝো?
–ভালোবাসা ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না, অদৃশ্য অদ্ভুত অনুভূতি। দাদি বলেছেন ভালোবাসা সম্পর্কে শুনতে চাইলে বিয়ে করে বিয়ের পর বলবি।
মাইমুনা মুচকি হাসলো। হয়তো উপরওয়ালা তাকে আমার জন্যেই সৃষ্টি করেছে তাই অন্য কারো হতে দেয়নি।
আসলে ভালোবাসাকে মুক্ত পাখি মতো ছেড়ে দিতে হয়। সে যদি আমার ভালোবাসা বুঝে তবে নিশ্চয়ই বেলা শেষে আমার কাছেই ফিরবে। তার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে সে পথ ভুলে অন্যের ফাঁদে পা ফেলবে। সে যদি আমার জন্য সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সে আমারই।
লিখাঃ জুবায়ের আল মাহমুদ