রিং
(১)
গভীর রাতে টেলিফোনের শব্দে আতঙ্কিত হবে না এমন মানুষের সংখ্যা এ পৃথিবীতে কম। আজগর ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাকে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করতে হয়। সুতরাং রাতের ঘুমটা তার হয় খুব গাঢ়। সেই ঘুম কাটিয়ে যখন সে টেলিফোন ধরল, তখন টেলিফোন কানে নিয়ে সে নিজের হৃদপিন্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। মনে হচ্ছে জিনিসটা বুক ফেটে বের হয়ে আসবে। হার্টের সমস্যা তাদের খানদানি অসুখ। তার দাদা এ রোগে মারা গেছে, তার তিন চাচা এই রোগে মারা গেছে। মনে হয় তার ভবিষ্যতেও একই ঘটনা ঘটবে। নিজেকে ধাতস্থ করে সে যখন, টেলিফোনের কথোপকথনে মন দিল, তখন তার বিছানার পাশের অ্যালার্ম ক্লকটিতে বারোটা বেজে গেছে। যে খবর তার ছোটভাই শুনালো তাতে তার নিজেরও বারোটা বেজে যাবার জোগাড়। তার ছোট ভাই অত্যন্ত বাচাল একটা মানুষ। সামান্য কথা ফেনিয়ে ফেনিয়ে বিশাল লম্বা করে ফেলে। তার বাবার যে হার্ট এ্যাটাকের মত হয়েছে, এটা আবিষ্কার করতে তার পাঁচ মিনিট সময় নষ্ট হয়ে গেল। এ যাত্রায় তিনি টিকে গেছেন। তবে পুরোপুরি বিপদমুক্ত নয়। হার্টে একাধিক ব্লকেজ ধরা পড়েছে। জরুরী ভিত্তিতে মেডিকেটেড রিং পড়ানো দরকার।
(২)
তার পরিবারের সেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সে এয়ারপোর্টে ছোট্ট একটা চাকরি করে। কাজটা তার খুবই অপছন্দের। বিদেশ ফেরত লোকেরা যখন পেশাব করে বের হয়ে আসে তখন সে তাদের হাতে রঙিন টিস্যু পেপার তুলে দেয়। একজন মানুষ, যে একটু আগে তার শরীরের সবচাইতে নোংরা অংশটি ছুঁয়েছে তার হাত ছুঁয়ে টিস্যু পেপার ধরিয়ে দেবার মধ্যে এক ধরনের গ্লানি কাজ করে। কিন্তু পেটের কাছে আমরা সবসময় পরাজিত হই।
(৩)
তার পরিবারের লোকজন অবশ্য জানেনা তার চাকরির বিবরণ। তারা ধরেই নিয়েছে সে বিমানবন্দরে ভদ্র ভালো বেতনের কোন একটা চাকরি করে। আর তাই যখনই কোন বিপদ আপদ আসে তারা মনে করে সেই হচ্ছে তাদের ত্রাণকর্তা। তার কাছে আলাদিনের চেরাগ আছে, একটা ঘষা দিলেই মুশকিল আসান হবে।
(৪)
আলাদিনের ভূমিকায় অভিনয় করতে তার খারাপ লাগে না। কারণ এতদিন পর্যন্ত সমস্যা ছিল ছোটখাটো। কিন্তু আজকের সমস্যার বিবরণ শুনে তার মাথায় বাজ পড়লো। তার বাবার আর্টারি ব্লকেজ হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে তিনটি রিং পড়াতে হবে। খরচ সর্বসাকুল্যে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এ টাকা এখন সে কোথায় পাবে, সে চিন্তায় বাকি রাতে তার আর ঘুম আসলো না। যদিও তার জন্য ঘুমানোটা খুব জরুরী। ডিউটির পুরোটা সময় তাকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাথরুমের মধ্যে কোন চেয়ার-টেবিল থাকেনা। সারারাত না ঘুমিয়ে কালকে ডিউটি করা তার জন্য বেশ কষ্টকর হবে।
(৫)
আরো একজন মানুষ আজ রাতে ঘুমাতে পারছে না। তার নাম আলমগীর হোসেন। তার সমস্যা আজগর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রবাসী এই ভদ্রলোক পেশায় একজন ব্যবসায়ী। পেট্রল পাম্প রয়েছে। আজ সকালে তিনি যখন সেখানে কাজ করছিলেন, তখন একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। একজন লোক তার মানিব্যাগ টি কাউন্টারে ফেলে চলে যায়। তিনি লোকটির পরিচয় জানবার জন্য মানি ব্যাগটি খুলে এক অদ্ভুত ফাপড়ে পড়লেন।
(৬)
সেখানে কোনো পরিচয় পত্র ছিলনা, কিন্তু ২৫ টি ১০০ ডলারের নোট। তিনি যে এই প্রথম তার দোকানে টাকা খুঁজে পেয়েছেন এমন নয়, এই ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। তবে সামান্য পরিমাণে। যেমন হয়তো বাইরে পাম্পগুলো থেকে যখন সারাদিন কত বেচা কেনা হলো তার মেকানিক্যাল রিডিং আনতে যান তখন মাঝে মধ্যে পার্কিং লটে টাকা পড়ে থাকে। তিনি এ জন্য একটি ছোট্ট কৌটা রেখেছেন, যেখানে পড়ে পাওয়া টাকা গুলি তিনি জামা করে রেখে দেন। দেশে যাওয়ার সময় তিনি সারা বছর ধরে জমা হওয়া সেই টাকা সাথে করে নিয়ে এতিমখানায় দান করে দেন।
(৭)
কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। এত টাকা একসাথে কখনো পান নাই। পুরো একটা মানিব্যাগ কখনো কেউ ফেলে চলে যায় না। তার টাকাটা পুলিশে দেওয়া উচিত। কিন্তু ভিতরে যেহেতু কোন যোগাযোগের ঠিকানা বা ফোন নাম্বার নেই সুতরাং পুলিশ তাদের লস্ট এন্ড ফাউন্ড ডিপার্টমেন্টে সম্ভবত মানিব্যাগটা জমা দিয়ে দিবে। সেখানেই বছরের পর বছর ধুলা ধূসরিত হয়ে মানিব্যাগটা পড়ে থাকবে।
(৮)
তিনি কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলেন না কি করা ঠিক হবে? অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। তার কাল বাদে পরশু দেশে যাবার কথা। তিনি এই দুই দিন অপেক্ষা করবেন যদি কেউ মানিব্যাগটার সন্ধানে ফেরত আসে। যদি না আসে তবে তিনি টাকাটা পরশুদিন সাথে করে দেশে নিয়ে যাবেন।
(৯)
সব প্রতীক্ষাই একদিন শেষ হয়। এটাও হল। পরবর্তী দুদিন তিনি অপেক্ষায় ছিলেন, যদি কেউ ফেরত আসে।কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে এতগুলো টাকার দাবি নিয়ে কেউ মানি ব্যাগটির সন্ধানে আসলো না। এতগুলো টাকা, হারিয়েও কেউ খোঁজ করবে না তা কি করে হয়? এখানে খুব সম্ভবত দুটো ব্যাপার হতে পারে। প্রথমত যে টাকাটা হারিয়েছে, সে হয়তো মাতাল ছিল। তার স্মৃতি তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে ।যখন তার সম্বিৎ ফিরে এসেছে, তখন সে মনে করতে পারছিল না, মাতাল অবস্থায় কোথায় গিয়ে টাকাটা ফেলে এসেছে। আরেকটা ব্যাপার হতে পারে । হয়তো লোকটা অবৈধ মাদক ব্যবসা করে। এই টাকা খুঁজতে এসে, হয়তো অন্য কোন বিপদে পড়ে যাবে, এমন আশঙ্কা করেছে। কারণ যদি মাদক ব্যবসায়ী হয়, তবে সে চিন্তা করে দেখেছে, যদি দোকানদার পেয়ে থাকে, তবে সে যদি সৎ হয়, তবে সে টাকাটা পুলিশে জমা দিয়েছে। পুলিশের কাছে এই টাকাটা আনতে গেলে, পুলিশ প্রথমে জিজ্ঞেস করবে, এতগুলো টাকা নিয়ে সে কেন ঘুরছিল? এত টাকা সচরাচর কেউ নগদ নিয়ে ঘুরে না।আর যদি দোকানদার টি অসৎ হয় তবে সে কোনদিন স্বীকার করবে না টাকা ভর্তি মানিব্যাগ সে পেয়েছে।
(১০)
আলমগীর সাহেব যখন দুবাই এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন তখন মধ্যদুপুর। এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল ওয়েটিং লাউঞ্চ টা দেখে তিনি যারপরনাই হতাশ হলেন । যাত্রীদের বিশ্রাম করার জন্য সেখানে প্রচুর আরাম কেদারার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মধ্য দুপুরে মরুভূমি র উচ্চ তাপমাত্রার ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষের খেয়াল করা উচিত ছিল। আরাম কেদারাগুলোর অবস্থান এমন একটা জায়গায় , যেখানে দুপুরের কড়া রোদ পুরো জায়গাটা কে উত্তপ্ত করে রেখেছে।
(১১)
তিনি অত্যন্ত মিতব্যয়ী একজন মানুষ। তার যদিও হালকা খুদার মত লাগছিল, কিন্তু তিনি ঠিক করলেন উপোস দিবেন। সামান্য একটু বার্গার আর আলু ভাজির দাম প্রায় ২০ ডলার। এ টাকাটা তার কাছে কোন ব্যাপার না। কিন্তু অপচয় করতে তার খুব খারাপ লাগে। আর তাই তিনি যখন দেশে যান, তখন খুব হিসাব করে টাকা সাথে করে নিয়ে যান। কারণ এ ব্যাপারে তার অতীতের অভিজ্ঞতা বেশ খারাপ। যত টাকাই সাথে করে নিয়ে যান, দেখা যায় ফিরবার সময় তিনি কপর্দকশূন্য।
(১২)
তবে এবার তিনি প্রয়োজনের চাইতে ৫০০ ডলার বেশি নিয়ে যাচ্ছেন। সামনেই রোজার ঈদ। তিনি দেশ থেকে ফেরা মাত্র রোজা শুরু হবে। তার ছোট মেয়ে মাত্র ১০ পেরিয়ে ১১ য় পড়েছে। তিনি তার মেয়েকে এবার রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করবেন। এবং উপহারস্বরূপ তার মেয়েকে একটি ঝলমলে লেহাঙ্গা ঈদে দেবেন বলে ঠিক করেছেন। বোম্বের সিনেমা দেখে দেখে তার মেয়ের লেহেঙ্গা পড়ার খুব শখ হয়েছে। এক মেয়েকে দিলে বড় মেয়েকে দিতে হবে। সুতরাং তাকে দুটো ঝলমলে লেহেঙ্গা কিনতে হবে। এছাড়া তার স্ত্রীর জন্য ঈদে তার একটি মিরপুরের কাতান নেবার খুব শখ। ছোটবেলায় তাদের মিরপুরের বাড়িতে যেসব অবাঙালীরা ভাড়া থাকতো, তারা একরকম কাটা দিয়ে কাঠের ফ্রেমের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর কাতানের কাজ করতো। সেইসব চুমকির কাতানের কাজ এখনো তার চোখে ভাসছে। উপরের বৈদ্যুতিক তার থেকে ঝুলতে থাকা বাল্বের আলোয় সে শাড়িগুলো কেমন ঝলমল করতে থাকতো।
(১৩)
আলমগীর সাহেব কে বহনকারী বিমানটি যখন ঢাকার মাটি স্পর্শ করছিল, তখন প্রায় মধ্যরাত। আজগর ইমিগ্রেশনের বাইরের শৌচাগারে নিজেকে প্রস্তুত করছিল। প্লেন নামার পর পর কিঞ্চিৎ ব্যস্ততা বাড়ে। কিন্তু সে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিল না। আজ দুদিন ধরে একটা জিনিসই তার মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিভাবে বাবার রিংয়ের টাকা জোগাড় করবে। এটা সত্যি অধুনা সরকার মেডিকেটেড রিং এর দাম ন্যায্যমূল্যে সবার জন্য স্থির করে দিয়েছে, কিন্তু তবুও তা তাদের মত নিম্নবিত্ত পরিবারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত কদিন ধরে একটানা চিন্তা করিও সে এই সমস্যার কোন কূলকিনারা করতে পারছে না। মনে হয় বাবাকে সে বাঁচাতে পারবে না। তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
(১৪)
আলমগীর সাহেব যখন প্লেন থেকে বের হয়ে সুরঙ্গ পথ ধরে এয়ারপোর্টের দিকে হেটে যাচ্ছিলেন তখন তার কিঞ্চিত শীত শীত করছিল। যদিও ঢাকাতে তখন শীত যাই যাই করছে। দিনটি ফেব্রুয়ারি মাসের বোনাস দিন, ২০২০। সালটি শুধু যে লিপ ইয়ার তাই নয়, আরও একটি কারণে এবছর টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। করোনাভাইরাস নামে একটি অদৃশ্য শত্রু সূর্য গ্রহণের মত পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে গ্রাস করে নিতে চাচ্ছে তার করাল থাবায়।
(১৫)
দেশে ঢুকবার মুখে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ওয়াকিং থার্মাল থার্মোমিটারে ব্যবস্থা করেছেন। যার নিচে দিয়ে হেঁটে গেলে, যাত্রীর শরীর যদি উত্তপ্ত থাকে, তবে এটির শব্দ করে উঠবার কথা। আলমগীর সাহেব মনেপ্রাণে চাচ্ছিলেন তার এই শীত শীত ভাব যেন ঋতুজনিত কারনে হয়। কারণ জ্বর আসার আগে আগে ও তার শরীরে শীত শীত অনুভূতি হয়। এটা তার একটি জ্বরের উপসর্গ। শরীর খারাপ হবার আগে তার শরীর তাকে জানান দেয়, জ্বর আসছে।যদি সত্যিই জ্বর থেকে থাকে তবে এরা হয়তো তাকে ১৪ দিনের কোরান্টিনে পাঠিয়ে দিবে। তিনি দেশে এসেছেনই দুই সপ্তাহের জন্য। পুরোটা সময় যদি অন্তরীণ অবস্থায় কেটে যায়, তাহলে যে কাজে এসেছেন সেই কাজগুলো গুছাবেন কিভাবে?
(১৬)
তার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে, যন্ত্রটি কোন শব্দ করল না। তার মনে হল তার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। দুবাই থেকে ঢাকা পৌঁছানোর আগে আগে তার বেশ পেশাবের বেগ এসেছিল। কিন্তু বিভিন্ন উত্তেজনায় এতক্ষণ তো ভুলেই ছিলেন। এখন আবার তার বাথরুম যাবার কথা মনে পড়লো। তিনি ব্যাগেজ ক্লেইম এরিয়াতে যাবার আগেই বাথরুম যাবার মনস্থির করলেন। লাগেজ নিয়ে বাথরুমে যাবার প্রশ্নই আসেনা। অনেক সময় বাথরুমের মেঝে নোংরা পানিতে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকে। সেখানে লাগেজ রাখার প্রশ্নই আসেনা।
(১৭)
আলমগীর সাহেব বাথরুম থেকে বের হয়ে যে দৃশ্য দেখলেন, তার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। দেখেন, বাথরুম অ্যাটেনডেন্ট ছেলেটি হাতের রঙিন টিসু পেপার দিয়ে ক্রমাগত চোখ মুছে চলেছে। তিনি প্রায় তিন দশকের উপর আমেরিকায় বসবাস করছেন। পাশ্চাত্য দেশগুলোর নিয়ম হলো কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলায় না। এতদিন বিদেশে থাকবার কারণে তার এই অভ্যাসটি আয়ত্তে আসা উচিত ছিল, কিন্তু তিনি যুবক বয়সের এই ছেলেটিকে এড়িয়ে যেতে পারলেন না। তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,"ভাই আপনি কাঁদছেন কেন? আমাকে কি বলা যায়?"
(১৮)
আমেরিকানরা একটা কথা খুব বলে,"timing is everything,you have to be at the right place at the right time."কথাটার মধ্যে কিছুটা সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। আজগর যখন তার পুরো সমস্যার কথা আলমগীর সাহেব কে বলছিল, তখন তিনি মনে মনে এই কথাই ভাবছিলেন। তিনি কখনো বাড়তি টাকা সাথে আনেন না। কিন্তু এবার মানিব্যাগ পাবার কারণে পুরো টাকাটা সাথে করে নিয়ে এসেছেন দান করে দেবেন বলে।
(১৯)
তিনি আজগরকে মানিব্যাগের পুরোটা টাকা দিয়ে দিলেন। টাকাটা পেয়ে আজগরের কান্না থেমে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মানুষের কান্নার ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। অপ্রত্যাশিত কষ্টে যেমন মানুষ কাঁদে, তেমনি অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও অনেক সময় কাঁদবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, কান্না নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবার। কিন্তু মানুষের হাসি-কান্নার ব্যাপারটা অনেকটা নদীর স্রোতের মতো। বাধা দিলে তার তীব্রতা বেড়ে যায়। এখানেও তাই হল। তার কান্না কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রণে আসলে, আলমগীর সাহেব তাকে তার নিজের মানিব্যাগ থেকে আরো ৫০০ ডলার দিয়ে বললেন, সবমিলিয়ে আপনাকে ৩০০০ ডলার দিলাম, ঠিকমতো ভাঙাতে পারলে আড়াই লাখ টাকা হবার কথা, তারপরও আপনি এই বিশ ডলার রাখেন। এটা সেই ২০ ডলার যা তিনি দুবাই এয়ারপোর্টে বার্গার না খেয়ে বাঁচিয়েছিলেন।
(২০)
"এটা আমার বাংলাদেশের ফোন নাম্বার। আমি সপ্তাহ দুয়েক দেশে থাকব। এর মাঝে যদি আপনার বাবার রিং পড়ানো হয়ে যায়, তবে জানাবেন। আপনার বাবাকে দেখতে যাব। ভালো কথা, উনি কোথায় আছেন?"
"হার্ট ফাউন্ডেশন!"
"সেটা কোথায়?"
"শ্যামলীতে, তবে আমরা থাকি মোহাম্মদপুরে, সলিমুল্লা রোড পানির ট্যাংকির খুব কাছে, আমি অবশ্য আলাদা থাকি একটা মেসে, এয়ারপোর্টের কাছে। মোহাম্মদপুর থেকে চাকরি অনেক দূর হয়ে যায় তো।"
"ঠিক আছে, ভালো থাকবেন!"
এই কথাটুকু বলে আলমগীর সাহেব এয়ারপোর্টের বাকি যাত্রীদের মাঝে মিলিয়ে গেলেন।
(২১)
এরপরে প্রবাসীরা দেশে ফিরলে যা হয়,দেশের দিনগুলো তার অসম্ভব ব্যস্ততায় কেটে গেল। হঠাৎ হঠাৎ কোন এক অবসর মুহূর্তে তার আজগরের কথা মনে পড়ে যেত। কিন্তু যেহেতু তিনি তার নাম্বারটি নেননি, তাই যোগাযোগ করতে পারলেন না আজগরের সাথে।আমেরিকা ফিরে যাবার আগের সন্ধ্যায় তিনি যখন লাগেজ গুছাচ্ছিলেন, তখন বহুল প্রত্যাশিত সেই ফোনটি আসলো। আজগরের টেলিফোনে তিনি জানতে পারলেন আজকেই তার বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছে।
(২২)
অনেক ঝামেলা করে তিনি যখন মোহাম্মদপুরে আজগরদের বাড়িতে পৌঁছলেন, তখন রাত বেশ গভীর হতে শুরু করেছে। কিন্তু তিনি আসবেন শুনে বাড়ির প্রতিটি মানুষ তখনও জেগে। আজগরের বাবা তাকে দেখে বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করছিলেন, তিনি হাত দিয়ে ইশারা করলেন না উঠবার জন্য।
"আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?"
আলমগীর সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি সেই হাত দুই হাতের ভেতর নিয়ে বলতে শুরু করলেন,"আমি সারা জীবনের জন্য আপনার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম।"
"এভাবে বলবেন না ভাই, আমি হচ্ছি উছিলা।"
"আমি বুকের ভেতর থেকে দোয়া করছি, আপনার ছেলে মেয়েরা যেন থাকে দুধে-ভাতে।"
"দোয়া করবেন ওরা যেন ভাল মানুষ হতে পারে।"
"সেই দোয়া করা লাগবে না, যাদের বাবা আপনার মতো, তার ছেলেমেয়েরা এমনিতেই ভালো হবে।"
(২৩)
এরপর পৃথিবীটা খুব দ্রুত বদলে যেতে শুরু করল। আলমগীর সাহেব তার পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটা না করেই আমেরিকা ফেরত আসলেন। তিনি ইচ্ছা করলে তার স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা আনিয়ে নিতে পারতেন। সেক্ষেত্রে তাকে তার স্ত্রীকে বলতে হতো, তিনি টাকাটা দান করেছেন। দানের নিয়ম হল এক হাত দিয়ে দিলে অন্য হাতকে ব্যাপারটা জানানো যাবেনা। তাই তিনি ফিরে গিয়ে আমেরিকাতেই তার পরিবার-পরিজনের জন্য ঈদের বাজার করলেন।
(২৪)
ঈদের দিন তার শহরের মসজিদটি বন্ধ ছিল। তাকে যে কোনোদিন ঈদের জামাতের ইমামতি করতে হবে এটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে বাস্তব জীবন আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। ঈদের দিন সকাল বেলা তার স্ত্রী-কন্যারা তার পিছনে যে কাপড় পড়ে এসে ঈদের নামাজ পড়তে দাঁড়াল তা মোটেই জৌলুষপূর্ণ ছিলনা। কিন্তু তার কাছে মনে হল বহুদূর থেকে পাঠানো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এক বৃদ্ধের শুভাশিস এ যেন সে পোশাকগুলো ঝলমল করছিল।
লিখাঃ শাহাদুল চৌধুরী