আলোয় ফেরার দিন
আজ দুপুরে আমার বাবা বাড়ীর সকলের সামনে আমার মাকে একটা চড় মারলেন। আমার মা বাবার চড় খেয়ে কয়েক সেকেন্ড হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে যে কাজটা করছিলেন সেটাই আবার মনোযোগ সহকারে করতে লাগলেন। আজ বিয়ের পর আমি প্রথম আমার স্বামী রেজাকে নিয়ে আমার বাবার বাড়ীতে এসেছি। আমার স্বামী বাবার এহেন কান্ড দেখে এতোই অপ্রস্তুত হয়ে গেল যে, মনে হলো সে বোধহয় আমাদের বাড়ীতে নয় বরং ভুল করে অন্য কোনো গ্রহে চলে এসে এসেছে।
রেজার এমন অপ্রস্তুত ভঙ্গি দেখে আমার ছোট বোন লামিয়া মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে একটু বাঁকা কণ্ঠে বললো, দুলাভাই আপনি শুধু শুধু মন খারাপ করছেন। আমার মায়ের বাবার এসব বাজে ব্যবহার সহ্য করবার অনেক আগে থেকেই অভ্যাস আছে। আজ তো তবুও মায়ের হাত থেকে দামী ফুলদানীটা পড়ে ভেঙেছে বলে বাবা মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করলো। অন্যদিন তো তরকারিতে একটু লবণ কম বেশী হলেও বাবার এমন দুচারটা চড় থাপ্পড় মাকে হজম করতে হয়।
লামিয়ার এই ধরনের কথা শুনে আমি একটু সচকিত হয়ে চারপাশে তাকালাম। ভাগ্য ভালো বাবা আশেপাশে নেই। বোধহয় জোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন। অনেক ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত মসজিদে আদায় করে আসছেন। এছাড়াও রোজ সকালে নিয়ম করে এক ঘন্টা কোরান তেলওয়াত করা, নিয়ম মেনে জাকাত দেয়া, দান খয়রাত করা, পরিবার পরিজন, পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়মিত খোঁজ খবর রাখা, পরিচিত কারো যে কোনো ধরনের বিপদ হলে উনাদের বিপদে সবার আগে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া, আমার বাবার চিরকালের অভ্যেস। এমন নয় যে এগুলো উনি লোক দেখানোর জন্য করেন। বরং এগুলো যে উনি নিজের ইচ্ছে বা মন থেকেই করেন এতদিনে আমরা দুই বোন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। আমাদের দুই বোনের সাথেও বাবার ব্যবহার কিন্তু বেশ মধুর। আমাদের দুই বোনের সাথে বাবা কোনোদিন উঁচু গলায় কথা বলেছেন কিনা আমার মনে পরে না। তবে উনার যত সমস্যা আমাদের মাকে নিয়ে। যে কোনো দুঃখ, কষ্ট, রাগ, অভিমান, না পাওয়ার বেদনা, যন্ত্রনা, অফিসে কাজের চাপ, সবকিছুর অব্যক্ত ক্ষোভ যেন উনি বাসায় সারা জীবন আমার মায়ের উপর দেখিয়েছেন। আমরা দুবোন বাবাকে অনেক বুঝিয়েছি। মায়ের গায়ে যখন তখন এমন হাত তোলবার জন্য বাবার সাথে অনেক অশান্তি করেছি। লামিয়া তো একবার বাবার উপর রাগ করে টানা তিন দিন না খেয়ে ছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বাবা আমাদের কোনো কথাই আমলে নেননি। মায়ের সাথেও আমরা অনেক রাগারাগি করেছি বাবার এসব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করবার জন্য। তাতেও কোনো ফল হয়নি। আমার মা কখনো বাবার এসব অত্যাচারের কোনো প্রতিবাদ করেননি। মুখ বুজে বাবার সকল অত্যাচার সহ্য করে এসেছেন। আসলে মার বাবার এই সংসার ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার আর কোনো জায়গা ছিল না। আমার নানা নানী মারা গেছেন মায়ের জন্মের কয়েক বছর পরেই। মার যে বড় দুই ভাই আছেন তারাও যে যার মতো নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তবে এটা ঠিক যে আমার মামারা কিন্তু নিজের বোনকে অর্থাৎ আমার মাকে ভীষণ স্নেহ করেন। কারন উনারাই নাকি আমার মাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক যত্ন করে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন।
দরজায় নক করবার একটা শব্দ হলো। লামিয়া উঠে যেয়ে দরজাটা খুললো। বাবা মসজিদ থেকে নামাজ শেষে ফিরলেন। বাবা মসজিদ থেকে আসবার পরে যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে আমরা সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসলাম। মা আমাদের খাবার বেড়ে দিছিলেন। খাবার টেবিলে খেতে খেতেই যে সুখবরটা দেবার জন্য আমি আজ রেজাকে নিয়ে বাবার বাড়ীতে এসেছি সেই খবরটা দিলাম। আমার যে খুব ভালো একটা বেসরকারী টেলিফোন কোম্পানিতে চাকরী হয়েছে সেটা সবাইকে জানালাম। খবরটা পেয়ে বাড়ীর পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেল। সবাই ভীষণ খুশী হলো। সবচাইতে খুশী হলেন আমার মা। মা খুশীর চোটে এই হাসেন আবার এই কাঁদেন। বারবার আমার কপালে চুমু খেয়ে বলতে লাগলেন, এই দিনটার জন্য আমি সারাজীবন ধরে অপেক্ষা করেছিলাম, বিশ্বাস কর। আজ আমার সবচাইতে বড় খুশীর দিন। আমি দেখলাম বাবাও ভেজা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন মায়ের চোখের আনন্দ মেশানো অশ্রু এত বছর পর আজ আমার বাবাকেও স্পর্শ করেছে।
রাত নয়টা বাজে। আমি আর রেজা এখন আমাদের বাসায় ফিরবো। আমাদের নতুন সংসার আমার বাবার বাড়ী থেকে খুব বেশী দুরে নয়। আমার বাবার বাড়ী থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে হবে। আমার স্বামী রেজার নিজের গাড়ী আছে। আমাদের বিদায় দিতে বাবা, লামিয়া গাড়ী পর্যন্ত এসেছে। তবে মা কিন্তু আজ আমাদের বিদায় জানাতে গাড়ী পর্যন্ত আসেননি। আমার চাকরীর খবর শুনে সেই যে মা নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছেন এরপর শত ডাকাডাকির পরেও আর দরজা খোলেননি। মাকে ডাকতে গেলেই বলেন, মা নাকি খুব জরুরী একটা কাজ করছেন। কাজ শেষ হলেই বের হবেন। বাবাও কয়েকবার মায়ের ঘরের দরজা নক করে এসেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মা দরজা খোলেননি। আমি আর রেজা মায়ের জন্য আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে গাড়ীতে উঠতে যাবো ঠিক সেই সময় পেছন থেকে মায়ের ডাক।
- তিথি।
- মায়ের গলা শুনে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। তারপর একটু বিরক্ত হয়েই মা কে বললাম, মা তুমি সেই তখন থেকে দরজা বন্ধ করে কি করছিলে বলোতো?
- মা উজ্জল একটা হাসি দিয়ে বললেন ,ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম রে তিথি।
- আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, ব্যাগ গুছাচ্ছিলে? মানে?
- মা এবার বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, এতদিন মুখ বুজে তোর বাবার অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। মনে মনে ভেবেছি তোর বাবার এসব অত্যাচারের প্রতিবাদ করে এই সংসার থেকে যদি আমি বের হয়ে যাই তাহলে তোদের জীবনটাও হয়তো আমার মতো হবে। মাথার উপর বাবা মা দুজনের ছায়া না থাকলে মেয়েদের জীবনটা যে কত কঠিন হয় তা আমার চেয়ে বেশী আর কে জানে বল? তোদের দুবোনের মুখের দিকে চেয়ে হয়তো এভাবেই আমার পুরো জীবনটা পার করে দিতাম। তবে আজ দুপুরে তোর বাবা যখন রেজার সামনে আমার গায়ে হাত তুললো তখনই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, তোদের বাবার সংসারে আমি আর থাকবো না। আজ যদি আমার মেয়ে জামাইয়ের সামনে আমার স্বামীর এমন অত্যাচার আমি মুখ বুজে সহ্য করি তবে কাল আমার মেয়ের স্বামীও আমার মেয়ের উপর এমন অত্যাচার করবার সাহস করবে। আর আমি বেঁচে থাকতে সেটা কখনোই হতে দিব না। আমি কখনোই এটা চাইবো না যে, আমার উপর আমার স্বামী যে পরিমান অত্যাচার করেছে আমার মেয়েরাও সেই একি অত্যাচারের স্বীকার হোক।
মায়ের মুখে এসব শুনে আমার এত ভালো লাগলো যে কি বলবো!! আমি জানি মায়ের কথাগুলো শুনে লামিয়াও নিশ্চয় মনে মনে অনেক খুশী হয়েছে।
- তবে লামিয়া কিন্তু মায়ের কথা শুনে কেঁদে ফেললো। ও কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললো, তুমি এসব কি বলছো মা? তুমি আমাদের একা ফেলে এমন হুট করে কোথায় যাবে?
- তোর বড় মামার বাড়ীতে যাবো।
- আমি এবার মায়ের কথা শুনে জোর গলায় বললাম, তুমি বড় মামার বাড়ীতে কেন যাবে মা? তুমি বরং আমার আর রেজার সাথে আমাদের বাসায় চলো।
- আমার কথা শুনে রেজাও সাথে সাথে বললো, হ্যাঁ মা, তিথি ঠিকই বলেছে। আপনি বরং আমাদের সাথে আমাদের বাসায় চলুন। বিশ্বাস করুন আপনি ওখানে খুব ভালো থাকবেন।
- মা রেজার দিকে তাকিয়ে স্মিত মুখে বললেন, তোমাদের বাসায় আমি অবশ্যই যাবো রেজা। আমি এও জানি যে, তোমাদের ওখানে আমি খুব ভালো থাকবো। তবে আজ আমি তোমাদের সাথে যাবো না রেজা। অনেক দিন পর আজকে আমি খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জীবনের বাকি কটা দিন আমি নিজের মতো করে মাথা উচু করে বাঁচতে চাই।
- মায়ের মাথা উচু করে বাঁচতে চাইবার দৃঢ় সংকল্পের কথা শুনেই কিনা জানি না এবার আমার বাবার গলা শোনা গেল। বাবা একটু বাঁকা কণ্ঠে মাকে বললেন, নিজের সংসার বাদ দিয়ে ভাইয়ের সংসারে গিয়ে খুব মাথা উঁচু করে বাঁচবে, তাই না?
- মা বরাবরের মতো বাবার বাঁকা প্রশ্নের উত্তরে খুব শ্বান্ত গলায় জবাব দিলেন, জানি ভাইয়ের সংসারে যেয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবো না। সেই ইচ্ছেও আমার নেই। আমি কদিন আমার ভাইয়ের সংসারে থাকবো মাত্র। তারপর সিলেটে আমাদের পৈত্রিক বাড়ীটা একটু গুছিয়ে নিয়ে আমি সেখানে চলে যাবো।
- তোমার মেয়েদের কথা তুমি একটু চিন্তাও করবে না?
- বাবার কথা শুনে মা একটু থেমে বললেন, আমার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে আজ পনের দিন হলো। আজ ওর ভালো একটা চাকরীও হয়েছে। আমি জানি আমার ছোট মেয়ে লামিয়াও আর কয়েক মাস পর লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ওর সুন্দর গোছানো একটা সংসার হবে। আমি চাই আমার মেয়েদের সংসারে ওদের জায়গা যেন আমার মতো না হয়। আমি চাই, আমার মেয়েরা যেন ওদের নিজ নিজ সংসারে মাথা উচু করে বেঁচে থাকে। আর ওরা সেটা তখনই করতে পারবে যখন দেখবে, ওদের নিজের মা এভাবে নিজের সংসারে আগাছার মতো বেঁচে না থেকে মাথা উঁচু করে সসম্মানে নিজের মতো করে বেঁচে আছে। মা এরপর লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, মারে তুই আমার উপর মন খারাপ করিস না। মা হিসেবে তিথির প্রতি আমি যেসব দায়িত্ব পালন করেছি তোর প্রতিও আমি সেইসব দায়িত্ব পালন করবো। তোর যে কোনো প্রয়োজনে তুই সবসময় আমাকে পাশে পাবি।
- মায়ের কথাগুলো শুনে আমার এত ভালো লাগছে! এত দিন পর আমি যেন আমার মাকে আমার মনের মত করে ফিরে পেলাম। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, মা শোনো আমি কিন্তু তোমাকে দেখতে রোজ একবার করে মামার বাড়ীতে যাবো। আর আমি নিজে সিলেটের বাড়ীটা ঠিক ঠাক করে তোমাকে ওখানে দিয়ে আসবো। তবে তুমি কিন্তু বেশী দিন একা একা সিলেটে থাকতে পারবে না মা। তোমার মনটা একটু ভালো হলে কদিন পরেই আমি তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে আসবো।
- লামিয়াও বললো, তুমি কোনো চিন্তা করো না মা। আমার মাস্টার্স পরীক্ষাটা শেষ হলেই আমিও তোমার কাছে চলে আসবো।
- আমাদের দুই বোনের মুখে এসব শুনে বাবা যেন একটু নত হয়েই মাকে কিছু বলতে গেলেন। তবে আজ আর মায়ের কান পর্যন্ত বাবার মুখের কোনো কথা পৌঁছালো না। বাবার কোনো কথা না শুনেই আমাদের চিরচেনা নরম স্বভাবের মা গাড়ীতে উঠে বসলেন। আমি আর রেজাও মায়ের পেছন পেছন গাড়ীতে উঠলাম। মনে মনে ভাবলাম, বাবার আসলেই একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। উনি এতদিন মায়ের সাথে যে ব্যবহারগুলো করেছেন সেটা মোটেও ঠিক করেননি।
গাড়ীতে উঠে একবার ভাবলাম মাকে নাহয় আরেকবার একটু বুঝিয়ে, আমাদের সাথে আমার আর রেজার ওখানে নিয়ে যাই। তবে পরমুহুর্তেই নিজের এই চিন্তা বাদ দিলাম। আজ আমার মায়ের মুক্তির দিন, নিজের এত দিনের অসম্মান, অযত্ন, অবহেলায় ভরা জীবন থেকে, সামাজিক নিয়ম রীতিতে জড়ানো অযথা এই নিয়মের বেড়াজাল থেকে। আজ নাহয় আমার মা নিজের খোলা আকাশে একটু ইচ্ছেমতোন ঘুরুক। আজ থেকে নাহয় মা, আমাদের দুই বোনের মা হয়ে নয় বরং একজন নারী হয়ে আবার নতুন করে বাঁচুক। আর আমি? আমি না হয় তিথি হয়ে, আমার মায়ের আত্মজা হয়ে, সর্বোপরী একজন নারী হয়ে আজ জন্ম নেয়া নতুন এই নারীটির পাশে সারাজীবন বন্ধুর মতো থাকবো।
লিখা: তামান্না স্মৃতি
Comments