বি লেটেড হ্যাপি বার্থডে
ধরুন, আপনি নব্য প্রেমে পড়েছেন। প্রেয়সীর ধরন-ধারণ কিছুই বুঝতে পারছেন না। রবি বাবুর ভাষায়-
'তুমি কোন্ কাননের ফুল, কোন্ গগনের তারা
তোমায় কোথায় দেখেছি যেন কোন্ স্বপনের পারা।'
প্রেমিকার সাথে কঠিন ঝামেলা করলেন। মন খারাপ করে বাড়ি এলেন। দুজনের কথা বন্ধ। রাতে শুয়ে মনে হল, ভুল আপনারি ছিল, কিন্তু ইগোর কারণে মেনে নিতে পারেন নি। সমস্যা নেই, এই সমস্যাই রবি বাবুও পড়েছেন। সেই গান শুনিয়ে দিন। কোনো পাষাণীর সাধ্য নেই আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখে।
'যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
তারে বুঝিতে পারি নি।
দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে।।
কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,
কে মোরে ডাকিবে কাছে,
কাহারো প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে।'
প্রেমিকার উপর কঠিন অভিমান করলেন। বার বার ফোন দিয়ে আপনার রাগ ভাংগানোর চেষ্টা চলছে। আপনি রবি বাবুর শরণাপন্ন হলেন।
'ডেকো না আমারে ডেকো না।
দূরে যাব যবে সরে,
তখন চিনিবে মোরে
আজ অবহেলা ছলনা দিয়ে ঢেকো না!'
প্রেয়সীর সাথে সুদীর্ঘ বিরহকাল চলছে। প্রবল কাতরতা তাকে দেখার জন্যে। স্বপ্নে, জাগরণে শুধু একটাই মুখ ভাসে। রবি বাবুর ভাষায়-
'আমি আশায় আশায় থাকি।
আমার তৃষিত আকুল আঁখি॥
ঘুমে-জাগরণে-মেশা
প্রাণে স্বপনের নেশা—
দূর দিগন্তে চেয়ে কাহারে ডাকি॥'
হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যাকে পছন্দ করেন, সে আগেই বুকড। তিনি অন্যের বাহুলগ্না। এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নিশ্চিত আপনিই প্রথম পরেন নি। ১০০ বছর আগের লোকজন ও এমনতর সমস্যায় পড়েছেন। প্রমাণ নিচে-
'ছি ছি, মরি লাজে, মরি লাজে—
কে সাজালে মোরে মিছে সাজে। হায়॥
বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রূপে নিয়ে এল চুপ চুপে
মোরে তোমাদের দুজনের মাঝে॥'
কি ধূর্ত! নিজের অনুপ্রবেশ উপরওয়ালার উপর চাপায়ে সরে পড়েছেন।
আপনাদের সুখের ঘরে শনির হানা। তৃতীয় শক্তির আগমনে তটস্থ আপনি, আপনার প্রেয়সীর মাঝেও দোলাচল অনুভব করলেন। আপনি আবার বিশ্বাস করেন, প্রেম ভালবাসা জোর খাটিয়ে পাওয়ার বস্তু না। আপনার এই দ্বিধায় কবিগুরুও ভুগেছেন।।
' যদি আর কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো।'
বর্তমান যুগের ওয়ান টাইম প্রেম দেখে আপনি মহা ত্যক্ত। সাথে নিজে একটা গার্লফ্রেন্ড যোগাড় করতে না পারার কষ্ট তো আছেই। আপনার এই জেলাসিতে রবি বুড়ো ও কুপোকাত হয়েছিলেন। তাই লিখেছেন-
'এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়, ভুলে যায়।'
আপনি দীপিকা, আলিয়া, ঐশ্বরিয়া, পরীমনি এমন কাউকে ভালবাসেন। যে আপনার নাগালের বাইরে। তার সাথে মিলন শুধু কল্পনাতেই সম্ভব। এটা অবশ্য বাংগালীর কমন সমস্যা। রবি বাবুও মনে প্রাণে বাংগালি ছিলেন।
'মায়াবন বিহারিনী হরিণী-
গহন স্বপন সঞ্চারিনী
কেন তারে ধরিবারে করি পন-অকারণ
থাক থাক নিজ মনে দূরেতে,
আমি শুধু বাসরীর সুরেতে
পরশ করিব ওই তনু মন-অকারণ।
দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাধিব
বাধনবিহীন সেই যে বাধন-অকারণ।'
প্রপোজ করার উপযুক্ত সময় খুঁজছেন। কবিগুরুর সাজেশন বর্ষাকাল প্রপোজ করার জন্য বেস্ট। আসন্ন বর্ষায় চেষ্টা নিন সবাই।
'এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়-
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার–
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।'
প্রেয়সীর সাথে দীর্ঘবিচ্ছেদ। তার স্মৃতি ক্ষণে ক্ষণে তাড়া করে ফেরে আপনাকে। রবি লিখেছেন-
'সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে
ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।
সেই স্মৃতিটুকু কভু ক্ষণে ক্ষণে
যেন জাগে মনে, ভুলো না।।'
সদ্য বিচ্ছেদ হয়েছে আপনার। স্মৃতি একেবারে তরতাজা। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর এমন বহু কবিতা লিখেছেন কবিগুরু।
'নাই যদি বা এলে তুমি - এড়িয়ে যাবে তাই ব'লে?
অন্তরেতে নাই কি তুমি - সামনে আমার নাই ব'লে॥
মন যে আছে তোমায় মিশে, আমায় তবে ছাড়বে কিসে
প্রেম কি আমার হারায় দিশে - অভিমানে যাই ব'লে॥'
বাংগালীর প্রেম আর রবীন্দ্রনাথ হাত ধরাধরি করে চলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় তিনি প্রেমের ভাব প্রকাশে প্রচন্ড সাম্যবাদী। পুরুষদের পাশাপাশি নারী চিত্তের এমন বহিঃপ্রকাশ নিশ্চিত ভাবেই উপমহাদেশে আর কোনো পুরুষ করতে পারেন নি।
তার সৃষ্টি দিয়ে তিনি ফুলে ফলে ভরিয়ে দিয়েছেন বাংগালীর প্রেমের অভিধানকে। তিনি এতটাই অনন্য ও সমসাময়িক যে, এত এত জেনারেশন গ্যাপ এর পরেও, তিনি প্রবল প্রতাপে বিরাজমান। তিনি ছাপ রেখে গেছেন বাংগালীর প্রেমে, বাংগালীর গানে, বাংগালীর হৃদয়ের সব রকমের অনুভূতিতে। তাঁর সেই স্পর্শ যুগের পর যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আবিষ্ট করে রেখেছে।
লিখাঃ কবিগুরু।