বোন

ছ'মাসের সন্তান গর্ভে নিয়ে যে মেয়েটি ফ্লোরে ফাইভার দিচ্ছে সে আমার বোন। সেদিনের আমার দুষ্টু মিষ্টি আর লক্ষীসোনা ছোট্ট বোনটাকে আজ এভাবে তাঁর শশুর বাড়িতে ঝিয়ের মতো কাজ করতে দেখবো সেটা কখনো কল্পনাও করিনি আমি। এমন অসময়ে কলিংবেলের আওয়াজে সে ধারণাও করেনি যে আমি আসতে পারি। কোন খবরও যে দিইনি আগে। তাই কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিতে পাঠিয়েছিলো তার ননদের ছোট ছেলে তাসনিমকে। ওরা হয়তো বেড়াতে এসেছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাবড়ে যায় মারিয়া। তড়িঘড়ি করে হাত থেকে ফাইভারটা রেখে দেয় ও। ওড়না দিয়ে নাক-মুখের ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে আমার দিকে। চোখে মুখে তাঁর বিস্ময়! সাথে ভুবন ভরা আনন্দের ছাপ! এসেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,

- আরে ভাই আমার! হঠাৎ এসময়ে কি করে আসলে? কেমন আছো তুমি? বাড়িতে বাবা-মা তাঁরা কেমন আছেন?

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখে কোন কথা আসছিলো না। এমন সময় ভেতরের রুম থেকে আওয়াজ আসলো,

- ও জমিদারের বেটি মারিয়া, এতক্ষণ লাগে এইটুকু ঘর ফাইভার দিতে? বাবা-মায়ে কি কাজ না শিখিয়েই আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলো তোমায়? ফাইভার দেয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি এসে এখান থেকে প্লেটগুলো নিয়ে যাও। সায়েম আসার আগেই গোসল করে ফ্রেশ হতে হবে। আমার ছেলে যেনো আবার এসব এসে না দেখে হু।

পুরো বিষয়টা আমার কাছে দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেলো। তারমানে সায়েম এবিষয়ে কিছুই জানেনা। তার অজান্তেই আমার বোনটাকে দিয়ে বাসার সকল কাজ করানো হয়। রক্ত মাথায় উঠে গেলো আমার। মারিয়াকে বললাম,

- ফাইভারটা নিয়ে কাজ করা শুরু কর। আমি দাঁড়াচ্ছি।

আমার মুখে এমন কথা শুনে ও অবাক হয়ে আমতা আমতা করে বললো,

- এটা কেন বলতেছো? আমি তো এমনিতেই একটু এটা নিয়ে কাজ করে দেখছিলাম। আমি এতসব কাজ করিনা। সব কাজ এখন মা'ই করেন।

রাগান্বিত স্বরে বললাম,

- যা বলেছি তা কর। আমি দাঁড়াচ্ছি।

সেই ছোটবেলা থেকেই মারিয়াকে কোলেপিঠে করে বড় করেছি। বড় ভাই হয়েও সবসময় বন্ধুর মতো ওর পাশে থেকেছি। আদর স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসার কখনো কোন কমতি দিইনি ওর ক্ষেত্রে। আমাকে ও ছোটবেলা থেকেই যেমন ভালোবাসতো, ভরসা করতো তেমন ভয়ও পেতো। কখনোই আমার অবাধ্য হতোনা। এবার ও চুপচাপ গিয়ে ফাইভারটা নিয়ে কাজ করতে লাগলো। আমি পকেট থেকে ফোনটা বের করে মিনিট তিনেকের একটি ভিডিও বানালাম ওর কাজের। এরপর এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলাম ওকে। ফাইভারটা নিজ হাতে নিলাম। গোটা রুম ভালো করে ফাইভার দিলাম। আমি এসবে ওস্তাদ। ট্যুরিজমের হাউজকিপিং ডিপার্টমেন্টের কোর্স করে ফাইভ স্টার হোটেলে ইন্টার্নিও করা আছে। সেখান থেকেই এসব শেখা। চোখের পলকেই রুমের সবগুলো কাজ করে ফেললাম। বোন আমার বিস্ময় হয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা আবার চেঁচালো। মারিয়া আমার কথা বলতে চাইলেও ওকে থামিয়ে দিলাম। ঐ রুমটা ভেতরের দিকে। এদিক থেকে খুব জোড়ে কথা না বললে সেখান থেকে শোনা যাবার কথায় নয়। তাই আমাদের কথোপকথন শোনেননি তিনি। মারিয়াকে বললাম,

- এখানে চুপচাপ বসে পিঠাগুলো খেয়ে নে। মা বানিয়ে পাঠিয়েছেন। আমি আসছি।

ও বাধ্য মেয়ের মতো হাত ধুয়ে সেগুলো খেতে থাকলো। আমি এগিয়ে গেলাম ভেতরের দিকে। দরজায় নক করলাম। হুট করেই তো আর কারোর রুমে ঢুকা যায়না। এটা ভদ্রতাও নয়। ভেতর থেকে অনুমতি এলো, 'এসো নবাবজাদী।' ঢুকলাম রুমে। তিনি ও তার মেয়ে টিভিতে ভারতীয় সিরিয়াল দেখছেন। সেখানেও দেখাচ্ছিলো কিভাবে নিজেদের পুত্রবধূদের দিয়ে বাড়িতে ঝিয়ের মতো করে কাজ করাতে হয়। আমি এমন একটা পরিবেশে আর সালাম দিলাম না। সরাসরি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাদের চোখে এখন আর আমি মারিয়ার বড় ভাই রিয়াদ নই। যেনো আজরাইল! দুজনের চক্ষুই চড়কগাছে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। বললাম,

- তা এখান থেকে কি কি নিয়ে যেতে হবে দয়া করে যদি বলতেন!

মারিয়ার শাশুড়ি আমার মায়ের বয়সী। আমতা আমতা করে আমাকে বললেন,

- বাবা তুমি এখানে!

বললাম,

- যদি অনুমতি দেন তাহলে একটু বসতে চাই।

উনি টিভি বন্ধ করে দিয়ে বললেন,

- হ্যা বাবা বসো।

দুজনের কেউই বুঝতে পারছেন না আমি ঠিক কি করতে চলেছি। বসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডাটা অন করলাম। ইমুতে গিয়ে কল দিলাম তানহাকে। আমাদের বাসায় ওয়াইফাই রয়েছে। তাই নেট নিয়ে কোন সমস্যা পোহাতে হয়না। কয়েক মুহুর্ত পরই রিসিভ করলো তানহা। ওকে দেখা যাচ্ছে বিছানায় বসে আছে। বললাম,

- কি করছো?

- আর কি করবো, মা এত্তগুলো ফল এনে দিয়ে বললেন যেনো বসে বসে খাই। আমি কি সারাদিন এখন শুধু ফলই খাবো বলো?

- তুমি কি কি খাচ্ছো সবগুলো একটু দেখাও তো!

এই বলে ফোনটা মারিয়ার শাশুড়ির হাতে দিয়ে দিলাম। উনি ফোনটা নিয়ে দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর তানহা মারিয়ার শাশুড়িকে দেখে অবাক হয়ে যায়। সালাম বিনিময় করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। উনার স্বাস্থ্যের খবর নেয়। প্রেসার ঠিক আছে কিনা আর ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেন কিনা সেসবও জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করে উনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পারেন কিনা। জিজ্ঞেস করে উনি আমাদের সকলের জন্যে দোয়া করেন কিনা। কারণ তিনি মুরুব্বি, গুরুজন। মারিয়ার কথা জিজ্ঞেস করে। সেমুহুর্তেই ভদ্রমহিলা কেঁদে ফেললেন। আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,

- আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেনো আমার দ্বারা এমন অবিচার আর কখনো না হয়।

কথাগুলো বলতে বলতে তিনি ফোনটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। তানহা বিস্মিত হয়ে গেলো। জানতে চাইলো হঠাৎ কি হয়ে গেলো। বললাম,

- বাড়ি এসে বলবো। এখন রাখছি।

উনি বিছানায় বসে কাঁদছেন। ততক্ষণে আমি মারিয়ার ভিডিওটা সায়েমকে সেন্ড করে দিয়েছি। সাথে লিখেছি,

- ভুল মানুষই করে। তোমার মা-ও একজন মানুষ। আমি চেষ্টা করেছি উনার ভুল ভেঙে দিয়ে উনাকে শোধরাবার সুযোগ করে দেয়ার। আশা করছি উনি নিজেকে শোধরে নিবেন। তবে নাও নিতে পারেন। তাই এটি পাঠাতে হলো। এখন কোন পদক্ষেপ নেয়ার আর দরকার নেই। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে নিও। সেটুকুই করো যেটুকু একজন স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি থাকা দায়িত্ব আর কর্তব্য পালনের দায়বদ্ধতা থেকে করতে হয়।

ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন এবার। প্লেটগুলো নিজ হাতে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন কিচেন রুমে। ততক্ষণে মারিয়াও সেখানে গিয়ে হাজির। মারিয়াকে দেখে তিনি আর কোন কালক্ষেপণ না করে ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। বুঝতে পারলাম মানুষটির ভেতরে থাকা মমত্ববোধ আর মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়ে গিয়েছে। মারিয়া আমার দিকে বিস্ময়ের নজরে তাকালো। ওর চোখে পানি। সেখানেই যেনো লেখা, 'আমার ভাই কোন যাচ্ছেতাই ভাই নয়, যেনো একটা হীরকখণ্ড! আমি খুব ভাগ্যবতী এমন একজন ভাই পেয়ে।' আমিও মনে মনে বলে উঠলাম, 'আমার আদরের বোনটাকে কেউ কষ্ট দিবে সেটা কিভাবে চুপ করে সহ্য করবো আমি। আমি আমার কলিজার বোনের চোখে পানি আসতে দিবো না কখনো। প্রয়োজনে সাত জমিন ওলট-পালট করে দিতেও আমি কোন দ্বিধাবোধ করবোনা।


লিখাঃ Riyad_Ahmod_Bhuiya

Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

রিয়্যাক্টর কিং

একটি মেয়ের গল্প

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]