বিষন্ন শ্রাবণ
এইমাত্র আমি পাঁচশো টাকার তিনটা নোট ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে কিচেনে গেলাম, এখন দেখি টাকাটা নেই । নাইম,টাকাটা কি তুমি নিয়েছো? ভাবির এই কথা শুনে আমার পিত্তি জ্বলে উঠলো । শেষপর্যন্ত চোর বানিয়ে দিলো আমাকে? ছিঃ!অবশ্য বেকারদেরকে মানুষের অনেক কথা শুনেই বেমালুম হজম করতে হয় । কথায় কথায় পিত্তি জ্বলে উঠলে চলে না।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম;না ভাবি, আমি নেইনি । হয়তো অন্য কোথাও রেখেছো, ভালো করে খুঁজে দেখো। ভাবি বললো, সব জায়গায় খুঁজেছি।কোথাও নেই। তুমি একটু মনে করে দেখো। এমনো তো হতে পারে, তুমি মনের ভুলে নিয়ে মানিব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছো, এখন মনে করতে পারছো না।
এবার সত্যি সত্যি মাথায় আগুন চড়ে গেলো । আমি খুব হাল্কা স্বরে বললাম;ভাবি, তুমি যেভাবে আমাকে অপমান করছো, এরমধ্যে যে চূড়ান্ত রকমের একটা ছোটলোকি আছে, তুমি কি তা বুঝতে পারছো? এই কথায় ভাবি শ্রাব্য অশ্রাব্য ভাষায় যা বলা শুরু করলো, তাতে তাকে আর একটা ভদ্র বাড়ির ছেলেবৌ কিংবা কোনো ভালো ঘরের মেয়ে বলা যায় না। একপর্যায়ে সে বলেই ফেললো, ঢামড়া একটা ছেলে বছরের পর বছর ভাইয়ের ঘাড়ে বসে বসে হাতির মতো গিলছে, চার পয়সা ইনকামের মুরোদ নেই, সে কী না আমাকে বলে ছোটলোক!
আমি বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, যেন মা এইসব কথা কোনভাবে শুনতে না পায়। এমনিতেই সে স্ট্রোকের রুগী, কোনভাবেই উত্তেজিত হতে পারে, এমন কিছু শুনতে দেয়া যাবে না তাকে।
এরপর আর কোনো কথা জোগালো না আমার মুখে।নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম।বেলা বাজে দশটা ছাপ্পান্ন। রোদ তেতে উঠেছে। আষাঢ় মাস, অথচ বৃষ্টির নামগন্ধও নেই। রোদের তাপে যেন রাস্তার পিচ গলে স্যান্ডেলে লেগে যাচ্ছে।
এখন কোথায় যাবো আমি?লকডাউনের ভেতর কারো বাড়ি যাওয়া যাবে না।আমাদের বাড়িটা মোহাম্মদপুর শের শাহ সুরী রোডে। এখান থেকে হেটে হেটে রেসিডেন্সিয়াল কলেজের পাশ দিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে যাওয়া যায়। বসার জন্য খুব নিরিবিলি একটা জায়গা। আমার একটা নিরিবিলি জায়গাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হবে এবং সেটা আজই। এখনই।
সংসদ ভবনের পেছন দিকে লেকের পাড়ে নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। সংসারের হিসাবটা কিছুতেই আর মিলছে না। অল্পকিছু দিনের ভেতর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। অথচ আমাদের সংসারটা ছিলো ছবির মতো সুন্দর,গোছানো, পরিপাটি। সেই ছবির রঙ ঝাপসা হতে শুরু করলো এক সময়। বাবা মারা গেলো প্রায় পাঁচ মাস হতে চললো। এরপর থেকে সেই ছবির শুধু ফ্রেমটাই রয়ে গেলো,বাদবাকি সব হারিয়ে গেলো কোথায় যেন।
এইতো সেদিনের কথা, আমরা দুই ভাই আর বাবা-মা মিলে একসাথে ক্যারাম খেলেছি, লুডু খেলেছি। বাবা একটু সময় বের করতে পারলেই ফুড়ুৎ করে ঘুরতে গিয়েছে আমাদেরকে। বাড়িটা সারাক্ষণ হাসি আর আড্ডায় গমগম করতো। আর আজকের অবস্থা দেখলে নিজেই অবাক হই। মনে হয় আদৌ এইটা আমাদের বাড়ি!
ভাইয়া পড়ালেখা শেষ করার পর উনিশ সালের জুলাই মাসে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ পদে চাকরি নিলো। ভালো বেতন।মতিঝিলে অফিস। এর মাস খানিকের মাথায় কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে এক সন্ধ্যায় ভাবিকে নিয়ে উপস্থিত। তারা নাকি গোপনে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছে। ভাবির বাড়ি কুমিল্লার বরুড়ায়। ফেসবুকে পরিচয়, সেখান থেকে প্রেম আর তারপর বিয়ে।
ভাবির এর আগেও একটা বিয়ে ছিলো। সেপারেশনের পর আমার ভাইয়ার সাথে তার পরিচয়। আমরা সবাই খুব আপসেট হলাম এই ঘটনায়। ভাইয়ার মতো একটা চমৎকার গোছালো এবং দায়িত্বশীল ছেলে কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে বিয়ে করে ফেলবে, এটা মানাই যায় না। আর তাছাড়া আমাদের বাড়িতে যদি অমত করার মতো কেউ থাকতো, তাহলে ভিন্ন কথা ছিলো।
আমরা দুই ভাই মোটামুটি বড়ো হলে বাবা-মা আমাদেরকে খুব পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে বলেছে যে, জীবনে চলার পথে কাউকে ভালো লাগতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। এমন কিছু হলে অবশ্যই যেন সবার আগে বাড়িতে শেয়ার করি। আজ পর্যন্ত আমাদের দুই ভাইয়ের কোনো যৌক্তিক কাজে বাবা-মা বাঁধা দেয়নি, বরং সব সময় উৎসাহ দিয়ে এসেছে। সেখানে ভাইয়ার কাছ থেকে এটা কেউই আশা করেনি।
এই ব্যাপারটা নিয়ে বাবাই সবচেয়ে বেশি আপসেট হয়ে পড়লো। মা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলো যে, নাবিল যদি মেয়েটাকে নিয়ে সুখি হতে পারে তাহলে আমাদের আর আপত্তি করে লাভ কী? যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। আর তাছাড়া দুইজনের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছে। দুজনই ম্যাচিউরড। সুতরাং এখন স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপারটা মেনে নেওয়াই সবদিক দিয়ে ভালো। ভাবির আগের বিয়ে নিয়ে বাবা-মা কেউই কোনো কথা তোলেনি এই পর্যন্ত।
ডিভোর্স একটা মেয়ের জীবনের খুব দুর্বল একটা জায়গা। সুযোগ বুঝে এই জায়গায় খোঁচা দেয়া কোনো ভালো মানুষের কাজ না। মা শুধু ভাইয়াকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সেই রাতে বলেছিলো;নাবিল, তোর বাবার মনে এতো বড়ো দুঃখ দিলি! তার কতো পরিকল্পনা তোর বিয়ে নিয়ে। খুব ধুমধাম করে বড়ো ছেলের বিয়ে দিবে।আনন্দ-ফুর্তি করবে। মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছেরে! স্রেফ এইটুকুই। অবশ্য ভাইয়া সেই রাতে মাফ চেয়েছিল বাবা মা'র কাছে।
তারপরও বাবা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো।এরপর থেকে কখনো আগের মতো সেই চঞ্চল মানুষটাকে আর দেখিনি।মাস তিনেক মোটামুটি ভালোভাবেই চললো সংসারটা।এরপর সাজানো বাগানে একের পর এক ঝড় আসা শুরু হলো।সেই ঝড়ে আমাদের স্বর্গের সেই বাগানটা তছনছ হয়ে গেলো।
ভাবির সাথে মা'র তেমন বনিবনা হচ্ছিলো না।একটা পর্যায়ে সংসারে শান্তির জন্য মা সবকিছু ভাবিকে বুঝিয়ে দিয়ে অবসর নিলেন।তবুও শান্তি এলো না।ভাবি চাইলো তার আলাদা একটা সংসার।যে সংসারে শ্বশুর-শাশুড়ী আর দেবরের মতো বাড়তি ঝামেলা থাকবে না।
তার কথায় অবশ্য যুক্তিও ছিলো।স্বামী এতো টাকা ইনকাম করছে,বলতে গেলে তার টাকা দিয়েই সংসারটা চলছে।সেখানে সে এসব জঞ্জাল নিয়ে এই বাড়িতে থাকবে কেন?বাবা খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো।মা ভাইয়াকে ডেকে আলাদা সংসারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো।ভাইয়া সোজাসুজি হ্যাঁ-না ধরনের কিছুই বললো না।সে খুব বুদ্ধিমান মানুষ।চিবিয়ে চিবিয়ে যা বললো,তার অর্থ হলো,সে একটু শান্তি চায়।সারাদিন অফিসে খাটুনি দিয়ে এসে বাসার অশান্তি তার ভালো লাগেনা।ডিপ্লোমেটিক মানুষের ডিপ্লোমেটিক উত্তর।অথচ একটা সময় আমার এই ভাইয়াটা ছিলো বাপ-মা অন্তঃপ্রাণ একটা মানুষ।
সংসারের এই ডিপ্লোম্যাসি মা কোনো মতে হজম করতে পারলেও বাবা পারলো না।তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসারে এমন ভাঙন সহ্য করা আসলেই তার জন্য কঠিন ছিলো।বাবা কিশোর বয়সে গ্রাম থেকে খালি হাতে এসে প্রথমে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করে।এরপর সেখানে নিজেই ছোট্ট করে একটা রেস্টুরেন্ট দাঁড় করায়।সেই ছোট্টো রেস্টুরেন্ট আস্তে আস্তে বড়ো হয়।বাবার দিন-রাতের অমানুষিক পরিশ্রমের উপর বিহারী ক্যাম্পের সোজা শের শাহ সুরী রোডে এই বাড়িটা কেনে।স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে তার অনেক কষ্টে সাজানো এমন সোনার সংসারের বেহাল দশা দেখে হঠাৎ করেই বাবা চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যায়।
সেই সময় আমি ছিলাম বাবার পাশে।তাড়াতাড়ি তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেই।কী হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না।পাঁচ-ছয় সেকেন্ড পর বাবা আবার চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলো।এবার তার গাল থেকে ফেনা ভাঙতে শুরু করলো।ভোজবাজীর মতো চোখের পলকেই ঘটে গেলো ঘটনাটা।তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।শেষ দিকে আমার সন্দেহ হয় যে,বাবা স্ট্রোক করেছে।এ্যাম্বুলেন্সে আমার কোলে বাবার মাথা ছিলো।
নিউমার্কেটের সামনে গেলে বাবা বমি করলো।আমার পরিচিত এক কাছের বড়ভাই আছে ডিএমসির ডাক্তার।পথেই তাকে ফোন দিলাম।সে এবং ইমার্জেন্সিতে কত্যর্বরত আর কয়েকজন ডাক্তার মিলে অনেক্ষণ দেখে টেখে বললো,বাবার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে।
সিটিস্ক্যান করানোর পর আমাদেরকে জানানো হলো বাবার মস্তিষ্কের শিরা ছিড়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।অবস্থা খুবই খারাপ।শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা একটা অপারেশন করতে পারে।সেক্ষেত্রে বাঁচার সম্ভাবনা পঁচিশ শতাংশ।খরচ পড়বে লাক খানেক টাকা।
খরচের কথা শুনে হোক, কিংবা পঁচিশ শতাংশ বাঁচার সম্ভাবনার কথা শুনেই হোক, ভাইয়া কেমন মিইয়ে গেলো। অপারেশনের ব্যাপারে সে খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। আমি বেকার মানুষ। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা টিউশনি করে মাসে আট হাজার টাকা পাই আর বাবা কিছু দেয়, তাই দিয়ে আমার চলে যায়। লাখ টাকার ইস্যুতে আমার মতামতের তেমন কোনো দাম নেই। তারপরও কী ভেবে যেন খুব দৃঢ়ভাবে বলে ফেললাম,অপারেশন হবে।টাকার জোগাড় আমিই করবো।
অপারেশন হলো, কিন্তু ডাক্তাররা তেমন আশার কিছু শোনাতে পারলো না। এই পুরো সময়টাতে কাছের সেই ডাক্তার বড়ভাই ছিলেন। তাঁর কারণে ডিএমসিতেও বাবার চিকিৎসায় কোনো কমতি হয়নি। তারপরও কিছুতেই কিছু হয়নি। ডাক্তাররা অপারেশন করে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়া রক্ত বের করতে পেরেছিলো, কিন্তু আমি জানি, ওই রক্ত ছাড়াও বাবার কিছু ভুল মানুষকে ভালোবাসার পরিনামে প্রচুর পরিমাণ পচা রক্ত ছড়িয়ে পড়েছিলো তার বুকের ভেতর, তাতো আর বের করা যায়নি। এক আকাশ চাঁপা অভিমান বুকে নিয়ে মানুষটা সেই রাতেই এপার আর ওপারের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরী করে ফেললো, যে দেয়াল ভেদ করার সাধ্য পৃথিবীর কোনো মানুষের নেই।
ভোরের আলো ফুটলে আমরা আজিমপুর কবরস্থানে বাবাকে চির নিদ্রায় শুইয়ে রেখে আসলাম। এই কবরস্থানটা বাবাই একদিন আমাকে চিনিয়েছিলো। তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। দুপুর দুইটার দিকে বাবা কলাভবনের নিচে গিয়ে আমাকে ফোন করে নিচে নামতে বললো। নেমে দেখি বাবা রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে বললো, চল আজ তোকে নিয়ে কিছুক্ষণ রিকশায় করে ঘুরি । আমরা কলাভবন, ডাকসু,লাইব্রেরী,কেন্দ্রীয় মসজিদ, কাজী নজরুল ইসলামের মাজার,চারুকলা,মধুর ক্যান্টিন,শ্যাডো, মল চত্বর,ভিসি চত্বর, টিএসসি, শহীদ মিনার, কার্জন হল ঘুরে টুরে নাজিরা বাজার গিয়ে একটা ঘুপচি দোকানে কাচ্চি খেলাম । দোকানটা পুরান ঢাকার সবচেয়ে পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী । এরপর বিউটি লাচ্চি খেলাম । আগুন পান খেয়ে আবার ঘুরতে বের হলাম।
এবার বাবা আমাকে আজিমপুর কবরস্থানের যেখানে সাধারণ মানুষকে কবর দেয়া হয়,সেখানে নিয়ে গেলো।কবরের উপরে মানুষের হাড়গোড় দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।বাবা বললো,অল্প কিছুদিন থাকার জন্য আমাদের অনেক আয়োজনরে খোকা,কিন্তু অনন্তকাল ধরে থাকার আয়োজনটা খুবই সামান্য।সেই দিনের পর দ্বিতীয়বার গেলাম বাবাকে চিরদিনের জন্য রেখে আসতে।
অনন্তকালের যাত্রায় বাবাকে টিকিট কেটে দিয়ে আমরা সবাই বাড়ি ফিরে এলাম।এরপর কিছুদিন শান্ত ছিলো সবকিছু।মা একবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো।বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মার মুখে আজ পর্যন্ত আমি একটা বারের জন্যও কখনো হাসি দেখিনি।
আমি মনে মনে অসংখ্যবার বলেছি, মা তুমি একটু হাসো প্লিজ! প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবন দিয়ে হলেও মার মুখে একটু হাসি ফোটাবো। আল্লাহ তা'লার কাছে মনের সবটুকু শুদ্ধতা উজাড় করে দিয়ে প্রর্থনা করেছি,মার মুখে হাসি দেখার আগে যেন আমার চোখ দুইটা না বোজে।
এগারোটা বেজে গেছে।হাতে সময় কম।আর বসে থাকা যায় না।চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে বের হয়ে নীরাকে ফোন দিলাম।একবার রিং বাজতেই ও রিসিভ করলো।এই জীবনে আমি যতবার ওকে ফোন করেছি,একবার রিং বাজতেই ও রিসিভ করেছে।খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।আমি ফোন করার আগেই কি মেয়েটা টের পেয়ে যায়?টেলিপ্যাথিক সিস্টেম বলে বিজ্ঞানে একটা জিনিস আছে।অথবা,মেয়েটা সারাক্ষণ আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করে।যাইহোক,সবকিছুর পেছনেই মেয়েটার নিখাঁদ ভালোবাসা আছে।এইজন্য এই ব্যাপারে আমি প্রশ্ন করিনি কখনো।কারো অকৃত্রিম ভালোবাসার পেছনের কারণ খুঁজতে যাওয়ার মতো নোংরামি আর কিছু নেই।
কেমন আছো জিজ্ঞেস করতেই ও বললো,তোমার মন খারাপ কেন?বাসায় কোনো ঝামেলা হয়েছে?সকালে আন্টির সাথে কথা হলো,উনি তো কিছু বলেননি।আমি বললাম, অনেকগুলো প্রশ্ন করেছো।উত্তর দিতে সময় লাগবে।তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
তোমার কাছে কি কিছু টাক হবে?
কতো?
এই হাজার দশেক।
হবে।
আমি এখন আসছি।ফোন দিলে তুমি বাসার নিচে এসো টাকাটা নিয়ে।আরেকটা কথা,কবে ফেরত দিবো,তা এখনো বলতে পারছিনা।
আচ্ছা।
টাকাটা কেন নিচ্ছি জানতে চাইলে না?
না।তোমার প্রয়োজন তাই নিচ্ছো।এরচেয়ে বেশী কিছু জানতে চাচ্ছি না।তবে তুমি বলতে চাইলে বলতে পারো।
না,থাক।পরে গুছিয়ে বলবো।
আচ্ছা। সাবধানে এসো।
গুলিস্তান মতিঝিল রুটের একটা বাসে উঠে পড়লাম আসাদ গেট থেকে।করোনার জন্য গুলিস্তান বিআরটিসি বাস কাউন্টার প্রায় জনশূন্য।অথচ অন্যান্য সময় এখানে পা ফেলার জায়গা থাকে না।বাগেরহাটগামী টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের লাস্ট ট্রিপ বিকাল ছয়টায়।বাকিতে C1আর C2 সীট দুইটা বুক করে পথে নেমে পড়লাম।
পকেটে সব মিলিয়ে তিরানব্বই টাকা আছে।এখন যেতে হবে বেইলী রোড।ওখানে নীরাদের বাসা।পকেটে যে টাকা আছে,তার থেকে পঞ্চাশ-ষাট টাকা ভাড়া দিয়ে বেইলী রোড পর্যন্ত একটা রিকশা নেয়াই যায়।কিন্তু রিকশা নিতে ইচ্ছে করছে না।হাটতে ইচ্ছে করছে।আর কবে এই শহরে হাটা হবে,তার কোনো ঠিক নেই।আর কোনদিন হাটা হবে কি না,তারও কোনো ঠিক নেই।এই শহর,এই শহরের রাস্তাঘাটের কি মনে থাকবে নাইমের কথা?
সিদ্ধেশ্বরী রোড়ে গিয়ে আগে মনোয়ারা হাসপাতালের পাশের লাইব্রেরীটা থেকে একটা ম্যাটাডোর অল টাইম কলম,দুইটা A4 সাইজের কাগজ আর একটা খাম কিনলাম।ভিকারুননিসার গেটের কাছে দুইটা কাঠগোলাপ গাছ।এর একটা গাছে সারাবছরই মনে হয় ফুল ফুটে থাকে।নিচে অনেকগুলো ফুল পড়ে আছে।কয়টা ফুল নিয়ে সোজা চলে গেলাম ভিকারুননিসার গেটের অপজিটে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ লাগোয়া ফুটপাতের উপর রাখা একটা ফাস্টফুডের পরিত্যক্ত ভ্যানের পাশে।
হাতে সময় কম।নীরাকে চিঠি লিখতে হবে।একটু পরেই দেখা হবে,তখন গুছিয়ে বললেই হয়,অথবা মোবাইলেও বলা যায়।তবে,চিঠিতে বলার ব্যাপারটা একটু আলাদা।এই চিঠি কম করে হলেও নীরা এক কোটি বার পড়বে।কী অদ্ভুত স্বভাব যে মেয়েটার!
সবকিছু শুনে মা হ্যাঁ-না কিছুই বললো না।শুধু বললো,গ্রামে যেয়ে কৃষিকাজ যে করবি,তার জন্যেও তো টাকা দরকার।পাবি কোথায়?আপাতত চলার জন্যেও তো টাকা পয়সা দরকার,তাই বা পাবি কোথায়?আমি বললাম,নীরার কাছ থেকে কুড়ি হাজার টাকা ধার এনেছি।দশ হাজার চেয়েছিলাম,ও আমাকে না জানিয়ে কুড়ি হাজার দিয়ে দিয়েছে।মা বললো,ওকে বলেছিস যে তুই গ্রামে চলে যাচ্ছিস?আমি বললাম,মুখে বলিনি,তবে চিঠিতে বিস্তারিত লিখে দিয়ে এসেছি।মা খাট থেকে নেমে কাপড়চোপড় গোছাতে শুরু করলো।খুশি হলো কি না জানিনা,তবে মনমরা ভাবটা একটু মনে হলো কমে গেলো।
আজিমপুর কবরস্থানে এসে সিএনজি থেকে নেমে বাবার কবরের মাথার কাছে গিয়ে বললাম;বাবা,এই স্বার্থপর শহরে তোমাকে একা ফেলে রেখে আমরা গ্রামে চলে যাচ্ছি।রাগ করোনা প্লিজ!জীবনভর আমাদেরকে শুধু ভালোবাসা দিয়েছো তুমি, বিনিময়ে আমরা কেবল স্বার্থপরতা দিয়ে গেলাম।ততক্ষণে মাও প্রায় কবরের কাছাকাছি চলে এসেছে।মাকে রেখে আমি গিয়ে সিএনজিতে বসলাম।দুইজন একটু নিরিবিলি কথা বলুক।তাদের এক জীবনের অনেক হিসাব নিকাশ হয়তো এখনো বাকি আছে।বকেয়া হিসাব নিকাশ করুক দ'জনে একটু নিরিবিলি।
বাস কাউন্টারে বসে আছি।আর আধঘন্টা পর বাস আসবে।একটু আগেভাগে বের হয়েছি বাসা থেকে।আরো কিছুক্ষণ পর বের হলেও পারতাম,কিন্তু ইচ্ছা করেই তাড়াতাড়ি বের হয়েছি, যেন ভাইয়ার বাসায় ফেরার আগেই বের হতে পারি।সে এসে দেখবে,আমি আর মা নেই।বাসায় শুধু তারা দুজন।যেরকম একটা সংসার আমার ডিপ্লোমেটিক ভাইয়া আর ভাবি সব সময় চাইতো।তার কি মা আর ভাইয়ের জন্য একটুও মন খারাপ হবে?হওয়ার তো কথা না,বরং মন ভালো হওয়ারই কথা।
একটা গাড়ি এসে আমাদের সামনে থামলো।আমি আর মা বসে আছি টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস কাউন্টারের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চের উপর।গাড়িটা থামতেই গেট খুলে নীরা নেমে এলো।তার চোখ ফোলা।চিঠি পড়ার পর থেকেই সম্ভবত কাঁদছে মেয়েটা।সে এসেই মার সামনে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে বললো,আন্টি আমি আপনাদের সাথে গ্রামে যাবো।ভাগ্যিস মানুষজন তেমন একটা নেই।নইলে এমন আগুন রূপবতী একটা মেয়ের এভাবে হাটু গেড়ে বসে কান্নার দৃশ্য দেখতে মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমে যেতো।মা নীরাকে উঠিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে চোখ মুছিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো।আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার মার মুখে হাসি ফুটেছে।
মা নীরাকে বললো,তোমাকে এভাবে নিয়ে যাবো না মা।একবারে বৌ সাজিয়ে নিয়ে যাবো একদিন।তারজন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে।
আমি আর মা বাসের সীটে বসা।আমি বসেছি জানালার পাশের সীটে।মা আমার কাঁধে হাত রেখে বসেছে।একটু পর পর তার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।বাস স্টার্ট দিয়েছে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।নীরা দাঁড়িয়ে আছে জানালার সোজা।সে আজ ছাই রঙের শাড়িটা পরে আছে।এই শাড়িটা আমি ওকে গত ঈদে কিনে দিয়েছিলাম টিউশনির টাকা দিয়ে।মেয়েটা কাঁদছে।কী অপরূপ যে লাগছে তাকে!
বাস চলতে শুরু করেছে।নীরা সেখানেই থামের মতো দাঁড়িয়ে আছে।একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের গাড়ির ড্রাইভার।মেয়েটা মোটেও নাড়াচাড়া করছে না।আমি মনে মনে বললাম,
"চরন ধরিতে দিও গো আমারে,
নিও না, নিও না সরায়ে।
জীবন মরন সুখ দুঃখ দিয়ে,
বক্ষে ধরিবো জড়ায়ে।"
লিখা :-বাপ্পি।