পরম পাওয়া
আজ আমার বিয়ে, এইটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে।
পাড়াপ্রতিবেশি এবং যে দু'একজন শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজনের সাথে আমার যোগাযোগ আছে তারা কানাঘুষা করছে কেউ কেউ সামনে এসে বলছে, ছি ছি এই বয়সে এসে আবার বিয়ে করতে লজ্জা করছে না তোমার? বিয়েই যদি করবে তাহলে এতোদিন করোনি কেন? বুড়ো বয়সে এসে ভীমরতিতে পেয়েছে?
আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না ,চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে হলো। বর্তমানে আমার বয়স পঞ্চাশ বছর। আমি জানি এ বয়সে আরেকটা বিয়ে করা দৃষ্টি কটু কিন্তু আমি নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে বিয়ে করছি।একাকিত্ব ও অর্থ কষ্ট যে কতটা ভয়াবহ তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
প্রথম যখন আমার বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর ইন্টার মিডেয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়তাম।বাবা মা'র অমতে পালিয়ে জাহিদ কে বিয়ে করি, বাবা মা বিয়েটা মেনে নেয়নি।নেবেই বা কি করে? জাহিদ ছিল মাস্তান। আমি জানতাম না, বিয়ের পরে জানতে পেরেছি তখন আর কিছুই করার ছিল না।বিয়ের পর জাহিদকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ি যাই বাবা,মা,আর দুই ভাইয়া গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো আমাদের ঘরে উঠতে দেয়নি দরজা থেকে বিদায় দেয়।
বাবা কর্কশ কণ্ঠে বললেন, আজ থেকে তোমাকে ত্যাজ্যকন্যা করলাম।এখন থেকে জানবো জেসমিন নামে আমাদের কোন সন্তান ছিল না যদি কোনদিন মাস্তান স্বামী ছেড়ে আসতে পার তখন বিবেচনা করবো।
আমি জাহিদকে ছেড়ে যেতে পারিনি মাস্তান হোক তবুও তো স্বামী ভালবেসে বিয়ে করেছি আর তাছাড়া মনের কোণে একটু ভয় ছিল জাহিদকে ছেড়ে গেলে হয়ত ও আমার কোন ক্ষতি করতে পারে, তারচেয়ে জাহিদের সাথে থেকে ওকে শুধরানোর চেষ্টা করবো।
জাহিদের সাথে সংসার শুরু করলাম কিন্তু শান্তি পেলাম না জাহিদ সারাক্ষণ গুন্ডামী, মাস্তানী,চাঁদাবাজি করতো। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে এই আশংকায় বেশির ভাগ রাতে বাড়িতে ঘুমাতো না।
বিয়ের তিনমাস নাই যেতে নিজের দেহের ভিতর আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। রাতে খবরটা শুনে জাহিদ অসম্ভব খুশি হয়ে ঐদিন রাতে বাড়িতে ঘুমিয়েছিল।ভোররাতে পুলিশ এসে জাহিদকে এরেস্ট করে নিয়ে যায়।
তিনবছর জেল খেটে জাহিদ ছাড়া পায় ততদিনে আমার ছেলে জুয়েল সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়ায় আধো আধো কথা বলা শিখেছে। এই তিন বছর আমি মানবেতর জীবনযাপন করি।
জাহিদ বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর আমি আবার অন্তঃসত্ত্বা হই। জাহিদ খুব মেয়ের আশা করেছিল কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে আবার একটা ফুটফুটে ছেলে হলো নাম রাখলাম রুবেল।
দুই ছেলে আর জাহিদকে নিয়ে সংসার করছি, খুব চেষ্টা করছি জাহিদকে ভাল পথে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু কোনভাবেই সফল হতে পারছিনা।
জুয়েলকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি আর রুবেলের বয়স তিনবছর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যার পর পাশের বাড়ির একটা ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, চাচি তাড়াতাড়ি চলো বেলতলায় চাচাকে কয়েকজন মিলে খুব মারছে।
পড়িমরি করে ছুটে বেলতলায় যেয়ে দেখি মানুষের জটলা ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল,আমার পায়ে কোন জোর নেই ওখানেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। বেলতলায় রক্তের গঙ্গা বইছে আর সেই রক্তের ভিতর নিঃস্তব্ধ হয়ে জাহিদ পড়ে আছে।
স্হানীয় পত্রিকায় জাহিদের মৃত্যুর খবর ছাপানো হল।পরেরদিন বিকেলে মা এবং ভাইয়া আমাদের বাড়ি আসলো ঐদিন আমি জানতে পারলাম আমার বাবা ছয়মাস আগে মারা গেছেন।
মা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে কাঁদতে লাগলেন।ভাইয়া মাথায় হাত দিয়ে বললেন তুই যদি তোর ছেলেদের এতিমখানায় রেখে আমাদের কাছে ফিরে আসিস তাহলে তোর দায়িত্ব আমরা নেবো কিন্তু তোর ছেলেদের দায়িত্ব আমরা নিতে পারবোনা, সাপের বাচ্চা সাপই হয় ইচ্ছা করে দুধকলা দিয়ে সাপ পুষবো না।
মা, ভাইয়া চলে যাবার পর ভাবলাম কোন অবস্থাতেই আমি আমার সন্তানদের কাছ ছাড়া করবো না যত কষ্টই হোক ওদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবো।
এলাকার নেতা মানবিকতা দেখিয়ে একটা বেসরকারি স্কুলে আমাকে আয়ার চাকরি পাইয়ে দিলেন সেই সাথে দর্জির কাজটাও শিখে নিলাম নেতার সাহায্য সহযোগিতায় একটা সেলাই মেশিন পেলাম। দিনরাত পরিশ্রম করে সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করেছি। দু তিন জায়গার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু সন্তানদের মুখ চেয়ে আমি নাকচ করে দিই।
রক্ত জল করে ছেলেদের ঢাকায় রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছি।জুয়েল এবং রুবেল দুইজনই ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পায়। ছেলেদের ছেড়ে থাকতে আমার খুবই কষ্ট হতো, স্বপ্ন দেখতাম আর মাত্র তো কয়টা বছর তারপর আমার সকল কষ্ট শেষ হয়ে যাবে। জুয়েল চাকরি করবে লাল টুকটুকে বউ আনবো তারপর রুবেল চাকরি করবে। আমার ছোট্ট বাড়িটা হাসি আনন্দে ভরে উঠবে স্বপ্ন দেখি আর দ্বিগুণ উৎসাহে পরিশ্রম করি।
স্কুলের সবাই আমাকে ভালবাসে সবাই আমাকে বাহবা দিয়ে বলেন, বিধবা হয়েও কি সুন্দরভাবে ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করছো।
জুয়েল যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে তখন আমার আশা, ভরসাা, স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ল।রুবেল ফোন করে জানাল,জুয়েল তার এক ক্লাসমেটকে বিয়ে করেছে। কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে আমার বড়ছেলে ঘর জামাই হয়েছে।
হতাশায় ভেঙে পড়লাম তারপর রুবেলের কথা চিন্তা করে বুকে পাথর চাপা দিয়ে শক্ত হলাম।
রুবেল পড়াশোনা শেষে চাকরি পেয়ে আমাকে বলল, মা আমি নিলা নামে এক মেয়েকে ভালবাসি তুমি নিলাদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাও।
কয়েকদিনের মধ্যে নিলার সাথে রুবেলের বিয়ে দিলাম।বিয়েতে জুয়েল এবং বৌমা কে আসতে বলেছিলাম কিন্তু বড়লোকের মেয়েকে আমার ভাঙাচোরা ঘরে জুয়েল আনেনি জুয়েল একা এসেছিল সকালে এসে বিকেলেই চলে যায়।বড় বৌমার মুখ আমি দেখিনি।
ভেবেছিলাম রুবেলের বউ এর সাথে ভাল থাকবো কিন্তু নিলা আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না কয়েকদিনের মধ্যে রুবেল ঢাকায় বদলি হয়ে নিলাকে নিয়ে চলে গেল।
আমি পুরোপুরি একা হয়ে পড়লাম। জুয়েল মোটেও খোঁজ খবর নেয় না রুবেল খুব কম ফোন করে আর নিলা তো আমার সাথে ফোনে কথাই বলে না।মাঝে মাঝে একাকিত্ব অসহনীয় হয়ে ওঠে রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবি কি পেলাম আমি এই জীবনে! যে সন্তানদের জন্য নিজের আরাম আয়েশ সুখ বিসর্জন দিলাম নিজের দেহ মাটি করলাম বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে কি পেলাম? আর মাত্র একমাস চাকরি আছে তারপর আমার কি হবে? ছোট্ট এই টিনের ঘরে ভাড়া থাকি চাকরি চলে গেলে ঘর ভাড়া কোথা থেকে দেবো? এ তো আর সরকারি চাকরি না যে এককালীন টাকা পাবো, পেনশন পাবো! কিছুই পাবোনা। তখন আমার কি উপায় হবে? ছেলেরা তো আমার সামান্য খোঁজটুকুও রাখেনা।
আমি যখন ভবিষ্যতের চিন্তায় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছি তখন একদিন আমাদের স্কুলের বিলকিস ম্যাডাম আমার বাড়িতে এলেন, এটা সেটা কথা বলে ছেলেদের অমানবিক আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন শেষে বললেন,জেসমিন ছেলেদের জন্য নিজের জীবনটা তো শেষ করেছো এবার একটু নিজের কথা ভাবো। হায়দার স্যারের স্ত্রী মারা গেছেন শুনেছো বোধহয়, উনার ছেলেমেয়েরা বাবাকে ওদের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু হায়দার স্যার নিজের বাড়ি ছেড়ে কোত্থাও যাবেন না। ছেলেমেয়েরা বাবাকে কিছুতেই একা বাড়িতে রাখবে না তাই আবার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আমি তোমার সাথে হায়দার স্যারের বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারি।
হায়দার স্যার ছিলেন আমাদের স্কুলের একজন সাদাসিধা ভাল মানুষ দুইবছর আগে রিটায়ার করেছেন ছয়মাস হলো স্ত্রী মারা গেছেন। স্যারের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে মেয়েটির বিয়ে হয়ে ঢাকায় থাকে।
বিলকিস ম্যাডাম গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তোমার কি মত জেসমিন? আমি তোমার ভাল চাই।
ম্যাডাম আমার অমত নেই কিন্তু ছেলেদের মতামতটা তো নিতে হবে।
যারা তোমার কোন খোঁজ খবর নেয় না সেই কুলাঙ্গার ছেলেদের মতামত নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
ছেলেদের না জানিয়ে আজকে আমার বিয়ে।বিলকিস ম্যাডাম এবং স্কুলের দু'এক জন বিয়েতে উপস্থিত আছেন। বরযাত্রী চল এসেছে আমি দরজার আড়াল থেকে দেখলাম হায়দার স্যারের ছেলে মেয়ে হাসিমুখে বাবার বিয়েতে এসেছে।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই আমার দুই ছেলের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলাম নিশ্চয়ই কেউ ওদের ফোন করে জানিয়েছে। ছেলে দুটো হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলল, এসব তুমি কি কান্ড করলে? তোমার একবারও আমাদের কথা মনে হলো না!আমাদের মান সম্মানের দিকে একবারও তাকালে না!
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছি কোন উত্তর দিতে পারছি না। ছেলেরা আবার বলা শুরু করলো, মানুষ তাদের ছেলে মেয়েদের ত্যাজ্য করে আজ আমরা তোমাকে ত্যাজ্য করছি আজ থেকে তুমি আমাদের ত্যাজ্য মা, তোমাকে মা বলতেও আমাদের ঘৃণা হচ্ছে।
আমার আর সহ্য হলো না চোখের পানি মুছে স্পষ্ট গলায় বললাম, বাবারা তোমরা তো কবেই আমাকে ত্যাগ করেছো যতদিন তোমাদের কাছে আমার প্রয়োজন ছিল ততদিন আমি তোমাদের মা ছিলাম যখন তোমাদের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তখন থেকেই আমি তোমাদের কেউ না। বিয়ে শাদি করে চাকরি করে তোমাদের জীবন সাজিয়েছো কিন্তু একবারও আমার খোঁজ নাও? তোমাদের জীবন সাজানোর পেছনে আমি যে কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছি সেকথা কি একবারও ভেবেছো? আজ বড়গলায় আমাকে ত্যাজ্য মা করছো। তোমাদের মতো কুলাঙ্গার সন্তান আমি পেটে ধরেছি এইটা আমার চরম ব্যার্থতা।
তুমি মরে গেলেও মাটি দিতে আসবো না এই বলে দুই ছেলে রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমি মাথা নিচু করে আকুল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি হঠাৎ মাথায় স্নেহের স্পর্শ পেলাম সেই সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ কন্ঠে কে যেন বলে উঠলো , মা তুমি আর কেঁদো না।
তাকিয়ে দেখি হায়দার স্যারের মেয়ে সেঁজুতি। সেঁজুতি আবার বলে উঠল ,তুমি দেখবে মা একদিন তোমার ছেলেরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবে। আমি শুনেছি জীবনে তুমি অনেক কষ্ট করেছো আর তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো না মা, তুমি শুধু আমার বাবাকে ভাল রেখো। বাবা ভাল থাকলে আমারাও ভাল থাকি আর তোমাকে ভাল রাখার দায়িত্ব আমাদের।
সেঁজুতির কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। সার্থক হায়দার স্যার আর হায়দার স্যারের স্ত্রী এমন ভাবে সন্তান মানুষ করেছে যে সন্তান তার বাবাকে ভাল রাখার জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত। আমি পারলাম না এমনভাবে সন্তান মানুষ করতে।এত দুঃখ কষ্টের মাঝেও হায়দার স্যারের দুটো হিরের টুকরো ছেলেমেয়ের মা হতে পেরেছি এটা আমার জীবনে পরম পাওয়া।
লিখা: ইসরাত জাহান নিতা