ভালোবাসি আমিও


'সজীব ভাইয়া তুমি জিলাপির লোভেই প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে যাও। তাইনা?'
বলেই খিল খিল করে হেসে উঠলো তৃষ্ণা। সজীব কাছে এসেই তৃষ্ণার বাম কানটা টেনে ধরলো।
তৃষ্ণা ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, 'উহ্! লাগছে সজীব ভাইয়া। ছাড়ো, আর বলবো না।'
'মনে থাকবে?'
তৃষ্ণা নরম স্বরে বললো, 'হুম, থাকবে।'

সজীব কানটা ছেড়ে দিতেই তৃষ্ণা বলে উঠলো, 'আমি জানি, তুমি জিলাপির জন্যই মসজিদে যাও। না হলে শুধু জুম্মায়'ই কেনো মসজিদে যাও?' বলেই দেয় এক দৌঁড়।
সজীব দাঁড়িয়ে হেসে ওঠে।
প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে বাসায় ফিরলেই তৃষ্ণা এই কথাটা শোনাতে ভুল করে না সজীবকে।

সারাদিন সজীবের পিছনে লেগে থাকাই হলো তৃষ্ণার মূল্যবান কাজ। মেয়ে নেই বলে সজীবের মা খাদিজা বেগমের আফসোসের অন্ত নেই। বড় ছেলে বউ বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় থাকে। ছুটিগুলো ছাড়া খুলনাতে তেমন আসা হয় না তাদের। তৃষ্ণা'ই সারাদিন এ বাড়িটা মাথায় করে রাখে।

সজীবের বাবা শরিফ উদ্দিন কলেজের অধ্যাপক। সেখানেই উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তৃষ্ণা। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে এখানের একটা সরকারি ব্যাংকে বেশ কয়েক বছর চাকুরিরত আছেন তৃষ্ণার বাবা হানিফ সাহেব। হানিফ সাহেবের এক মেয়ে এক ছেলে। সুখি পরিবার যাকে বলে। পরিবারে সুখও আছে ভরপুর।

পাশাপাশি বাসা হওয়ায় দুই পরিবারের মাঝে পরিচিত হতে খুব বেশি সময় লাগে নি। তৃষ্ণাকে খুব ভালোবাসেন খাদিজা বেগম। তৃষ্ণা ভালোবেসে তাকে ফুফু বলেই সম্বোধন করে। সজীব খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র।

'ফুফু, আমি তোমার জন্য পুডিং বানিয়ে এনেছি।'
খাদিজা বেগম হেসে এগিয়ে এলেন। বাটিটা হাতে নিয়ে দেখেই বললেন, 'বাহ্। দেখতে তো বেশ সুন্দর হয়েছে। খেতেও নিশ্চয়ই সুস্বাদু হবে।'
সেসব কথায় কথা না বাড়িয়ে সজীবের রুমের দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণা বললো, 'ফুফু সজীব ভাইয়া কোথায়?'
পুডিংয়ের বাটিটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে খাদিজা বেগম বললেন, 'আছে হয়তো রুমেই। গিয়ে দেখ তুই।'
তৃষ্ণা ছুটলো সেদিকেই।

সজীবের রুমে ঢুকতেই তৃষ্ণা নাক চোখ কুঁচকে বললো, 'উহুম! কি দুর্গন্ধ।'
সজীব মুখের সামনে থেকে বইটা রেখে জিজ্ঞেস করলো, 'কিসের দুর্গন্ধ?'
'কেমন যেন সিগারেটের গন্ধ আসছে।'
শোয়া থেকে উঠে বসলো সজীব।
'সিগারেটের গন্ধ আসবে কোথা থেকে?'
'তা কি আমি জানি! নিশ্চয়ই তুমি খেয়েছো।' বলেই অন্য দিকে তাকায় তৃষ্ণা।
চোখ দুটো বড় বড় করো শাসিয়ে বলে ওঠে সজীব, 'একটা থাপ্পড় দিবো। সবসময় ফাজলামি। আমি সিগারেট খাইনা তুই জানিস না?'
মুখ চেপে হেসে উঠলো তৃষ্ণা।
'আমি জানি তো। তবুও পরখ করে নিলাম।'
দাতে দাত চেপে রাগ হজম করলো সজীব।
'অল্প বয়সে মেয়েরা পেকে গেলে এমনই করে। দাঁড়া তোর বাবার সাথে দেখা হোক।'
ভ্রু উঁচু করে তৃষ্ণা জিজ্ঞেস করলো, 'কেনো বাবার সাথে দেখা হলে কি বলবে?'
'বলবো ভালো ছেলে খুঁজে বিয়ে দিতে। না হলে আমার অনেক বন্ধু বান্ধব আছে। ভালো দেখে একটারে ধরে নিয়ে আসবো৷ তারপর তার সাথেই তোর বিয়ে দিবো।'
বেশ রাগত্ব স্বরে তৃষ্ণা বলে ওঠে, 'আমার বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি তোমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করো।'
বলেই হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়।

বিরক্ত লাগলেও সজীব বেশ উপভোগ করে তৃষ্ণার ছেলেমানুষিগুলো। সজীবের ভুলগুলো খুঁজে এনে চোখের সামনে দেখিয়ে দেওয়ায় তৃষ্ণার মত পটু আর কেউ নয়। সেই সুযোগে নিজেকে শুধরে নিতেও পারে সজীব। হাজার হোক এই ছোট মেয়েটার কাছে তো তার ভুলগুলো বজায় রেখে ছোট হওয়া যাবে না।

সজীব বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে হন্তদন্ত হয়ে ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো তৃষ্ণা।
'সজীব ভাইয়া, কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমায়।'
'কেন ডাকছিস?'
'পাশের এলাকায় একজন কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে।'
'ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না এলাইহি রাজিউন।'
'না এতটুকুতে তো হবে না?'
'এতটুকুতে হবে না মানে?'
'তোমার তো ওখানে যেতে হবে। কারন তুমি তো বছরে দুই ঈদ, জুম্মাগুলো আর জানাযা ছাড়া কোনো নামাজ'ই পড় না।'
তৃষ্ণার কথায় খুব রাগ হলো। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় খাদিজা বেগম এসে জানালেন পাশের এলাকায় যিনি মারা গেছেন তিনি সজীবের এক বান্ধবীর বাবা।

সজীব কথা না বাড়িয়ে রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে বন্ধুদের বেশ কয়েকটা ফোনকল জমা হয়েছে। ফোন হাতে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো সজীব।

সন্ধ্যায় তমালকে সাথে নিয়ে তৃষ্ণা পিঠা দেওয়ার বাহানা করে চলে আসে এ বাসায়। তমাল বসে টিভি দেখতে লাগলো সাজিবের বাবা শরিফ উদ্দিনের সঙ্গে। খাদিজা বেগম রান্নাঘরে পায়েস রাঁধছেন। সজীব ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। তৃষ্ণা রুমে ঢুকলো, সজীব তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। তৃষ্ণার বেশ রাগ হলো।

'সজীব ভাইয়া?'
ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বললো, 'বল'
'তোমার কি মন খারাপ?'
'নাহ্! এসব হাবিজাবি কথা রেখে যেটা বলতে এসেছিস বলে ফেল।'
চুপ করে রইলো তৃষ্ণা।
তারপর বললো, 'তোমার বান্ধবীকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছো তো?'
ল্যাপটপটা রেখে তৃষ্ণার দিকে তাকায় সজীব।
'একটু আগেও ফোন করেছিলাম।'
মুখখানা মলিন করে বললো, 'সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কি তুমি তাকে জড়িয়ে ধরেছিলে?'
সজীব আঁড় চোখে তাকাতেই তৃষ্ণা বললো, 'না মানে এমনি আরকি জানতে চাইলাম। আর জড়িয়ে ধরলেও বা কি! তোমার বান্ধবী'ইতো। বান্ধবী তো বোনের মত। তাই না?'
বলেই জোর করে মুখটা হাসি হাসি রাখলো তৃষ্ণা।
সজীব রাগ দমিয়ে বললো, 'বান্ধবী প্রেমিকা হয়, বউও হয়। যা ভাগ এখান থেকে।'
তৃষ্ণা মুখটা কালো করে চলে গেলো।

তমাল তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললো, 'কি রে আপু, সজীব ভাইয়া দিয়েছে কানমলা?'
শাসিয়ে বলে উঠলো, 'দিবো একটা থাপ্পড়। চল, বাসায় চল।'

কলেজ থেকে এসে জামা কাপড় ছেড়ে কোনোরকমে খেয়েই তৃষ্ণা চলে আসে এ বাসায়। কখনও সজীবের দেখা মেলে, কখনও মেলে না। আজও মেলেনি।

পরিক্ষার সময় এগিয়ে আসছে তৃষ্ণার। পড়াশোনার নামগন্ধ নেই তার। পড়াশোনা বোঝার বাহানা করেও রোজ কতবার সজীবকে জ্বালায় তৃষ্ণা, তার হিসেব কেউ কষে না। সজীব বকাবকি করার পরে, যা একটু মন বসায় পড়াশোনায়।

বিকেলে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণা। এমন সময় দেখে সজীব একটা মেয়েকে নিয়ে রিকশা থেকে নেমে বাসায় ঢুকছে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে চাইলো সজীবদের বাসায়। এমন সময় তৃষ্ণার মা এসে বললেন তাকে কাজে সাহায্য করতে। রাগ হলেও এখন হজম করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। কাজ সেরে সন্ধ্যার আগে ছাদে গেলো শুকনো কাপড়গুলো আনার জন্য। এ বাড়ির ছাদ থেকে সজীবদের ছাদটা স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিকে তালাতেই দেখে, সজীব ওই মেয়েটাকে নিয়ে ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে। তাদের কথোপকথন বোঝা না গেলেও তাদের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখতেই আরও কাছে এগিয়ে যায় তৃষ্ণা। বেশ হাসাহাসি করেই কথা বলছে তাঁরা। তৃষ্ণাকে দেখেই সজীব হাত ইশারা করলো। তৃষ্ণা মুখ ভেংচি কেটে দেখেও না দেখার বাহানা করে কাপড়গুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো। তৃষ্ণার কর্মকাণ্ড দেখে সজীব হেসে উঠলো।

সেদিন আর রাগ করে ওবাড়ি যায় নি তৃষ্ণা। পরেরদিন সকালে গিয়ে জানতে পারে মেয়েটা সজীবের বান্ধবী। বাবা মারা যাওয়ায় বেশ ভেঙ্গে পড়েছে মেয়েটা। তাই সজীব বাসায় নিয়ে এসেছে ঘুরতে।
ঘটনা শুনে ভেতরে জ্বলতে থাকে তৃষ্ণা। বিড়বিড় করে বলে ওঠে, 'সান্ত্বনা দিতে বাসায় আনতে হবে কেন! ফোনে দুই এক মিনিট কথা বললেই তো হত।'

বিকেলে ঘুম থেকে উঠে তৃষ্ণা বারান্দায় বসতেই তমাল এসে জানায়, 'আপু সজীব ভাইয়াকে দেখলাম টুটুল ভাইয়ের গিফ্ট কর্ণারে। বেশ সুন্দর দামী একটা গিফ্ট কিনেছে। জানিস আমার খুব পছন্দ হয়েছে।'
তমালের মুখে এমন কথা শুনে বই খাতা হাতে পড়ালেখার বাহানা করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো সজীবদের বাসায়।
খাদিজা বেগম জানালেন, 'সজীব বন্ধুদের সাথে একটা বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। ফিরতে রাত হবে।'
রাগ হলো খুব। মনে মনে বলতে লাগলো, জন্মদিনের শুভেচ্ছা তো ফোন করে জানালেই হত। যেতে হবে কেন!
খাদিজা বেগমের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে উঠলো, 'ফুফু তুমি সজীব ভাইয়াকে এসব অনুষ্ঠানে যেতে দাও কেন? তুমি জানো এসব অনুষ্ঠানে কতসব আজেবাজে জিনিস খাওয়া হয়। ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যায়।'
তৃষ্ণার কথা শুনে খাদিজা বেগম অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
তারপর বললেন, 'পাগলি মেয়ে! ওরা এখন বড় হয়েছে তো। নিজের ভালোমন্দ তো নিজেরা বুঝবেই। আর সজীব অমন ছেলে না। আর তেমন ধরনের বন্ধুও ওর নেই। ওর সব বন্ধু বান্ধবীদের তো আমি চিনি।'
কথাগুলো তৃষ্ণার অপছন্দ হলেও শান্ত গলায় বললো, 'যত বড় হোক তবুও ছেলে মেয়েদের শাসন করতে হয়।'
খাদিজা বেগম আবার হেসে ওঠেন।
'শাসন করে তো ছোটদের। কারন এরা অনেক কিছুই বুঝতে পারেনা। ভুল করে বসে৷ এই যেমন তোকে আমরা শাসন করি।'
এবার বেশ চড়াও হলো তৃষ্ণা। রেগে উঠে বললো, 'ফুফু আমি কিন্তু ছোট না। আর আমি বুঝি সবই।'
বলেই হনহন করে বই খাতা হাতে চলে গেলো। খাদিজা বেগম হাসতে হাসতে ডাকলেও শুনলোনা তার কথা।

ইদানীং সজীব তৃষ্ণাকে দেখলেই পড়াশোনার জন্য বকাবকি শুরু করে দেয়। তাই বেশ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে তৃষ্ণা। সামনে না গেলেও, দূর থেকে খবর নেওয়ার চেষ্টা করে।

একদিন বৃষ্টিতে ভিজে খুব জ্বর আসে তৃষ্ণার। বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তিটাও অবশিষ্ট রইলো না। খাদিজা বেগম খানিক পর পর এসে দেখে যান তৃষ্ণাকে। বেশ কষ্ট করে একটু ঘুম এলো দু'চোখে। ঘুম ভাঙ্গতেই তমাল এসে জানায় সজীব এসেছিলো তাকে দেখতে।
কথাটা শুনেই জ্বরটা যেনো একটু কমে গেলো।
জিজ্ঞেস করলো, 'আমায় ডাকলি না কেন?'
তমাল বললো, 'সজীব ভাইয়া বারণ করেছিলো। বেশ কতক্ষণ বসে ছিলো তোর পাশে। রুমাল ভিজিয়ে ভিজিয়ে তোর কপাল মুছে দিয়েছিলো।'
চোখে মুখে একটা আনন্দ হেসে উঠলো। ভাবতেই ভালো লাগছে তার, সজীব তার যত্ন নিয়েছিলো।

পরদিন বিকেলে আবার এলো সজীব। এবার জেগেই ছিলো তৃষ্ণা। সজীবকে দেখে শোয়া থেকে উঠে বসতে যাবে এমন সময় সজীব বারন করলো।
তারপর হাসিমুখ করে বললো, 'কি রে জ্বর কি একটুও কমেছে?'
'একটু কমেছে।'
'শুনেছি তুই নাকি খেতে চাস না, ঔষধও জোর করে খাওয়াতে হয়! এমন করলে সুস্থ হবি কি করে?'
'আমার খেতে ইচ্ছে করে না।'
'ইচ্ছে তো করবেই না। তবুও তো করতে হবে। তুই যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবি, তত তাড়াতাড়িই তোকে নিয়ে ফুসকা খেতে যাবো।'
হেসে উঠলো তৃষ্ণা। কতবার বলেও সজীবকে একবার ফুসকা খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারে নি সে। আর আজ নিজ থেকেই ফুসকার কথা বলছে। ভাবতেই নেচে উঠলো ভেতরটা।

অল্প কয়েকদিনের ভেতরে বেশ সুস্থ হয়ে উঠলো তৃষ্ণা। পরিক্ষার দিন বেশি বাকি নেই। কথা রাখার জন্য ফুসকা খেয়ে এসেছে সজীব তৃষ্ণার সাথে।
ফেরার পথে তৃষ্ণা সজীবের কাছে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না করলে কড়া কন্ঠে সে বায়না নাকচ করলো সজীব।
'মাত্রই সুস্থ হইছিস। এখন আইসক্রিম খাওয়া যাবে না একদম।'
মন খারাপ করে বললো, 'তুমি কখনওই আমার কথা শুনো না।'
সজীব নরম গলায় বললো, 'যদি তুই পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারিস। তারপর থেকে তুই যখন যত আইসক্রিম খেতে চাস আমি তখন তত আইসক্রিমই খাওয়াবো।'
হেসে বলে ওঠে তৃষ্ণা, 'সত্যি তো?'
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় সজীব।

তৃষ্ণার সঙ্গে ফুসকা খাওয়ার সময় রিতুর কথা খুব মনে পড়ছিলো সজীবের। রিতুও বেশ পছন্দ করতো ফুসকা। সজীব খেতো না, তাকিয়ে রিতুর ফুসকা খাওয়া দেখতো। রিতু যখন হা করে পুরো ফুসকাটা মুখে পুরে দিয়ে আরাম করে চোখ বন্ধ করে খেতে থাকতো, সজীব তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। বেজায় ভালোবাসতে রিতুকে। কিন্তু মেয়ের বাবারা কখনও বেকারদের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয় না, তাদের আকার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষার সুযোগও দেয়না মেয়েকে। বরং বেকার ছেলের সাথে সম্পর্কের কথা জানতে পারলেই দুম করে একটা বড়সড় আকারওয়ালা ছেলেকে ধরে এনে জোর করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়।

রিতুর বেলায়ও তাই হয়েছে। তারপর আর ভালোবাসা, প্রেম, ভালোলাগা এসবের আগমন হয়নি সজীবের জীবনে। অনুভবও করে নি এমন কিছু।

তৃষ্ণা ইদানীং খুব কম ঘোরাফেরা করে। তিন চারদিন পর একদিন আসে সজীবদের বাসায়। খাদিজা বেগমের সাথে অল্প কিছু গল্প করে চলে যায়।
সজীব তমালকে জিজ্ঞেস করলে বললো, 'আপু তো ফাটিয়ে পড়াশোনা করছে।'
সজীব হাসে। মনে মনে খুশি হয় এমন পরিবর্তন দেখে।

পরিক্ষা শেষ হতেই তৃষ্ণার বাবা হানিফ সাহেবের বদলির চিঠি চলে আসে। খুলনা ছেড়ে এবার পাড়ি জমাতে হবে চট্টগ্রামে। আর এক মাস আছেন এ শহরে। সবাই মেনে নিলেও মেনে নিতে পারেনা তৃষ্ণা।

খাদিজা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে ওঠে। খাদিজা বেগমও চোখের জল আঁটকে রাখতে পারেন না।

সন্ধ্যায় সুনসান ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণা। সজীব এসে পাশে দাঁড়ায়।
'কি রে আইসক্রিম খাবি না?'
তৃষ্ণা শান্ত স্বরে বলে, 'পরিক্ষার রেজাল্ট তো দেয় নি।'
'আমি জানি তোর রেজাল্ট ভালো হবে।'
তৃষ্ণা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় সজীবের দিকে।
'সজীব ভাইয়া তোমার মন খারাপ করবে না আমি চলে গেলে?'
সজীব হেসে জবাব দেয়, 'সারাদিন যে পরিমাণে বিরক্ত করিস, এতে অবশ্য খুশি হওয়ার কথা।'
'তবে কি তুমি খুশি হবে?'
'উহু না! তোর জন্য খারাপ লাগবে। বেশি খারাপ লাগবে মায়ের জন্য। তুই গেলে মা একদম একা হয়ে পড়বে।'
তৃষ্ণার চোখে ছলছল করে ওঠে জল। ডুকরে কাঁদতে গিয়েও থামে।
'ওহ্' বলে চুপ হয়ে যায়।

চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। সবার মন খারাপ বাড়ে। তৃষ্ণা এখন খুব ঘন ঘন এ বাড়িতে আসে। কারনে অকারণে ছুটে চলে আসে।

মাত্র সাত দিন বাকি। পায়েস দেওয়ার নাম করে তৃষ্ণা এ বাড়িতে আসে সন্ধ্যায়। সজীব বেলকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে এসে দাঁড়ায় তৃষ্ণা। সজীবের হাতটা ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে আসে সে।
রুমে এসেই দরজার সিটকানি আঁটকে দেয়।
সজীব 'কি হয়েছে?' জিজ্ঞেস করতেই তৃষ্ণা চুপ থাকার ইঙ্গিত দেয়।

তৃষ্ণার দু'চোখ ভরা জলেরা টলমল করছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দু'জন।
একটুপরই চোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো পানি।
তৃষ্ণার এই রূপটা একদমই অচেনা সজীবের।
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, 'কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে আমায় বল। কেউ কিছু বলেছে?'
চোখের পানি বেড়েই চলছে।
'সজীব ভাইয়া। আমায় রেখে দাওনা তুমি এখানে। আমি চট্টগ্রাম যাবো না।'
বেয়ে পড়া চোখের পানি মুছতে হাত বাড়ায় সজীব। হাতটা শক্ত করে ধরে বসে তৃষ্ণা।
'তুমি কি কিছুই বোঝোনা? নাকি বুঝতে চাও না?'
সজীব তাকিয়ে রইলো। সে তাকানোয় বুঝতে না পারা'রা জেগে উঠলো।
'আমি তোমায় রেখে দূরে যাবো না। আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না।'
সজীব এবার স্পষ্ট বুঝতে লাগলো।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, 'তুই এখনও ছোট তৃষ্ণা। এই বয়সে আবেগ থাকে, এই বয়সেই সবাই না বুঝে ভুল করে বসে।'
'সজীব ভাইয়া আমি বুঝেই বলেছি। আমি আবেগের বশে ভুল করছি না।'
সজীব কড়া কন্ঠে বলে ওঠে, 'তুই বাসায় চলে যা।'
কান্না জড়ানো কন্ঠে চেচিয়ে বলে উঠলো, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি সজীব ভাইয়া।'
সজীব সিটকানি খুলে দিলো। তৃষ্ণা দ্রুত পায়ে চলে গেলো। খাদিজা বেগম কিছু বুঝতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

তারপর থেকে আর এ বাসায় যাতায়াত নেই তৃষ্ণার। খাদিজা বেগম সজীবকে বেশ কয়েকবার ও বাসায় যাওয়ার জন্য বললেও সজীব রাজি হয় নি৷

পরশু সকালে তৃষ্ণারা চলে যাবে। সন্ধ্যা নেমে এলো। একটা অজানা বিষন্নতা তাড়া করে বেড়াচ্ছে সজীবকে। সবকিছু ঠিকঠাক নিয়মে চললেও শূণ্যতারা বাসা বেঁধে উঠেছে ভেতরে।

ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে সজীব। তৃষ্ণা এসে দাঁড়ায় পেছনে।
'তমাল বললো ছাদে ডেকেছো।'
পিছন ফিরে তাকায় সজীব।
'পরশু চলে যাচ্ছিস?'
'হুম'
'রেগে আছিস আমার উপরে?'
'নাহ্'
'তাহলে তাকাচ্ছিস না কেন আমার দিকে?'
'আবেগের বয়সে এমন ভুল করার থেকে মন খারাপ হওয়া ঢের বেশি ভালো। তাইনা সজীব ভাইয়া?' বলেই তাকায় সজীবের দিকে।
চোখ সরিয়ে নেয় সজীব।
ছলছল করে ওঠে জল তৃষ্ণার চোখে।
খানিক পরে তাকায় দুচোখে চোখ রেখে।
সে চোখে গভীর মায়া আর ভালোবাসা খুঁজে পায় সজীব।

'তোর তো আঠারো বছর হয়নি।'
অবাক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় তৃষ্ণা। বুঝে উঠতে পারেনা কথাটা।
হাসি দেয় সজীব।
'তোকে এখন রেখে দিতে পারবো না আমি। তবে কথা দিচ্ছি। আঠারো হলে আমি তোকে নিয়ে আসবো। কিন্তু কথা হলো তোর বাবা কি বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে?'
টলমল খুশির জল নিয়ে হেসে ওঠে তৃষ্ণা।
'তুমি বললে বাবা অবশ্যই বিয়ে দিবে।'
'এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। এখানে এলেও কিন্তু পড়াশোনা করতে হবে।'
মাথা নিচু করে লজ্জামাখা কন্ঠে হেসে বলে, 'তুমি থাকলে আমি সব করতে রাজি।'

সজীব হেসে উঠে বললো, 'তোর হাতটা দে, ধরবো। সেদিন ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম বলে কষ্ট পেয়েছিলি। আজ পুষিয়ে দিবো।'
হাতটা এগিয়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণা বললো, 'ভালোবাসি তোমায় সজীব ভাইয়া।'
'বিয়ের পর কিন্তু ভাইয়া ডেকে ছেলেমেয়ের মুখে মামা ডাক শুনাস না।' বলেই হেসে ফেললো সজীব।
লজ্জা পেলো তৃষ্ণা।
হাতটা শক্ত করে ধরে সজীব ফিসফিস করে তৃষ্ণার কানে বললো, 'ভালোবাসি আমিও।'


লিখাঃ Mahfuja Rahman

Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

রিয়্যাক্টর কিং

একটি মেয়ের গল্প

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]