বুমেরাং
পাবলিক টয়লেটে ঢুকে ১৫০ মি.লি. পেপসির বোতলে পেশাব ভরে নিলো মোতালেব.
বোতলটা হাতে নিয়ে সোজা নিউ মার্কেটের একটা দামি কাপড়ের দোকানে যেয়ে ঢুকলো....
ভালো একটা দামি পাঞ্জাবি দেখে আস্তে করে বোতলটা পকেট থেকে বের করে, চট করে হাতের তালুতে একটু পেশাব ঢালে মোতালেব....
পাঞ্জাবিটা উল্টে পালটে দেখার ভান করে হাতের পেশাবগুলো ইচ্ছেমতো মাখে পাঞ্জাবিটাতে.....
তারপর কাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে একটা জুতার দোকানে ঢোকে....
একটা পিউর লেদারের সুন্দর জুতা বেছে নেয়...
তারপর আরেকটু বড় সাইজ এনে দিতে বলে সেলসম্যান ছোকড়াটাকে....
আর এই সুযোগে হাতের নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে জুতোটার পাকা চামড়া তুলে নেয় এক পাশ দিয়ে.... তারপর আবার শো-কেইসে নিজেই রেখে দেয়...
জুতোর দোকান থেকে বের হয়ে একটা শাড়ির দোকানে ঢোকে সে....
আর নিজের বউ-কে মানায় মত একটা শাড়ি খুঁজে বের করে...
তারপর পকেট থেকে কলমটা হাতের ভাজে লুকিয়ে, শাড়ি ঘেটে দেখার এক ফাঁকে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ভাঁজ বরাবর তিন তিনটা ফুটো করে দেয়....
তারপর বাচ্চাদের দোকানে ঢুকে একটা বাচ্চাদের গেঞ্জি হাতে নেয়....
আড়চোখে ডানে বামে দেখে টাস করে মাঝখানের একটা বোতাম ছিড়ে নেয়....
ভালো করে চোখ না বুলালে কেউ বুঝবেই না যে একটা বোতাম গায়েব.....
ছোট বেলায় ঈদের আগে মোতালেবের বাবা মোতালেবের জন্য ১৫০ টাকা দিয়ে জামা আনতো....
মোতালেবের মায়ের জন্য আনতো ৩০০ টাকার থ্রি পিছ....
আর নিজের জন্য আনতো একটা ৪৫০ টাকা দামের পাঞ্জাবি....
সেটা দেখে মোতালেব ধারণা করে যে,
বয়সের সাথে সাথে বোধহয় মানুষের দাম বাড়ে....
বাবা বাসায় সবচেয়ে বড়, তাই বাবা সবচেয়ে দামি কাপড় পড়ে...
এখন মোতালেব নিজে বড় হওয়ার পর বুঝে...
বাস্তবে বয়স বাড়লে মানুষের দাম কমে....
অন্তত তার মতো ছোটলোকের বাচ্চাদের জীবনে তাই হয়....
আজকের মত মিশন শেষ.....
কিন্তু চৌমুহুনী মোড়ে এসে একটা ফলের দোকান দেখে মেজাজ টা আবারও বিগড়ে যায়...
কমলা কেজি কত জিজ্ঞেস করে...
আর যথারীতি কমলা ঘাটে...
ঘাটতে ঘাটতে পুট পুট করে কয়েকটা কমলার নিচে বুড়ো আংগুল দিয়ে ফুটো করে দিয়ে আসে....
নিম্ন মধ্যবিত্ত মোতালেবকে সস্তা জীবনের ঝালে আজ একটু বেশিই ধরেছে....
তাই খেয়ালের বসে আজ বড়লোকের উপর ঝাল মেটালো খানিকটা....
মনে মনে খুব হাসে মোতালেব....
আর বাসায় এসে একটা তৃপ্তির ঘুমে তলিয়ে যায়....
ঈদের আগের দিন মোতালেবের মামা-শশুড় মোতালেবের বাসায় আসে....
ভাংগা সোফায় বসে মামা শশুড় এটা সেটা বলে....
বেশিরভাগই ফাউল আলাপ...
তবে লোকটা খালি হাতে আসে নাই...
তিনটা ব্যাগ আর একটা ছোট ঠোংগা এনেছে....
ব্যাগের ভিতর কিছু কাপড় আর ঠোংগায় দুই ডজন কমলা...
ব্যাগ থেকে একটা একটা আইটেম বের হয়, আর মোতালেবের বুকে একটা করে স্ট্রোক হয় যেন....
প্রথমে বেরোয় বাচ্চাদের একটা জামা.....
মাঝখানের বোতাম টা ছেড়া...
যেটা ভালো করে চোখ না বুলালে বুঝা যায় না...
এরপর বেরোয় একটা সুন্দর শাড়ি...
সেই শাড়ির ভাজের আড়ালে অদৃশ্য তিনটা ফুটা মোতালেব ছাড়া আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না....
পরের আইটেম-টা বের করতেই মামা শশুড় নিজেই হায় হায় করে উঠলো....
"দেখেছো কারবার টা?? নিলাম জুতা এক জোড়া.... আর সেলসম্যান দিয়ে দিলো আরেক জোড়া... তাও আবার চামড়া ছিলা...আজ চাঁদ রাত.... আমি এখন আবার যাওয়া লাগবে জেসমিনের বোন শারমিনের বাড়িতে....
মোতালেব, তুমি ক্যাশ-মেমো টা নিয়ে নিউমার্কেট যেয়ে পাল্টে নিও তো পারলে...
আরেক ঝামেলা....
তা দোকান চিনবে তো???
দোকানের ঠিকানা না শুনেই মোতালেব উত্তর দেয়...
"হ্যা মামা...খুব চিনবো..."
এরপর দাঁতে দাঁত চিপে মোতালেব প্রশ্নটা করেই বসে...
"তা মামা... সব আনলেন....
সেই পাঞ্জাবী-টা আনলেন না যে?"
এমন অপ্রস্তুত প্রশ্নে থতমত খেয়ে লাজুক মুখে মামা বলে.... "কোন্ পাঞ্জাবি বাবা!?"
আড়চোখে কটমট করে মোতালেবের দিকে তাকায় বউ জেসমিন.....
কালকে ঈদ....
তলা ফুটা কমলা... ছিড়া শাড়ি... আর বোতাম ছাড়া গেঞ্জি নিয়ে খাটে শুয়ে খিস্তি করছে জেসমিন.... মামা শশুড়ের চোদ্দ গুষ্টি বেজায় গাল-মন্দ খাচ্ছে...
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মোতালেবের....
শুনেছে "বুমেরাং" নামে একটা জিনিস আছে...
ওটা সামনে ছুড়ে মারলে নাকি আবার পেছন দিকে ফিরে আসে আপনা আপনি....
লে বুমেরাং.... আমার জীবনেই এলি....
কিন্তু একটা হিসেব কিছুতেই যেন মিলছে না....
"সবই তো ফেরত পাইলাম....কিন্তু পাঞ্জাবি টা কই গেলো!".
পরের দিন ঈদের নামাজে মসজিদে গেলো মোতালেব....
নামাজ শেষে খুতবা হচ্ছে...
আনমনে আশ পাশ দেখে মোতালেব....
খুতবা শেষে কোলাকুলির হিড়িক পড়ে....
কিন্তু খটাস করে মোতালেবের চোখ আটকায় প্রতিবেশি বশির ভাইয়ের উপর.....
হ্যা.... অবিকল... ঠিক সেই পাঞ্জাবি টা....বশির ভাইয়ের গায়ে...
বশির ভাই একগাল হেসে মোতালেব কিছু বুঝে উঠার আগেই বুকে চেপে ধরেন....
গায়ে পিঠে আজকে যেন ঘষাঘষি একটু বেশিই করছেন....
দামি আতরের গন্ধে নিজের পেশাবের ঘ্রাণ টা নাকে আসার কথা না মোটেও....
কিন্তু মোতালেব যেন ঠিকই ঘ্রাণ পায়....
মসজিদ থেকে বের হতেই একটা ফকির হাত পেতে দেয়....
নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরকর্ত্তা মোতালেব জীবনে কখনও ১৩ টাকার বেশি দান করে নাই.....
আজ কি মনে করে পকেট থেকে ২০০ টাকা বের করে দিলো....
ফকির-টা বড় বড় চোখে তাকায়....
প্রতিউত্তরে ফকিরটাকে মোতালেব শুধু ছোট্ট করে বলে,
"এটাও ফিরে আসবে...."
ঠিক ঈদের ৩ মাস পর অফিস থেকে একটা ফোন আসে...
সংক্ষিপ্ত আলাপে অফিস স্টাফ জানিয়ে দেয় যে মোতালেবের প্রমোশন হয়েছে....
মোতালেবের মুখ দেখে জেসমিন জিজ্ঞেস করে....
"কি ব্যাপার.... কি হয়েছে....?"
মোতালেব উত্তর দেয়....
"ওটা ফিরে এসেছে".....
– আজব তো!! কি ফিরে এসেছে?
– বুমেরাং....
লেখাঃ আহমাদ বিন নুরুল