পরিবর্তন
ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল,তাকিয়ে দেখি ভাবি ফোন দিয়েছে।সকাল আটটা বাজে,এতো সকালে কেন ফোন দিচ্ছে চিন্তা করতেই মনে হল,রুহান আর আমার দাওয়াত ছিল আজ ভাইয়ার বাসায়।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম ভাবি।
-ওয়ালাইকুম সালাম,কি করছো?রেডি হইছো?আসবা কখন?
-না,ভাবি রেডি হইনি এখনও,আর দাওয়াত তো দুপুরের ভাবি।
-তোমার নিজের ভাইয়ের বাসা এটা,এখানে আসতে কি তোমার টাইম মেইনটেইন করা লাগবে?
ভাবির কথায় পুরনো কিছু কথা মনে পড়ে গেল আমার,বললাম
-না,তা না।আচ্ছা,আমরা রওনা হলে আপনাকে ফোন দিবো।
-আচ্ছা,ঠিক আছে।
ফোনটা রেখে চুপ করে বসে রইলাম,ফিরে গেলাম কয়েক বছর পেছনে।
প্রায় ৮ বছর আগে চোখে অনেক রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ভাইয়ার হাত ধরেই তার বাসায় এসেছিলাম।ভাইয়া আমাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে ভেতরে গেলেন।
স্কুলশিক্ষক বাবার দুই ছেলেমেয়ে আমরা।ভাইয়া আর আমার বয়সের অনেক পার্থক্য,পড়াশোনায় দুজনই খুব ভালো ছিলাম।ভাইয়া মাস্টার্স কম্পলিট করে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করলেন,বিয়ে করলেন।আমি তখন মাত্র ক্লাস এইটে।
পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বলে বাবা-মা এর খুব ইচ্ছে হল আমাকে ডাক্তারি পড়াবেন আর তাই ইন্টারমিডিয়েট ঢাকায় কোন কলেজে পড়াতে চাইলেন।
আমার ভাইয়া তখন বউ নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন।
ভাইয়ার ভাবির সাথে কি কথা হল জানিনা তবে ভাবির চিল্লানোর শব্দের মধ্যে কিছু কথা বুঝতে পারলাম তার মর্মার্থ এই যে,ভাইয়া একটা গাধা,কিছু না বুঝেই আমাকে বাসায় এনে তুলেছে,এই শহরে একটা এক্সট্রা মানুষ খাওয়াতে কত টাকা খরচ হয় তার কোন আইডিয়াই ভাইয়ার নেই।
মুহুর্তের মধ্যেই আমরা মনের সমস্ত চিন্তাভাবনা বদলে ভয় জায়গা করে নিল।এতোটুকু তো বুঝলামই যে ভাবি আমার আসাটাকে ভালোভাবে নেননি।
ড্রয়িংরুমে এসে ভাবি দায়সারাভাবে কুশলাদি জানতে চাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন,
-শহরের কলেজ সম্পর্কে তোমার কোন আইডিয়া আছে?যে কেউ কি চান্স পায় সেখানে?ঢাকার পড়াশোনার প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জানো তুমি?গ্রামের স্কুলে রোল এক হওয়া মানেই কিন্তু এখানে ব্রিলিয়ান্ট হওয়া নয়।
-ভাবি,আব্বা আসলে এই প্রতিযোগিতার মধ্যেই আমাকে পড়াতে চেয়েছে যাতে আমি নিজেকে যাছাই করতে পারি,মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি।
-হুহ..ডাক্তারিতে চান্স পাওয়া কোন চাট্টিখানি কথা নয়,পুরোনো পাগল ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানি।
-এভাবে কথা বলছো কেনো?ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন।
প্রথমেই এরকম নিরুৎসাহিত করলে ও সামনে এগোবে কিভাবে?
-কিসের জন্য উৎসাহিত করবো?জানি যেটা পসিবল না সেটার জন্য?
বলেই ভাবি ভেতরে চলে গেলেন।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি হাসলাম।
বাবা-মা কে কিছুই জানালাম না কারন ভীষণ কষ্ট পাবেন তাই।
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই জীবনের রুঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হই আমি।ভাবি তার কাজের মেয়েটিকেও আমার চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।আমার কোন কাজ ও কে করতে দিতেন না।নিজের কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে প্লেট-বাটি ধোয়া সব নিজেই করতাম।মাঝেমধ্যে ভাবির কিছু কিছু কাজও ইচ্ছে করেই করে দিতাম,যদি তার একটু মন নরম হয় আমার প্রতি।
কলেজ একটু দুরে ছিল বলে খুব ভোরে রওনা হতে হত,কখনও নাস্তা করে যাইনি আমি,পান্তা ভাত আর আগের তরকারি রাখা থাকতো,কখনও খেতাম কখনও না। কারন সকালবেলা ভাত খাওয়ার অভ্যেস ছিল না আমার।দরজাটা লাগাতেও কাজের মেয়েটির বিরক্তিকর চাহনি এখনও চোখে ভাসে।
সকালবেলা ছাড়া অন্য সময় আমার খাবার থাকতো ভাত আর আগের দিনের বেচে যাওয়া তরকারি।আমার টিভি দেখা,গান শোনা এগুলো ভাবি একদম পছন্দ করতো না তাই এসবকিছুই বাদ দিতে হল।একই বাসায় থেকে তার সাথে আমার তেমন কথাও হতো না।
ভাইয়ের ছেলে তাসিম হওয়ার পর খুব খুশি হয়েছিলাম কিন্তু ভাবি আমাকে ও কে কোলে নিতে দিতেন না।কেন?জানি না।
এতোটা বিদ্ধেষ কেন ছিলো আজও বুঝতে পারিনি।তবে আমার বাবার টাকা দেয়ার পাশাপাশি আমার ভাইও আমার জন্য মাঝেমধ্যে অল্পবিস্তর খরচ করতো,কি জানি হয়তো সেজন্য।
ভাবি আমার সামনে প্রায়ই তাসিমকে বলতো তুই হবি তোর খালামনির মতো বুঝলি,বলে আমার দিকে তাকাতো।না কিছুই বলতাম না আমি।
আমি কখনও ভাবির মুখের উপর কোন কথা বা তর্ক-বিতর্ক করিনি।তবে নিজের মধ্যে জেদ কাজ করতো সবসময়, আমার লক্ষ্যে আমাকে পৌঁছাতে হবেই।
প্রায় প্রতিদিনই কাঁদতাম,বাবা-মা এর জন্যও মন খুব কাঁদতো আর তাই আল্লাহর কাছে খুব সাহায্য চাইতাম আমাকে ধৈর্য্য দেয়ার জন্য।
না,আল্লাহ আমাকে নিরাশ করেননি।আমি মেডিকেলে চান্স পাই সেদিন ভাবীর মুখে যে অবিশ্বাস আর আশ্চর্য মেশানো অনুভূতি দেখেছি তা আজও ভুলিনি।চান্স পেয়ে,সফলভাবে পড়াশোনা শেষ করি তারপর আর একজন ডাক্তারের সাথেই আমার বিয়েও হয়ে যায় আর সাথে সাথে বদলে যায় ভাবির ব্যবহার।তবে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর থেকে আর ভাইয়ার বাসায় খুব একটা যাই নি।
আজ ভাবির এমন আন্তরিক নিমন্ত্রণ আমাকে অনেক কথা মনে করিয়ে দিল।
দুপুরের আগে আগেই রুহান কে নিয়ে ভাইয়ার বাসায় গেলাম।খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই গল্প করছে আমি সোহা(ভাইয়ার মেয়ে) কে কোলে নিয়ে বসলাম।ভাবি হাসি মুখে বললেন,
-আমিতো সবসময়ই বলি সোহা যেন ওর ফুফুর মতো হয়...
একটু চমকে গেলাম তবে এবার ও কিছু না বলে মুচকি হাসলাম।
সময় কতকিছুই না বদলে দেয়।
পরিশিষ্ট : নিজের একান্ত ইচ্ছা,ধৈর্য্য,চেষ্টা আর আল্লাহর রহমত থাকলে পরিবেশ যত প্রতিকূলই হোক না কেনো বিজয় সুনিশ্চিত।
লিখাঃ রুপন্তী তাহসিন
₪ [ post no: 62 ]