সময় অসময়
সমস্ত আকাশটা কালো হতে না হতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আধভেজা হয়ে বাসার মেইন গেটের কলিংবেলটায় চাপ দিলাম। বাসার সিকিউরিটি গার্ড কাশেম মামা গেইট খুলতে খুলতে বলল,মামা আইজও লেট। আপনারে লইয়া আর পারিনা। দেহেন তো রাত ১২ টা বাজতে চললো। আমি কোন রকম গুটিশুটি হয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কাশেম মামার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলি, মামা ওভার ডিউটি ছিলো। দোকানে আজ অনেক ভিড়। মধ্যবিত্ত হলে যা হয় মামা। কাশেম মামা,আমার কাধে হাত রেখে বললো, আপনের মায় কেমন আছে? মাথাটা নিচু করে বললাম,ভালো না মামা। চিকিৎসায় অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে। দোকানে সেলসম্যানের চাকরী আর দুইটা টিউশনি করে কতই বা চলে বলেন মামা! কাশেম মামার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানুষটা সারাদিন ডিউটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রাত ১০ টায় গেইট বন্ধ হওয়ার কথা অথচ তিনি ১২ টা পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করেন।
পরদিন সকালে মায়ের ফোন, কেমন আছিস বাজান? ভালো মা। তুমি কেমন আছো? আছিরে বাবা ভালো আছি। রত্না কি যেন বলবে তোকে। নে কথা বল। রত্না আমার ছোট বোন। দশম শ্রেণীতে পড়ে। ভাইয়া কেমন আছো? ভালোরে। তুই কেমন আছিস? পড়াশোনা কেমন চলছে? ভালো ভাইয়া। ভাইয়া আমার বই কেনা হয়নি। সামনে আমার পরীক্ষা। আমি বললাম কত টাকা লাগবে রে? ১৫০০ টাকা ভাইয়া। আচ্ছা পাঠায় দেব। গেইট থেকে বের হতেই কাশেম মামা এগিয়ে আসলেন। কি ব্যাপার মন খারাপ কেন? আমি বলি কই না তো। আরে মামা কন তো। কি হইছো। মাসের শেষ কাছে কোন টাকা নাই। এরই মধ্যে বোনের বই কেনার জন্য টাকা লাগবে। ও এই কথা। কাশেম মামা তার জমানো টাকা থেকে আমাকে টাকাটা দিয়ে দিলেন। আমি নিতে চাইনি তবে নিতে হয়েছে। জগতে অনেক কিছুই আছে করতে না চাইলেও করতে হয়, নিতে না চাইলেও নিতে হয়।সন্ধ্যা হয়ে আসলো। টিউশনিতে যেতে হবে। আমার ছাত্রী লামিয়া। একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। ওকে পড়াতে পড়াতেই আন্টি আসলেন। চা বিস্কুট দিয়ে গেলেন। পেটটা ক্ষুধায় চো চো করছে। ক্ষুধার্ত বাঘের মত করে খেতে শুরু করলাম। সবটায় খেয়ে নিলাম। সাথে এক গ্লাস পানি। লামিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে।খেয়াল করিনি। কিছু বলবে লামিয়া। না স্যার। আরে বলো কি বলবে। স্যার আপনাকে কেবল এই একটা নীল শার্ট পড়তে দেখি। আপনার কি আর শার্ট নাই স্যার। আমি চুপ থাকি। তারপর বলি,নীল আমার অনেক পছন্দের। একই রকম শার্ট অনেকগুলো আমার। পড়ানো শেষ করে উঠতে যাবো এমন সময় আন্টি এসে হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। বাবা রাতে গিয়ে বাসায় খেয়ে নিও। বিরিয়ানি,অনেকদিন খায়না। বেশ তৃপ্তি করে খেলাম।
আলতাফ মামার মুদির দোকানে বাকি পড়েছে বেশ। তার সামনে যেতে লজ্জা পায় আমি। টাকাটা কোন মতে শোধ দিতে পারছিনা। উনি আমাকে দেখা মাত্রই বললেন,,মামা টাকা দেওয়া লাগবে না। মাল লাগবে নিয়ে যাবেন।
বন্ধু আশফাক প্রায়ই হোটেলে নিয়ে গিয়ে পেটপুরে খাওয়ায়। আমি বলি তোকে তো কিছুই খেতে দিতে পারিনা। আমার লজ্জা লাগে। আশফাক মাথার চুল টেনে বলে,একদিন তুই আমার সংসারটায় চালিয়ে দিস। তুই অনেক বড় হবি। দেখে নিস।
সামিয়ার সাথে দেখা হয়না অনেকদিন। সামিয়া আমাকে পছন্দ করে। হয়তো ভালবাসে। কিন্তু আমি না। আর যাই হোক প্রেম নামক বিলাসিতা আমাদের মানায় না।মাঝে মাঝে ফোন দেয়। রিসিভ করা হয়না সময়ের অভাবে। সামিয়া মাঝে মাঝে টেক্সট করে। বিকাশে টাকা পাঠিয়ে বলে বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নিবেন। সারাদিন কত পরিশ্রম করেন। আমি অনেক বকা দিই ওকে। কিন্তু শোনে না। লজ্জা বলে কিছু নাই মেয়েটার কেবলই হাসে। মাঝে মাঝে পার্সেল পাঠায়। আমার কেমন জানি খারাপ লাগে। চাকরীর জন্য জোর প্রস্তুতি শুরু করলাম। একটা পরিবারের দায়বদ্ধতা। ছোট বোনের ভবিষ্যৎ। নিজেকে একটু প্রতিষ্ঠিত করা। এভাবে আর কত। সামনে বিসিএস পরীক্ষা। যেভাবেই হোক আমাকে বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে। দিন রাত কেবল পড়াশোনা। পরীক্ষাটা খুবই ভালো দিলাম।
কাশেম মামার সামনে গিয়ে দাড়ায়,,কথা বলতে পারিনা। কিছু কইবেন মামা। আমি মামাকে জড়িয়ে ধরি। মামা আমি বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করেছি। ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গিয়েছি মামা। কাশেম মামা কাদলেন। বড় হও মামা দোয়া করি। লামিয়াদের বাসায় যায়। আন্টি খবরটা পেয়েছেন আগেও। শোন বাবা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আবার আমাদের ভুলে যেওনা। আমি বলি আন্টি আপনাদের সাপোর্ট আর অনুপ্রেরনা ছাড়া কখনও সম্ভব হতো না। আলতাফ মামার দোকানে যায় আমি। মামা শুনলাম আপনে নাকি ম্যাসটেট হইছেন। আমি বললাম হ মামা। ২০০০ টাকা মামাকে দিয়ে বলি এই আপনার টাকা মামা। আলতাফ মামা বলে,,মামা আমি পামু,১২৩০ টাকা। আমি বলি মামা আপনার ঐ ১২৩০ টাকা আমি কখনও শোধ করবোনা। আজীবন ঋনী থাকবো।
বাসা থেকে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। কত উচ্চবংশের মেয়ে। কত আভিজাত্যের ছোয়া, কত সুন্দরী। হবেই বা না কেন ছেলে তো ম্যাজিস্ট্রেট। আমি কোন এক অপরাহ্ণে সামিয়ার সাথে দেখা করি। সেই আগের আমি। দারিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট হওয়া সেই ছেলেটা। সামিয়ার পাশাপাশি বসি এই প্রথম। আপনি তো ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গেছেন। আপনার এই হাল কেন। পুরাতন জরাজীর্ণ শার্ট!! আমি উত্তর দিইনা। সামিয়া ব্যাগ থেকে বক্সটা বের করবা না? নুডুলস নাকি পায়েস? আপনি কি করে জানলেন? আমি জানি। তা কি আমাকে দেবেনা? সামিয়া বোধহয় অবাক হয়। পায়েসর বাটিটা আমার হাতে দেয়। আমি ক্ষুধার্তের ন্যায় খেতে থাকি। সামিয়া তাকিয়ে আছে। আমার উচিত ওকে একটু দেওয়া। কিন্তু আমি দেবনা। ওর হাতের পায়েস খাব বলে রাত থেকে না খেয়ে আছি।আমি জানি ও ঠিক নিয়ে আসবে। আপনি একটুও বদলান নি। আমি ভাবলাম আমাকে আর চিনবেনই না!!
আচ্ছা সামিয়া আমাদের পরিচয় কত দিনের? এই তো ৪ বছর। সামিয়া আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। অনেকটা আগ্রহ নিয়েই বললো,,হুম বলেন।
বাসা থেকে আমার জন্য মেয়ে দেখছে। বিয়ে করতে হবে। বয়স তো কম হলোনা।
সামিয়া মাথাটা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। নিশ্চুপ।
এই সামিয়া মাথা নিচু করবে না তো তুমি। আমার সহ্য হয়না। যার জন্য আমার মাথাটা উচু হয়েছে সে আছে মাথা নিচু করে। তুমি কি আমাকে আজীবন পায়েস রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্বটা নিবে? সামিয়া আমার দিকে তাকায়। চোখজুড়ে অশ্রু। আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বলি,ভালবাসি সামিয়া তোমাকে। সামিয়া আমার কাধে মাথা রাখে। আমি শুন্যের দিকে তাকায় আর ভাবি এসব মানুষগুলোর অনুপ্রেরনা আর সহযোগিতা কাউকে উপরে উঠতে কতটা ভুমিকা রাখে।
ওহ্ সামিয়া কোথায় তুমি? টাই টা খুজে পাচ্ছি না। অফিসের লেইট হয়ে যাচ্ছ। সামিয়া ছুটে আসে। ওকে দেখি আর অতীতের স্মৃতিচারন করি। এ যেন এক কাব্যিক গল্প।
লেখক: এম সোহাগ হোসেন