মন্দবাসা

ট্রেনটা শুভকে ঘারিন্দা স্টেশনে ফেলে ঝিক ঝিক করতে করতে চলে যায় ময়মনসিংহের দিকে। রাতের এই সময়টাতে স্টেশনটা থাকে একদম জনমানবহীন। একে তো শীত; তার উপর গ্রামের ঐ স্টেশন। শুভ একটা সিগরেট জ্বালে। শুভ ছাড়া স্টেশনে আর কোনো মানুষ নেই। স্টেশন মাষ্টার চলে গেছে শেষ ট্রেনটা শুভকে নামিয়ে যাবার পর পর ই। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখতে পায় প্রায় চারটে। একটা কালো কুকুর দৌঁড়ে চলে যায় শুভর সামনে দিয়ে। শীতের এই ঘন কুয়াশাতেও শুভ স্পষ্ট দেখতে পায় উর্বসী সাদা একটা শাড়ি পরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। অফ হোয়াইট এই শালটা শুভ কাস্মীর থেকে এনে দিয়েছিলো উর্বসীকে। ঘাড়ে লাগোয়া খোপা, কানের দুপাশ দিয়ে কোকড়া চুল এক গুচ্ছ করে বেড়িয়ে কয়েক গুণ সৌন্দর্য্য বাড়িয়েছে উর্বসীর। আগের থেকে রোগা লাগছে। তাতে ওর বয়েস কমে আঠেরোতে নেমে এসেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শুভর একদম গায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় সে। কী সুন্দর গন্ধ বেরুচ্ছে উর্বসীর গা থেকে। শুভ চোখ বুজে গন্ধটা টেনে নেয়। হিজল ফুলের মতো গন্ধ। এই গন্ধ সবাই পায়না। কতদিন পর দেখা। তবুও শুভ একটু ও অবাক না হয়ে উর্বসীর দিকে তাকিয়ে বলে:

- রেল স্টেশনে, ভোর রাত্তিরে সাদা শাড়ি পরে এসছো?
- হ্যাঁ এলাম।
- বেশ সুন্দর লাগছে। শুদ্ধ একদম।
- ধন্যবাদ।
- ধন্যবাদ? আর তুমি? তাও আবার আমাকে?
- এই যে তুমি বললে আমাকে সাদা শাড়িতে সুন্দর লাগছে, অথচ সাদা তোমার অপছন্দের রং, আমি কি অবাক হয়েছি? মানুষ বদলায়। তুমিও বদলেছো। আর আমি তো...!
- একটা সিগরেট জ্বালবো?
- একটু আগেই তো একটা পোড়ালে।
- আবার ইচ্ছে করছে।
- অভ্যেসটা এখনো আগের মতোই আছে দেখছি!
- উর্বসী; বারুদের গন্ধটা এখনো পছন্দ তোমার?

দেঁশলাই কাঠি জ্বালতে জ্বালতে বলে শুভ। উর্বসী "হুম" বলে সম্মতি জানায়। শুভ দেঁশলাই কাঁঠিটা ছুড়ে ফেলে ঘাসের উপর। ঘাসের শিঁশির লেগে কাঠির অবশিষ্ট আগুণ "ছ্যাত" শব্দ করে নিভে যায়। উর্বসী তাকিয়ে আছে ঐ দিকে।। সিগরেটে লম্বা একটা টান দিয়ে শুভ আবার বলে:

- ভয় পেয়েছিলে?
- কি ভেবে ভয় পাবো?
- আমি আর ফিরবো না, বা তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি ভেবে!
- হা হা হা!
- তোমার হাসি তেমন ই আছে উর্বসী। বেশ মিষ্টি লাগছে। কিন্তু হাসির কারণ?
- প্রথমত আমার বিশ্বাস ছিলো তুমি চলে যাওনি। আগে চলে যাও; তারপর না হয় ভাববো আর ফিরবে কিনা! আর দ্বিতীয়ত আমি ধোঁকা খাবার ভয়ে ভীত নই। কারণ আমি কখনো কাউকে ধোঁকা দিইনি। যে ধোঁকাবাজি করে এ ভয় টা তার।
- এত বিশ্বাস করে কি লাভ হলো? ঠকলে তো!
- নাহ্, আমি জিতেছি।
- জিতেছো?
- হুম। কারণ দিন শেষে তো আমার কাছেই ফিরেছো এটাকি আমার জয় না?
- উর্ব?
- তুমি এই নামটা বলে ডাকলে এখনো আমার বুকের ভেতর খুব করে গাঁথে ডাকটা। সেই প্রথম দিনের মতোই।
- আমি এতো লম্বা সময় তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলাম। অথচ আমাকে হারাবার ভয় তোমাকে স্পর্শ করেনি? ব্যাথিত করেনি আমার না থাকাটা?? ধোঁকা দিয়েছি ভেবে একবার ও কাঁদোনি তুমি?
- শুভ; ব্যাথিত হওয়া আর ধোঁকা খেয়েছি ভেবে কেঁদে বুক ভাসানো এক নয়। তোমাকে মনে পরেছে।
- চলো একটা খোলা মাঠ খুঁজে বার করি।
- কি করবে? এই রাত্রি বেলা চিৎকার করে বলবে "উর্ব আমি ভালোবাসি তোমায়"?
- আমার বয়স এখন একত্রিশ। সরকারী চাকরীর বয়স ও নেই। আর তোমার কত? সাতাশ না??
- হুম।
- আমরা কেউ ই বাচ্চা নেই আর। তাই চিৎকার করবো না তবে আজ রাতটা আমরা মাঠে কাটাবো।। আমি সিগারেট টানবো। তুমি দেঁশলাই জ্বেলে জ্বেলে বারুদের গন্ধ নিবে। একা একা সিগারেট টেনে এখন আর মজা পাই না। তুমি টানবে বারুদ; আমি সিগারেট।
- তিন বছর পর এসে বলছো আমরা বড় হয়ে গেছি। অথচ আগে একাই সিগারেট ফুঁকতে আর তারপর খেতে পান মশলা। এটা জানার পর থেকে আমি এখনো আমার পার্সে তোমার জন্য পান মশলা নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
- কখনো বলোনি তো!
- সুযোগ পেলাম কোথায়? যোগাযোগ ই তো করোনি। শুধু তোমার পাঠানো মেইল থেকে জেনেছিলাম আমি বিব্রতকর। অতিরিক্ত প্যানপ্যান করি। নীলা তোমাকে বুঝে, সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে পারে তোমার সাথে।
- নীলার কোনো অস্তিত্ব ই আর আমার জীবনে নেই এখন।
- এটা তো হবার ই ছিলো। বলেছিলাম তোমাকে। তুমি বুঝতেই চাওনি।
- না হয় বুঝিনি, তাই বলে তুমি নিজেকে...!!!
- ভগ্ন হৃদয় বুঝে ভাঙনের জ্বালা, চেনা লোকের অচেনা রুপ বড্ড কুৎসিত, ভয়ঙ্কর। সে রুপ দর্শনের ক্ষমতা সবার থাকে না।
- উর্ব আরেকটা সিগারেট জ্বালবো?
- না। এখন আর না।। বাড়ি চলো। আজ বেশ ঠান্ডা। আমরা আরেকদিন বেরুবো খোলা মাঠের খোঁজে।বারুদ টানবো, সিগারেট টানবো। তোমার আসবার খবর পেয়ে মা মাষকলাই ডাল দিয়ে লাউ রেঁধেছে খাবেনা?? মাফলার টা দিয়ে ভালো করে কান, মাথা, নাকসহ পেঁচিয়ে নাও। দশ মিনিটের পথ হলেও বাড়ি যেতে যেতে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।

শুভ হেঁটে হেঁটে স্টেশন থেকে বের হয়ে যায়। বাইরে বেরুতেই টের পায় আজ আসলেই খুব ঠান্ডা। একেবারে আস্ট্রে পিস্ট্রে ধরে আছে। ফোন বেঁজে উঠে শুভর!

- আসসালামুআলাইকুম মা।
- কিরে বাবা কোথায় এখন? মোবারক ফোন ধরছে না কেন? ও কি এয়ারপোর্ট যায় নাই??
- হ্যাঁ মা। গেছিলো। আমি বাসার কাছাকাছি এসে পরছি।
- পথে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?
- না মা। সব ঠিক আছে। আমি ঢাকা থেকে ট্রেনে এসেছি। মোবারক আমাকে কমলাপুর পর্যন্ত দিয়ে গেছে। ও আজ দিনের বেলা আমার জিনিসপত্রসহ গাড়ি নিয়ে আসবে।
- ওও। ভালো করেছিস বাবা। আমি তোর পছন্দের মাষকলাই ডাল দিয়ে লাউ রেঁধেছি। কতদিন পর দেশে ফিরছিস। তারাতারি চলে আয় বাবা। আর শোন উর্বসীর মা বাবাকে একটু ফোন করিস। পারলে কাল ই দেখা করিস।
- করবো মা।

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মনিরা বেগম। কেঁদে কেঁদে আবার বলে:

- ছ মাস হলো উর্বসী চলে গেছে। ও চলে যাবার পর উনাদের আর দেখার মতো অবস্থা নেই বাপ।
- হুম।
- তুই বাবা আর নিজেকে কষ্ট দিস না। যা হবার তা হয়ে গেছে। উর্বসীর কথা আমিও ভুলতে পারিনারে। কত লক্ষী একটা মেয়ে ছিলো। আমি যে কেনো টাঙ্গাইলে থেকে গেলাম?? তুই বিদেশে যাবার পর উর্বসী কতবার বলেছে "মা আপনি ঢাকায় আসেন। এখানে একা লাগে আমার। আমি তো চাকরি করছিই আমরা মা মেয়ে খুব ভালো থাকবো।" আমি যাইনাই। যদি যাইতাম ও এভাবে আগুনে পুড়ে মরতো না। সব দোষ আমার।
- কেঁদোনা মা। আমি বাড়ি ফিরছি। তারপর কথা বলছি।

চোখের কোণে জলটা আঙুলের ছোঁয়ায় মুছে ফেলে শুভ।

- কাঁদছো কেনো?
- কেনো চলে গেলে উর্ব? আমাকে আরেকটা সুযোগ দিতে পারতে না?
- হয়তো পারতাম। কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোইবাসিনি। তাই তোমার সমস্ত মন্দ জেনেও কখনো বুঝতে দিইনি। পাঁছে তুমি হীনমন্যতায় ভুগো। তোমার মন্দের সাথে বাস করে করে তোমায় মন্দবেসেছিলাম প্রিয়।
- তাই বলে!! জানোনা এটা কত বড় পাপ? কেনো করলে উর্ব!
- মেয়েদের মতো কেঁদোনা শুভ। দেখি চোখ মুছো। আমি থাকলে তোমার পাপ বেড়ে যাচ্ছিলো। তোমাদের সম্পর্ক বৈধ করতেই আমার এই অবৈধ বিদায়। তোমার মন্দটুকু নিয়েই আমি চলে গেলাম। মন্দবেসেছি তো! শুভ তুমি আমার হাতটাকে ভীষণ ভরসা করতে এইটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো। যেদিন নীলাকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলে আমি তার আগে থেকেই সব জানতাম। বলিনি তো কাউকে!! যদি তোমার বদনাম হয়। ছ মাস আগে যখন মেইল করে বললে তুমি আমার কাছে আর ফিরবে না। নীলা প্রচন্ড টেক কেয়ার করে তোমার। সেদিন বারুদের গন্ধটা খুব নিতে ইচ্ছে হলো। ভাবলাম এখন আর আমার থাকা না থাকায় তোমার কিছু যায় আসে না।
- সবাই জানলো এক্সিডেন্ট! আমাকে কেবল মেইল করলে:

"আমার মন্দবাসা প্রিয়তম্
বারুদ আমায় টানছে ভীষম্
ভালো থেকো সুখ;
এই জন্মের ঘরকন্যাটা এইটুই থাকুক!"

- এই যা, দেখো হাঁটতে হাঁটতে আমিও বাড়ি অবদি চলে এলাম। যাও ভেতরে যাও। মা অপেক্ষা করছে তো। ভালো থেকো শুভ।
- উর্ব যেও না!! যেওনা প্লিজ আর একটা সুযোগ উর্ব! উর্ব আমার! আমার উর্ব! এখনো সব ই বাকি!! যেওনা প্লিজ!!

শুভর চিৎকারে শুধু কয়েকটা পাখির ঘুম ভাঙে। পাখিগুলো ডানা ঝাপটায় আর ভয়ে কিঁচির মিঁচির করে উঠে। উর্বসীর ঠোঁটের কোণে হাসি আর চোখের কোণে জল, শুভ দেখতে থাকে আস্তে আস্তে ভোরের আলোর সাথে কেমন মিলিয়ে গেলো উর্বসীর ছাঁয়াটা।


লিখা: আম্বিয়া রত্না

Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

রিয়্যাক্টর কিং

একটি মেয়ের গল্প

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]