টুইন বেবি

- ৩নম্বর বেডের পেশেন্ট কার?

- জ্বি, আমার।

- আপনার নাম?

- অভি, মানে রেজুয়ান অভি।

- পেশেন্ট আপনার কি হন?

- জ্বি, আমার স্ত্রী।

- কত মাসের অন্তঃস্বত্তা?

- নয় মাসের।

- আচ্ছা এখানে বসে ফর্মটিপূরণ করুন, পেশেন্টকে অতি শীঘ্রই ও.টি. তে নেওয়া হবে।

মৃত্তিকা আর আমার সংসার প্রায় তিন বছরের। হাতে চাকরি থাকায় পরিবারের অমতে গিয়েই পালিয়ে আমরা বিয়ে করেছিলাম। অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে নিজেদের সুখের সংসার গড়ে তুলি। আর এই সংসারে আজ নতুন অতিথির আগমন হতে চলেছে। হিহিহি, আমি বাবা হতে চলেছি।

- দেখে নিও মৃত্তিকা, আমাদের মেয়েটা একদম তোমার মতোই মায়াবী হবে।

- কে বললো মেয়ে হবে, আমাদের ছেলে হবে।

- না, মেয়ে হবে।

- চুপ, ছেলে হবে।

- না, তোমার মতোই একটা সুন্দর রাজকন্যা হবে আমার।

- জ্বি না, মহাশয়। আমার তো ছেলে'ই চাই।

- আচ্ছা বাবা, আল্লাহ যা দিবেন সেটাই মেনে নেওয়া হবে।

- আমার তো ছেলে'ই হবে।

- উফফফ।

বিগত মাসগুলোতে প্রতিদিন সকাল বিকাল এটি ছিলো আমার আর মৃত্তিকার ঝগড়ার টপিক। মৃত্তিকা একদম মন থেকেই চায়, যেন আমার মতো দেখতে লম্বা নাকের একটা ছেলে সে জন্ম দেয়। আর তাছাড়াও জন্মের পরপরই মৃত্তিকা তার বাবাকে হারিয়ে ফেলে, তাই একটা ছেলে সন্তান জন্ম দেয়ার প্রতি মৃত্তিকার এতো আকূলতা।

অন্যদিকে আমি আবার জন্মের সময় নিজের মা'কে হারিয়ে ফেলি। মায়ের আদর কোনোদিনও আমার কপালে জোটে নি। তাই আমি আবার চাই আমার মা'য়ের অভাব পূরণে যেন একটা কন্যা সন্তান জন্ম হয়।

কিন্তু, কি আর করার। আল্লাহ যা দিবেন, সেটাই তো মেনে নিতে হবে। আর তাতেই আমরা খুশি।

- মেঘের জন্য ছোট ছোট সুন্দর ফতুয়া কিনে নিয়ে আসবা।

- মেঘ কে?

- আজিব আমাদের যদি ছেলে mহয়, তাহলে তার নাম হবে মেঘ।

- নামটাও ঠিক করা হয়ে গেলো মহারাণী?

- আপনি যদি বিয়ের আগেই মেয়ের নাম আয়াত ঠিক করতে পারেন, তাহলে আমি কেনো ছেলের নাম ঠিক করতে পারবো না।

- ছেলে হলে মেঘ, মেয়ে হলে আয়াত।

- হুম, মানাইছে না?

- জ্বি মহারাণী।

- মেঘের ফতুয়া মনে করে বাড়ি ফেরার সময় নিয়ে আসবা, ওকে!

- যথা আজ্ঞা মহারাণী।

এটি ছিলো আজ সকালের কথোপকথন। মৃত্তিকার কথামতো সন্ধ্যাবেলা অফিস শেষে ফতুয়া কিনতে শপিংমলে গিয়েছি, আর অমনিই বাড়িওয়ালার নাম্বার থেকে একটা কল আসে।

কল রিসিভ করতেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বাড়িওয়ালা আন্টি মৃত্তিকার ইমার্জেন্সির কথা বলে ওঠে। আমি তখনই সব ফেলে তড়িঘড়ি করে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাসা থেকে মৃত্তিকাকে তুলে এই হসপিটালে এডমিট করি। আর এখন প্রায় রাত সোয়া এগারোটা বাজতে চললো, মৃত্তিকা এখনও ও.টি.তে. তেই অবস্থানরত।

হঠাৎ মৃত্তিকার ও.টি. রুম থেকে দু'জন নার্স ছুটতে বের হয়ে আসে,

- কি ব্যাপার , কি হয়েছে?

- রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল।

- কি বলছেন?

- হ্যাঁ, শান্ত হন।

- সিরিয়াস কিছু হয়েছে কি?

- আল্লাহকে স্মরণ করুন।

- বলবেন তো কি হয়েছে?

- আমাদের যেতে দিন, শান্ত হয়ে বসুন।

পাশ কাটিয়ে নার্স দু'জন চলে গেলো। আমি ধুম করে পাশের চেয়ারে বসে পড়ি। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গিয়েছে। চারপাশ ক্রমাগত অন্ধকার হয়ে আসছে। জীবনের চরম এক মুহূর্তে আমি পতিত হয়েছি। জানি না, এর পরিণতি কি হবে। জীবনটা যেন এক নিমেষে থমকে গিয়েছে।

সেই দু'জন নার্সকে আবার দেখতে পেলাম। দু'ব্যাগ রক্ত আর অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ও.টি. রুমের দিকে ছুটছে।

- একটু দাঁড়ান, কোনো সিরিয়াস কিছু হয়েছে কি?

- পেশেন্টের অতিরিক্ত ব্লিডিং হয়েছে।

- ইয়া আল্লাহ।

- আপনি শান্ত হন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

- আমার স্ত্রীর কিছু হবে নাতো?

- আল্লাহ, আল্লাহ করুন। সরুন, যেতে দিন।

চারপাশে হাজার মানুষের সমাগম থাকলেও আমি তখন নিজেকে খুব অসহায় অনুভব করতে থাকি। বারবার নিজের ভাগ্যের কথা মনে হতে থাকে। মৃত্তিকাও যদি আমার মায়ের মতো...............।

না, কি আজেবাজে ভাবছি। এমন কিছুই হবার নয়। মহান আল্লাহ এতো নির্দয় নন। কিন্তু, মৃত্তিকার কিছু হলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না, বেঁচে থাকাটাই আমার মূল্যহীন হয়ে পড়বে মৃত্তিকাকে ছাড়া। বড্ড বেশি ভালোবাসি এই মৃত্তিকাটা'কে।

সুখের সংসারের যাবতীয় স্বপ্ন কি তাহলে এক নিমিষে দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।যদি সন্তানের'ই কিছু নয়, তখন আবার মৃত্তিকাকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। আর মৃত্তিকার কিছু হলে আমি তা মেনে নিতে পারবো না।

পরিস্থিতি এখন এমন যে আমার, মৃত্তিকা আর আমাদের সন্তানের জীবন এখন এক অনিশ্চিত ভঙ্গুর সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে। যখন তখন তা ছিড়ে পড়তে পারে। সুখের সংসার নিমিষেই জাহান্নামে পরিণত হতে পারে। এগুলো আজেবাজে ভাবতে থাকি আর তা না হওয়ার জন্য আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আল্লাহকে ডাকতে থাকি।

সারারাত পেরিয়ে ভোর সাড়ে চারটা। ও.টি. রুমের সবুজ আলো নিভে গেলো। মানে, অপারেশন শেষ। দ্রুত রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ, একজন ডাক্তার রুম থেকে বাইরে বের হয়ে আসলেন,

- ডাক্তার, কি হলো, কি হলো!

- জ্বি, কে আপনি।

- আমি পেশেন্টের হাজব্যান্ড। আমার স্ত্রী ঠিক আছে তো!

- ওও আচ্ছা।

- কিছু বলছেন না কেন! আমার স্ত্রী-সন্তান ঠিক আছে
তো?

- দেখুন......

- প্লিজ বলুন, সব ঠিক আছে তো, প্লিজ।

- আরে মশাই, শান্ত হন একটু।

- কি হয়েছে বলুন।

- জ্বি, মিষ্টি নিয়ে আসুন।

- একটু ভালোভাবে বলুন!

- আরে মশাই কানে শুনেন না, মিষ্টি নিয়ে আসুন। আপনি বাবা হয়েছেন।

- আল্লাহ! আর আর আমার স্ত্রী?

- জ্বি, তিনিও সম্পূর্ণ সুস্থ।

- আলহামদুলিল্লাহ।

- অভিনন্দন।

- জ্বি, আমার ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছে?

- মহাশয়, আপনার টুইন বেবি হয়েছে। ছেলে আর মেয়ে।

- সত্যি?

- জ্বি।

- আমি কি ভেতরে যেতে পারবো?

- অবশ্যই। তবে মিনিট পনেরো পরে।

- ধন্যবাদ।

আমার আনন্দ দেখে কে। দুনিয়ার সমস্ত সুখ একদিকে আর বাবা হওয়ার আনন্দ একদিকে। নিজের প্রতি আজ খুব গর্ব হচ্ছে।

যাই হোক, বাচ্চাদের মতো গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে মিনিট পনেরো পর ও.টি. রুমে প্রবেশ করি। ভেতরে ঢুকে দেখি, সাক্ষাত এক পরী তার দু'পাশে দুজন নিষ্পাপ সত্ত্বাকে জড়িয়ে মুচকি হেসে কথা বলে চলেছে।

আমাকে দেখেই সে পরী মানে মৃত্তিকা আমার হাত ধরে আনন্দের অশ্রু ঝরাতে শুরু করে। আমি শুধু অপলক দৃষ্টিতে আমার টুইন সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছে।

কি সুন্দর দেখতে হয়েছে! দু'ভাই বোন দেখতে অনেকটা একে অপরের মতোই। আমার সন্তান তারা, ভোরের মিষ্টি আলোয় দু'জনকেই একদম ফেরেশতার মতো লাগছে। মেঘ আর আয়াত; আমার কলিজার টুকরো।

- তুমি খুশি তো?

- ভালোবাসি মৃত্তিকা।

- শুধু আমাকে ভালোবাসো?

- উহু,

- তাহলে!

আর আমি কথা বলতে পারি না। মৃত্তিকা'কে জড়িয়ে ধরি। সুখের অশ্রু মনভরে ঝরাতে থাকি। এ সুখের যেন শেষ নেই, প্রতিটি হৃদস্পন্দনে আজ আমার সুখ লেপ্টে গিয়েছে। মৃত্তিকার প্রতি আজ ভালোবাসার শেষ নেই। অন্যদিকে পাশে থাকা মেঘ আর আয়াত চুপটি করে তাদের মায়ের কোমলতায় ঘুমিয়ে আছে।

আমার আর মৃত্তিকার প্রেমময় মুহূর্ত চলাকালীন হঠাৎ মেঘ আর আয়াতের ঘুম ভাঙায় দু'জনেই কান্না জুড়ে বসে।

- মি. বাবা, নেন এবার বাচ্চা সামলান।

- জ্বি মহারাণী।

- ড্রাইপার কিন্তু তুমি চেঞ্জ করবা।

- মানে, আমি সেটা পারবো না।

- চুপ, তোমাকেই পারতে হবে।

- কিন্তু কেন?

- যা বলেছি চুপচাপ করবা, নইলে কিন্তু ছেলে-মেয়ে নিয়ে সরাসরি বাপের বাড়ি চলে যাবো।

- আচ্ছা, আমিই ড্রাইপার চেঞ্জ করবো ।

- হ্যাঁ, মনে থাকবে তো?

- আপনার আদেশ স্বীয়ধার্য মহারাণী।


লেখা - Rejuan Ovi

Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

রিয়্যাক্টর কিং

একটি মেয়ের গল্প

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]