₪ চন্দ্রাঘাত [post no: 47]

আমার বউয়ের নামে প্রতিদিন একটা করে পার্সেল আসে । পার্সেলের গায়ে কোনো প্রেরকের ঠিকানা থাকে না । কিন্তু প্রতিটি পার্সেলই কুরিয়ার সার্ভিস থেকে আসে । কোনোদিন বিকেলে আবার কোনোদিন সন্ধ্যায় অথবা রাতে আসে । বেশিরভাগ পার্সেলই রাতে আসে । আমি অফিস থেকে ফেরার পর নিত্য দিন এই ঘটনা ঘটছে । যেদিন রাতে পার্সেল আসে না সেদিন আমি বউকে জিজ্ঞেস করলে বলে
-আজ কোনো পার্সেল আসেনি ।
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি , বউ আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছে ।

আমার বিশ্বাস বউয়ের কোনো প্রাক্তন এসব পাঠাচ্ছে। এবং বউ সেটা জানে । আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রতিটি পার্সেলের ভেতরেই ফাঁকা ।কোনো কিছু নেই । শুধু শুধু ফাঁকা পার্সেল পাঠানোর ইঙ্গিত আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না । বিষয়টি নিয়ে বউয়ের সাথে ইদানীং ঝগড়া লেগেই আছে । পার্সেলের প্রাপকের জায়গা খুব সুন্দর করে লেখা থাকে ""জান্নাত"" । আর এড্রেসে থাকে , কলেজ রোড , কাটাই খানা মোড়, কুষ্টিয়া । হোল্ডিং নাম্বার ৩৬ । হ্যাঁ এই বাড়িতেই আমি থাকি । এর আগে এমন আশ্চর্য জনক ঘটনা আর ঘটেনি । ভাড়া বাসার তিনতলায় আমরা থাকি । দুটো মাঝারি সাইজের রুম । পাশের ফ্ল্যাটে অন্য এক পরিবার থাকে । সেইভাবে কখনও পরিচয় হয়নি । কিন্তু চেনাজানা আছে টুকটাক ।

অফিসে বসে পার্সেলের ব্যপারেই ভাবছিলাম । পার্সেলটা কে দেয় এটা জানতেই হবে । কিন্তু কিভাবে যে জানবো বুঝতে পারছি না । কুরিয়ার অফিসে গেলে ওরাও ঠিক কিছু বলতে পারে না । বলে
-এইভাবেই পার্সেল আসছে , আর আমরা তা পৌঁছে দিছি । অনেক সময় কাউকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য অনেকেই নাম ঠিকানা গোপন রাখে । এটা কোনো সিরিয়াস ইস্যু না । এই ব্যপারে আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না ।

এই পর্যন্ত বিশটার বেশি পার্সেল এসেছে ।বিষয়টি নিয়ে এত ভাবতাম না । কিন্তু পার্সেলটা জান্নাতের নামে আসছে , আমাকে ভাবতে বাধ্য হতে হচ্ছে । ভুল করে একটা পার্সেল আসতে পারে ‌ । কিন্তু একাধিক পার্সেল ভুল করে আমার বাসায় আসা সম্ভব না । কেউ হয়তো আমাদের নিয়ে মজা করছে আর নয়তো জান্নাতের কোনো চেনা মানুষ এসব করছে ।

অফিসে কিছুতেই মন টিকছে না । আজকের জন্য ছুটি নিলাম । তবে বাসায় ঢুকবো না । রাত অব্দি বাসার সামনে লুকিয়ে থাকবো । দেখবো পার্সেল আসা দেখে জান্নাত খুশি হয় নাকি বিরক্ত । পার্সেলটা নিয়ে জান্নাত রুমের ভেতর কি করে সেটা দেখা বেশি জরুরি ।
তাই একটা গোপন সিসি ক্যামেরা কিনে রুমের মধ্যে লাগাতে হবে । জান্নাত পার্সেলটা নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে । আর নিশ্চিত যে ও বেড রুমেই ঢুকবে । বেড রুমে ঢুকে পার্সেলটা কি করে দেখতেই হবে । একটা গোপন সিসি ক্যামেরা কিনলাম । ক্যামেরাটা খুবই শূক্ষ । জামার বোতাম থেকে একটু বড় । এর একটা বিশেষ সুবিধা হচ্ছে মোবাইলে কানেক্ট করা যাবে । তার বিহীন বিশ মিটারের মধ্যে লাইভ শো-অন থাকবে । কিন্তু বিশ মিটার দূরে গেলে মোবাইলে আর কিছু দেখা যাবে না । তবে ভিডিওটি রেকর্ড হয়ে থাকবে । চাইলেই পরে আবার দেখার সুযোগ আছে । এই সুবিধা পাওয়ার জন্য মোবাইলে মাইক্রোসফট অফিস সেটআপ করতে হবে । দোকানদার বারবার এই এক কথা মনে করিয়ে দিয়েছে ।

দরজায় কয়েকবার টোকা দিলাম জান্নাতের কোনো সাড়া শব্দ নেই । দুপুরের বয়স কমে আর অল্প আছে।অর্থাৎ বিকেল ছুঁই ছুঁই করছে । আমার কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুললাম । বাথরুম থেকে পানির টুপটাপ আওয়াজ আসছে । তারমানে জান্নাত গোসল করছে । আমি এই ফাকে ক্যামেরাটা জায়গা মতো সেট করে দিলাম । জান্নাত বাথরুম থেকে বের হয়ে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ।কারণ আমি দুপরে বাসায় আসি না । জান্নাত আশা করেনি এই অসময়ে আমাকে দেখবে । জান্নাত তোতলাতে তোতলাতে বলল
-তুমি এখন বাসায় ! কিছু হয়েছে ?
একজন মেয়েকে সব চেয়ে বেশি সুন্দর লাগে কখন জানেন ? সে যখন ঘুমায় । আপনার যদি ভালোবাসা নামক চোখ থাকে , তবে আপনি গভীর রাতে পাশের মানুষের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন । মেয়েদের দ্বিতীয় সুন্দর লাগে মেয়েরা যখন লজ্জা পায় ।আর তৃতীয় সুন্দর লাগে মাত্র গোসল করে , হালকা ভেজা ভেজা শাড়িতে । চুল দিয়ে টুপটাপ করে পানি পড়বে ।টুপটাপ করে পানি পরার মাঝে থাকবে বিশাল বিরতি । দেখে মনে হবে ঠিক যেন শিঁশির ফোঁটায় ঘাস শুলে চড়িয়েছে ।
আমি সবকিছু ভুলে নরমাল হলাম । আদুরে কণ্ঠে বললাম
-তোমার এই ভেজা ভেজা চুল , কাজল উঠে যাওয়া চোখের মায়ায় আরও একবার হারানোর জন্য আমি উপস্থিত । জান্নাত কিছুই বলল না । ওর কাছে আমার কথা গুলো ঢং মনে হলো । কিন্তু আমি তো ঢং করিনি।তবে !
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বাসা থেকে বের হলাম । বাসার পাশের এক টং দোকানে বসে চা খেতে লাগলাম । দোকান থেকে আমার ফ্ল্যাটের মেইন দরজা পরিষ্কার দেখা যায় । এই সুবিধার জন্যই এখানে বসা ।

 বিকেলের শেষের দিক তবুও কোনো পার্সেল আসার নাম নেই ।তবে কি আজ পার্সেল আসবে না ? সন্ধ্যার খানিকটা আগে একটা লোক ছোট্ট একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসার সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠলো । তিনতলায় উঠে আমার মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজালো । খানিকটা পরে জান্নাত হাসিমুখে পার্সেলটা নিয়ে একটা সাইন করে দিল । তারপর দরজা বন্ধ করে দিল । লোকটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নেমে এলো ।আমি তাড়াহুড়ো করে মোবাইল বের করলাম । মোবাইলে রুমের মধ্যের সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । জান্নাত পার্সেলটা ধপ করে বিছানার উপর ফেলে দিল।আমি আশা করেছিলাম জান্নাত পার্সেলটা খুলবে আর আমি সেটা লুকিয়ে দেখবো । আসলেই কি পার্সেলে কিছু আছে নাকি নাই । জান্নাত পার্সেলটা না খুলে শাড়ি খুলতে শুরু করলো । শাড়ি খোলার মাঝামাঝি পর্যন্ত আমি চোখ স্কিনে রাখলাম ।তারপর আমার মনে হলো মোবাইলের কানেক্ট এখন বন্ধ করা উচিৎ । কিছুক্ষণ পরও পার্সেলটা ঠিক আগের মতোই আছে । পার্সেলের প্রতি জান্নাতের কোনো আগ্ৰহ নেই । সন্ধ্যার একটু পরে বাসায় ঢুকলাম । জান্নাত নতুন একটা শাড়ি পড়েছে ।আমি বললাম
-গোসল করে তো অন্য একটা শাড়ি পড়েছিলে । এখন আবার এটা পড়লে কেন ?
-রান্না করতে যেয়ে শাড়িতে ঝোল পড়েছে তাই চেঞ্জ করলাম । কেন ? হঠাৎ এই কথা ?
- না এমনি ।
সেই একই দিনে আরও একটি পার্সেল আসলো । আমি এবার অবাকের শেষ সীমান্তে পৌঁছে গেলাম । জান্নাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম । জান্নাত কাচুমাচু করে বসে পড়লো । কিছুই বললো না । পার্সেলটা খুললাম । পার্সেলের মধ্যে সাদা একটা কাগজ । সেখানে কিছুই লেখা নেই । এমন ঘটনাতে আমি সত্যিই খুব চিন্তিত । জান্নাতের দিকে আমার সন্দেহ নেই । প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ । কেউ আমাদের সাথে ফাজলামি করছে এটা আমি নিশ্চিত । আমি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম ।

শুধু শুধু সংসারে অশান্তি বাঁধিয়ে কোনো ফলপ্রসূ নেই ‌। জান্নাত আমার দিকে তাকাচ্ছে না । সেইদিন প্রথম পার্সেল আসলে ওকে খুব বাজে কথা বলেছিলাম । নষ্টা মেয়ে বলেছিলাম । আরও অনেক খারাপ কথা । কিন্তু জান্নাত সেইদিন কোনো কথা বলেনি । আমার নিজের কাছেই এখন খুব আফসোস হচ্ছে ।বড় ভুল করে ফেলেছি । জান্নাতের কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। আমি জান্নাতের হাত ধরলাম
-আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ । আমি না বুঝে তোমাকে অনেক গালি দিয়েছি । আমি লজ্জিত ।

জান্নাত কিছু বলল না । চুপচাপ বেড রুমে চলে গেল । বুঝলাম এতে হবে না । বড্ড অভিমান অল্পতে ভাঙবে না ।
পরের দিন সকালে অফিসে যাবো ঠিক তার আগেই আর একটা পার্সেল আসলো । প্রেরেরকের জায়গায় একটা ঠিকানা দেওয়া । ঠিকানাটা কুষ্টিয়ার কারো । চৌরহাস মোড়ের ওইদিকে ।

যাইহোক পার্সেলটা খুললাম । পার্সেলের ভেতর একটা পুতুল আর একটা চিঠি । চিঠিতে দুই লাইন লেখা । লেখাটা পড়ে আমি ধপ করে ছোপায় বসে পড়লাম । আমার শরীর প্রচণ্ড রকম ঘামছে । জান্নাত আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো । তারপর আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে , মাথা দুলিয়ে বলল , না না না !

আমার মনে রাগান্বিত ভাব । সব কিছু মেনে নিলেও বউয়ের নামে লাভ লেটার আসাটা মেনে নেওয়া যায় না । কাগজটায় লেখা , ইদানিং কিন্তু কিছুই দিচ্ছো না । দূরে দূরে থাকছো । আবার আমার চিঠির কোনো উত্তরও দিচ্ছো না । এত্তগুলা টাকা নিয়ে গেলে । কিন্তু টাকার বদলে কিছুই না দিয়ে লুকোচুরি খেলছো ।কি হয়েছে তোমার ? জান্নাত তুমি ঠিক আছোতো ?
জান্নাত কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল
-বিশ্বাস করো আমি এসবের কিছুই জানিনা । আর কোনো চিঠিও আমি পাইনি । আমি সত্যি বলছি ।
আমার রাগ মাথায় চড়ে বসলো । অফিসে আর যাওয়া হলো না ।
-চুপ , একদম চুপ। তুই বলতে চাচ্ছিস সব পার্সেল ভুল করে এসেছে ? মানুষ এতটাও পাগল না । আমাকে আর একদম ভুলভাল বোঝানোর চেষ্টা করবি না ।
-প্লিজ আমার কথা শোনো একবার ।
-কোনো কথা শুনবো না । নষ্টা মেয়ে । তোর কথা , শরীর সব অপবিত্র হয়ে গেছে । টাকাও নিয়েছিস ! বাহ খুব ভালো । আমার গর্ব হচ্ছে , আমার বউ একজন দেহ ব্যবসায়ী ।
জান্নাত কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বলল
-না ! সব মিথ্যে । সব মিথ্যে ।

আমি আর কিছুই বললাম না । কিছু বলতেও ঘৃণা হচ্ছে । নিজের কাছেই নিজের কেমন অপদার্থ মনে হচ্ছে । টাকার জন্য আমার বউ এসব করে ? ছিঃ ! আমি একটা ব্যর্থ পুরুষ । বউয়ের টাকার অভাব মিটাতে পারি না ।
জান্নাত কাঁদছে । হাউমাউ করে কাঁদছে । বালিশ মুখে চেপে কান্না করা ওর স্বভাব । প্রিয় মানুষের দেওয়া কষ্টে মানুষ হাউমাউ করে কাঁদে । তাছাড়া কেউ হাউমাউ করে কাঁদে না । এই বাক্যটা আমার কাছে ভুল মনে হয় । বরং মানুষ সবসময়ই চুপিচুপি কাঁদতে পছন্দ করে । যখন কোনো কথা বলতে চাচ্ছে বা তাকে কেউ বিশ্বাস করছে না ঠিক তখনই হাউমাউ করে কেঁদে বাড়ি বাজিয়ে তোলার প্রয়োজন হয় । জান্নাতকে আর কি বিশ্বাস করবো ? ওকে আমি আর বিশ্বাস করি না । এতদিন যা করেছি সব ভুল । সব প্রমাণ তো আমার চোখের সামনেই । শুধু আমার চোখের সামনে না । বরং জান্নাতের চোখের সামনেও । জান্নাতকে নিয়ে আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না । ওর দিকে তাকাতেও ইচ্ছা হচ্ছে না ।

বাসা থেকে বের হলাম । চৌড়হাস মোড়ের দিকে যাবো। এখান থেকে চৌড়হাস মোড়ে যেতে আঠারো টাকা ভাড়া লাগে । আগে পনেরো টাকা নিত । কিন্তু কয়েকদিন আগে অটো,রিকশা ধর্ম জোট করে তিন টাকা ভাড়া বারিয়েছে । কলেজ মোড় থেকে মোল্লাতাগর পর্যন্ত পাঁচ টাকা ভাড়া ছিল । কিন্তু এখন আট টাকা । ধর্মঘট আর ধর্ম জোট একই ব্যপার । বাক্যের মানেও এক । তবুও আমরা ধর্মঘট বলি । শেষ পার্সেলটা এসেছে চৌড়হাস মোড় থেকেই । চৌড়হাস মোড়ের কোন বাড়িটা সেটা এখন খুঁজে বের করাই আমার মূখ্য কাজ । আর কেন পার্সেল পাঠিয়েছে সেটাও জানতে হবে । পার্সেলের মধ্যে আবার একটা সুন্দর পুতুলও দিয়েছে । পুতুলটা সুন্দর । কিন্তু যে লোকটা পুতলটা পাঠিয়েছে তার কর্মকাণ্ড একদম ভালো না । এসব সংসার ভাঙার জন্য যথেষ্ট ।

অনেক সময় ধরে চৌড়হাস মোড়ে ঘুরাঘুরি করলাম । পশ্চিম দিকে মুখ করে একটা প্লেন দাঁড়িয়ে আছে । সেই ছোট্ট থেকেই দেখছি প্লেনটা ঠিক একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে । এর কোনো যাত্রী নেই । সে নিজেও চলতে পারে না । ইট বালু দিয়ে প্লেন বানালে সেটা কখনও চলে ?
মধ্য দুপুর । রোদের মাত্রা কমতে নিয়েছে । রোদটা কেমন পাতলা পাতলা লাগছে । মনে হচ্ছে না মাথার উপর সূর্য আছে । কাউকে তিনদিন বদ্ধ ঘরে রেখে দিয়ে , এখন এই রোদের মধ্যে চোখ বেধে ছেড়ে দিয়ে যদি বলা যায় , বলেনতো এটা দিন না রাত ?
সে কোনো ভণিতা ছাড়াই পাতলা রোদকে পূর্ণিমা ভেবে বসবে । আর চটপট বলবে
-এটা তো মধ্য রাত । ভরপুর পূর্ণিমা ।
পাশের হৈচৈ আমার নজর কাড়লো । ছোট খাটো একটা জটলা । আমি এগিয়ে গেলাম । ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢোকা কষ্ট । কোনোমতে ভেতরে ঢুকে দেখি একটা লোক বসে আছে । বৃদ্ধের ছাপ পড়েছে তাঁর সর্বাঙ্গে । কপালে খানিকটা কেটে গেছে । হাতের কুনুই দিয়ে রক্ত পড়ছে । তাকে এখনই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া দরকার । কিন্তু কেউই এগিয়ে আসছে না । কেউই উদ্যোগ নিচ্ছে না ‌ । বৃদ্ধকে উঠে দাঁড় করালাম । ভিড় আস্তে আস্তে কমে গেল । এখান থেকে হসপিটাল যেতে বিশ মিনিট লাগবে । পাশেই একটা ক্লিনিক আছে ‌। নূরুন্নাহার ক্লিনিক । হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে । কিন্তু বৃদ্বকে নিয়ে হাঁটা সম্ভব নয় । একটা অটোতে ক্লিনিকে নিলাম ।
আধা ঘন্টা পর বৃদ্ধকে নার্স বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিল । ক্লিনিকটা আমার পূর্ব পরিচিত । এই ক্লিনিকের সাথে আমার দীর্ঘ পাঁচ দিনের সম্পর্ক । বাবার পেটে পাথর হলো । বাবা কিছুতেই অপারেশন করাবেন না । উনাকে জোর করা হলো । মা রাগারাগি করলেন । এক পর্যায়ে তিনি রাজি হলেন । সাথে একটা শর্ত জুড়ে দিলেন । ডাক্তার সুরেশ কুমার এবং নুরুন্নাহার ক্লিনিক ছাড়া উনি কিছুতেই অপারেশন করাবেন না । আর্থিক অবস্থা নাজেহাল । তাই বাবা ভাবছিলেন এত প্রাইভেট ভাবে ,এত খরচা করে তাকে অপারেশন করাবো না। কারণ সরকারি হসপিটালে তিন হাজার টাকায় সব কিছু করে দিচ্ছে । সেখানে প্রাইভেটে করলে ত্রিশ হাজারের বেশি টাকা খরচ হবে । বাবার ধারণা পুরোপুরি মিথ্যে করে আমি বললাম
-নুরুন্নাহার ক্লিনিক এবং সুরেশ কুমার দিয়েই অপারেশন করানো হবে । খরচ যা হয় হোক ।
আমার কথায় দুলাভাই আপত্তি করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন
-অযথা এত টাকা খরচ করার কোনো মানে হয় ? এমনিতেই অর্থ সংকটে আছিস।
আমি কারো কথা মানিনি । বাবাকে বাবার ইচ্ছা মতোই অপারেশন করার সব ব্যবস্থা করলাম ।
বাবা আমার কথা শুনে অবাক হলেন । এত বাড়তি খরচা করবো তিনি ভাবেননি । তিনি আর একটা শর্ত দিলেন । বললেন ,
-অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার সুরেশ কুমারকে দেখার পর যেন আমাকে অজ্ঞান করা হয় ।
আমি বললাম তাই হবে ।
বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হলো । ডাক্তার নাস্তা করছিলেন । আমি বাবার দ্বিতীয় ইচ্ছার কথা বললাম । ডাক্তার হেসে গড়িয়ে পড়লেন । এমন অদ্ভুত রুগি তিনি এর আগে দেখেছেন মনে হয় না ।
আসল কথা হচ্ছে বাবা খুব ভিতু । তিনি চাচ্ছিলেন না অপারেশন করাতে । যেকোনো ভাবে অপারেশন আটকাতে চাচ্ছিলেন । কিন্তু পারেনি । একটা কথা সত্য , মানুষ যখন অসুস্থ হয় তখন তার মস্তিষ্ক এবং চেহারা বাচ্চাদের ন্যায় হয়ে যায় ।
-বাবা তোমার নাম কি ?
বৃদ্ধর কথায় আমার ঘোর কাটলো ।
-মিনহাজ ।
-থাকো কোথায় ?
-কাটাইখানা মোড়ে ।
-তো ওইখানে কি করতেছিলে ?
-একজনকে খুঁজতেছি ।
-পাইছো ?
-না ।
-আচ্ছা চাচা , ১২১ নাম্বার বাড়ি বটতৈল রোড চিনেন নাকি ? এই ঠিকানাটা খুঁজে পাচ্ছি না । লোকটার নাম আলমগীর ।
বৃদ্ধ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল
-এটাতো আমার বাড়ি । কিন্তু আলমগীর নামের কেউ থাকে না । নিচতলায় একজন ভাড়া থাকতো । তাঁর নাম জামসেদ । মাঝে মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিত । কিন্তু গতকাল হঠাৎ বাসা ছেড়ে দিছে । ভাড়া দিয়ে , চাবি দিয়ে চলে গেল ।
-চাচা লোকটা গেছে কোথায় জানেন ?
-না । তয় বলছে আবার আসবে ।
-লোকটা যদি আবার আসে আমাকে খবর দিবেন । আমি আপনাকে নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি ‌ ।

বৃদ্ধকে তাঁর বাসায় রেখে আসলাম । বৃদ্ধ ভেতরে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলো । আমি ফিরে আসলাম । আমিও জানতাম লোকটাকে পাবো না । কারণ এতদিন ঠিকানা দেয়নি । অথচ আজ ঠিকানা দিছে তাই সে বাসা ছেড়ে পালিয়েছে । কারণ সে নিশ্চয় জানতো , তাকে খোঁজ করতে কেউ না কেউ আসবে । এমনকি পুলিশও আসতে পারে । তাই সে বাসা ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে ।

আমি আবার কাটাইখানা মোড়ে আসলাম ।বাসার দিকে যাচ্ছি । বাসা থেকে আমার বর্তমান দূরত্ব বিশ মিটারের কম । আমি আর এক পা আগাতেই খুব জোড়ে বিকট একটা আওয়াজ হলো । আমি কান ধরে বসে পড়লাম । লোকজন ছুটাছুটি করছে । মানুষের আর্তনাদের সাথে হৈচৈ মিলে একটা বিশ্রী শব্দ শোনা যাচ্ছে । আমি উঠে দাঁড়ালাম । একটু এগিয়ে যেয়ে লক্ষ্য করলাম , আশেপাশে কোথাও ধোঁয়া নেই । কিন্তু আমার বাসায় হালকা আগুনের সাথে প্রচণ্ড গতিতে ধোঁয়া উঠছে । হঠাৎ জান্নাতের কথা মনে হলো । ওতো বাসায় আছে । বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো । আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম , উপরে আমার ফ্ল্যাট দিয়েই শুধু আগুন বের হচ্ছে । অন্য কোথাও আগুন নেই ।
হঠাৎ আমার মনে হলো , আচ্ছা ওই পুতুলের মধ্যে কোনো বোম রাখা ছিলো না তো ? নাকি সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়েছে ?
এসব কি তবে আমাকে খুন করার প্ল্যান

এখন চারপাশে মানুষের আহাজারি আর শোনা যাচ্ছে না । দমকলের মতো হঠাৎই সব নিশ্চুপ হয়ে গেল ।
আমার বয়স তখন চৌদ্দ । ভালো খারাপ বুঝতে শেখার বয়সের মাত্র শুরু । পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছিল । আগুনের রেশ ছিল ভয়ংকর । কিছুতেই নেভানোর ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না । আগুন শুধু যে বাড়িতে লাগে সেই বাড়ির ক্ষতি হয় এমনটা না । আগুন নাচানাচি করতে করতে যেদিকে যাবে সব পোড়াতে পোড়াতে যাবে । নিজের মাধ্যমে অন্যকে পুড়িয়েই আগুন মজা পায় ।যে বাড়িতে আগুন লেগেছিল উনার নাম আজব শেখ । সম্পর্কে আমার দাদা হোন । তবে কোনো এক কারণে উনার ছেলেকে মামা বলে ডাকি । বিষয়টি বেশ রহস্যজনক বলে মনে হলেও আমি কখনও খতিয়ে দেখিনি ।

আগুন লেগে পুড়ো বাড়ি শেষ । সাথে পাশের বাড়ির একজনের পানির টাঙ্কিও পুড়ে গেল । যার টাঙ্কি পুড়েছে সে একজন পুলিশ । দেশে আসেন বছরে দুই একবার । পানির টাঙ্কি পুড়ে যাওয়ায় তাঁর কোনো অভিযোগ না থাকলেও উনার বড় মেয়ে ঘোর অভিযোগ করে বসলো ‌ । আগুনে বাড়িঘর পুড়ে গেছে শুনে ক্যাম্প থেকে দুইজন পুলিশ আসলো । এলাকার সবাই পুলিশকে অনুরোধ করলো যাতে সরকারি খাত থেকে কিছু সাহায্য এদের দেওয়া হয় । ঠিক তখনই পুলিশের কাছে বড় অভিযোগের সুর তুললেন পানির টাঙ্কি পুড়ে যাওয়া ওই পুলিশের বড় মেয়ে ।
মেয়েটার কথা খুবই যুক্তিসংগত ।
 মেয়েটি বলল
-আমার বাবা আমাদের ছেড়ে সেই বনজঙ্গলে পড়ে থাকে । শুধুমাত্র টাকা উপার্জন করার জন্য । আমার বাবার টাকা খুবই কষ্টে উপার্জিত । বছরে দুই একবার আসে । দুইটা ঈদ আমাদের সাথে করতে পারে না । যেকোনো একটা ঈদ আমাদের সাথে কাটায় । বাকি যে ঈদটা থাকে সেটা কত কষ্টে আমরা কাটায় জানেন ? ঈদের দিনে ছেলে মেয়ে , নিজের এলাকা থেকে দূরে থাকা কত কষ্টের জানেন ?
তাই আমার বাবার কষ্ট করে উপার্জনের টাকার টাঙ্কির পুড়ে গেছে ‌সেটারও কিছু বন্দবস্ত আপানাদের করা লাগবে ।
মেয়েটার কথা শুনে পুলিশ সহ সবাই বিমোহিত । পুলিশ আজব শেখকে বললেন
-উনাদেরকে দুই হাজার টাকা দিবেন । আর আপনার ব্যপারে উপরে দরখাস্ত করছি । কিছুদিন সময় লাগবে ।
আজব শেখকে দেখে আমার প্রচণ্ড মায়া হলো । ছলছল চোখ , করুণ চাহনি । আগুনের কারণে নিজের তো সব গেছেই এখন আবার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে । কারণ তাদের অসাবধানতার কারণেই আগুন লেগেছে । এবং পাশের বাড়ি ক্ষতি হয়েছে । যুক্তিসংগত ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিৎ ।
আগুনকে মানুষ বিপদ বলে । আমি বলি আগুন বিপদ নয় । তবে আগুনকে অসাবধানে ব্যবহার করলেই কেবল আগুন বিপদ হয়ে উঠে । তাছাড়া দেখুন , আগুন না থাকলে রান্না হতো ? খেতেন কি ? আদিম মানুষের মতো কাঁচা বস্তু ?

আমি বাসার খুব নিকটে গিয়ে দাঁড়ালাম । আগুন ততক্ষণে নেই । মারাত্মক ক্ষতি গুলো হঠাৎই হয় । আমার চোখ জান্নাতকে খুঁজছে । আগুন না থাকলেও হালকা ধোঁয়া ছুটাছুটি করছে । কিছুক্ষণ পরে বাম দিকে তাকিয়ে জান্নাত সহ পাশের ফ্ল্যাটের সবাইকে সুস্থ অবস্থায় দেখলাম । জান্নাত একবার আমার দিকে তাকালো । আমি আস্তে আস্তে আমার বাসায় যাওয়ার জন্য একের পর এক সিঁড়ি ধরে উপরে উঠছি । আমার পিঁছে পিঁছে সবাই আসছে । এতক্ষণ কেউ সাহস করে উঠতে পারছিল না । আমাকে দেখে হয়তো কিছু সাহস পেল । আমি রুমে ঢুকে সেই পুতলটা খুঁজতে লাগলাম । আসলেই কি ওর মধ্যে বোম ছিল কি না । কিন্তু কোথাও পুতুলটা নেই । ঘরের মধ্যে জিনিস পত্র সব আধোপোড়া হয়ে আছে । বেশিরভাগই ক্ষতি হয়েছে রান্না ঘর আর বেডরুমে । পুতুলটা কোথাও খুঁজে পেলাম না । আমাকে এমন অস্থির হয়ে কিছু খোঁজা দেখে জান্নাত বলল
-কি হয়েছে ? কিছু খুঁজছো ?
-হ্যাঁ তোর প্রেমিকের দেওয়া উপহারটা খুঁজছি ।
-ওটা আমি ফেলে দিছি ।
কথাটা শুনে আমার প্রচণ্ড রাগ হলো । এবার আমি সিউর হলাম পুতুলের মধ্যে বোম ছিল । আর এটা পরোক্ষ ভাবে আমাকে খুন করার প্ল্যান । এখন পুতলটা ফেঁটে এই আগুনের সৃষ্টি হয়েছে তাই জান্নাত বলছে পুতলটা ফেলে দিয়েছে । ও কোনো মতে ধরা দিতে চাইছে না । নিজেকে খুব চালাক মনে করছে ।
-তুই পুতুল ফেলে দিয়েছিস নাকি পুতুলের মধ্যে বোম দিয়ে আমাকে খুন করতে চেয়েছিলি পারলি না তাই লুকাচ্ছিস । আমি তোর সব চালাকি ধরে ফেলছি ।
-পুতুলে বোম ! মানে ?
-চুপ একদম কথা বলবি না । আরে তোর আমার সাথে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না এটা বললেই পারতি । যা তোকে মুক্ত করে দিলাম । তোর যেই কয়টা ইচ্ছা বিয়ে কর আমি কোনো বাঁধা দিব না ।
আমি ভাবছিলাম জান্নাত আমার হাতে পায়ে ধরবে ।খুব কান্না করবে । কিন্তু আমার ধারণা ভুল করে দিয়ে জান্নাত ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো । আমি কিঞ্চিত অবাক হয়নি । ও এটাই চাচ্ছিল । ওর আশা পূরণ হচ্ছে । এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই । জান্নাত ওর সব কাপড় আর যাবতীয় জিনিস ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছে । মানুষ কোনো জায়াগায় যাওয়ার জন্য তখনই সব কাপড় গুছিয়ে নেয়, যখন সে আর সেখানে কোনোদিন ফিরবে না বা অনেকদিন পর ফিরবে । জান্নাতও সব কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে । ওর আর এখানে ফেরার কোনো প্রয়োজন নেই । জান্নাত সব কাপড় গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল । যাওয়ার আগে কিছুই বলল না । ওর কাছে টাকা আছে কি না জানিনা । আমার ইচ্ছা হচ্ছিল ওর হাতে কয়েকশো টাকা গুজে দিতে । রাস্তায় যাতে কোনো সমস্যা না হয় ।

জান্নাত চলে যাওয়ার পর থেকে আমি অফিসে অনিয়মিত হলাম । একবার নোটিশ এলো । আমি উপস্থিত হলাম না । চাকরিটা হারালাম । মনের মধ্যে কোনো আফসোস নেই । ফোনের চার্জ শেষ হয়েছে কবেই । চার্জ দিতে ইচ্ছা করে না । কয়েকদিন পর পর গোসল করা হয় । খাওয়া দাওয়া কখন করি কোনো সময় অসময় নেই । এক জামা পড়ে চার পাঁচ দিন থাকি । জান্নাত কত দিন হলো গেছে সেটাও হিসাব করা হয়নি । মুখে দাড়ি কামানোর দরকার । চুল ছাটা দরকার ‌। কোনোটাই করা হচ্ছে না । ঘরবাড়ি আগুনে নষ্ট হয়ে গেছে । বাড়িওয়ালা বলল
-আপনি দুইদিন কোথাও বেড়িয়ে আসেন । এর মধ্যে আমি ঘর সারিয়ে ফেলবো ।
আমি বললাম
-আপনি ঘর সারান । আমি এখানেই থাকবো । আমার কোনো অসুবিধা হবে না ।

দেওয়ালে নতুন রঙ চকচক করছে । জান্নাত এটা দেখলে খুবই আনন্দিত হতো । হালকা শীত পড়ছে । বাড়িটাকে শশ্মান বানিয়ে রেখেছি । মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো । একমাস যাবত কথা হয় না । ফোনটা চার্জে লাগালাম । বিকেল হয়েছে । একটু ছাদে যেতে মন চাচ্ছে । ছাদে উঠে দেখি একটা অষ্টাদশী মেয়ে অন্যদিকে মুখ করে কি যেন করছে । আগে কখনও দেখিনি । তিনতলা বাড়ি ।হয়তো কোনো ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে ।
মেয়েটার কাছাকাছি গেলাম । মেয়েটার হাতে একটা রেপিং কাগজে মোড়ানো বক্স । তাড়াহুড়ো করে খুলছে ।
-এই মেয়ে কি করো এখানে ?
মেয়েটা চমকে উঠলো । বলল
-কিছু না ।
-তোমার হাতে কি ?
কিছু না বলে বক্সটা খুলতে শুরু করলো ।
-বক্সে কি আছে ?
-জানিনা । খুললে দেখতে পাবো ।
-প্রেমিক পাঠিয়েছে নিশ্চয় ?
-অনেক দিন পর ওর কাছ থেকে একটা কিছু হাতে পেলাম । অনেক দিন ধরে ঘরে বদ্ধ আছি । বাবা মা সব জেনে যাওয়ার পর আমাকে আর বাইরে বের হতে দেই না ।

অষ্টাদশী মেয়েরা কথা বেশি বলে । কেউ কিছু জানতে না চাইলেও তাদেরকে সব বলে দেয় । এরা মনে করে সব কিছু প্রকাশ করার মাঝেই আনন্দ । অষ্টাদশী মেয়েদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে এরা ভালোবাসা আর ভালো লাগাকে গুলিয়ে ফেলে । এটা আসলে ভালোবাসা না ভালো লাগা তারা সঠিক ধরতে পারে না ।বক্সের মধ্যে একটা সাদা কাগজ । কাগজে কিছুই লেখা নেই । তবুও দেখলাম মেয়েটা চুপচাপ কি যেন পড়ছে । শুধু শুধু পড়ছে না ! একটা কলমের মাথার টর্চ দিয়ে পড়ছে ।
-কাগজে তো কিছুই লেখা নেই । তুমি কি পড়ছো ?
-লেখা আছে , এই কলমে লেখলে এর মাথার টর্চ জ্বালিয়ে ছাড়া পড়া যায় না ।
আমি বক্সটা হাতে নিলাম । এবং খুব অবাক হলাম । প্রেরেরকের জায়গায় সাদা এবং প্রাপকের জায়গায় জান্নাত লেখা ।
-তোমার নাম কি জান্নাত ?
-হুম ।
আমি এবার খুব অবাক হলাম । সবটা জানার জন্য বললাম
-প্রেরকের জায়গায় একটু আলো ধরোতো ।
নামটা দেখে আমার সব ভুল ভেঙে গেল । তবে কিছু তথ্য এখনও জানা বাকি ।
-এই রকম পার্সেল আমার বাসায় বিশটার বেশি আসছে। আমার বউয়ের নাম জান্নাত ‌ । আমি ওকে সন্দেহ করতাম । কিন্তু একটা কথা বলোতো , বক্সের মধ্যে কোনো কিছু থাকতো না কেন ?
মেয়েটা হেসে বলল
-অবশ্যই থাকতো। বক্সের মধ্যে হাজারো লেখা থাকতো যা খালি চোখে দেখা যায় না । মনে করেন পার্সেল আসলো । মা রিসিভ করে দেখলো খালি প্যাকেট কিছুই নেই । তখন সেটা ঘরের কোনো এক কোণায় ফেলে রাখবে । আর পরে আমি সেটা চুপিচুপি পড়বো । এই জন্য এই আইডিয়া । কিন্তু অনেক দিন পর পার্সেল আসলো । এর আগেই আসবে ভেবেছিলাম ।
-আচ্ছা তুমি কি ওই ছেলের কাছ থেকে কোনো টাকা নিয়েছো ?
-হ্যাঁ নিয়েছিলাম ।
-কেন নিয়েছিলে ?
-সেটা অনেক লম্বা কাহিনী ।
-তোমাকে বাসা থেকে বের হতে দেয় না , আজ পার্সেল রিসিভ করতে দিল ?
-মা ঘুমাচ্ছে । বাবা বাসায় নেই তাই আমি দরজা খুলেছি । কপাল ভালো যে ঠিক আমার হাতেই পার্সেল পড়লো । নয়তো আরও বকা খেতাম । আচ্ছা আপনি না বললেন আপনার বাসায় পার্সেল আসছে , আমাকে পার্সেল গুলো দিবেন ? যদি আমার না হয় তবে আমি ফেরত দেব ।
যা ধরেছিলাম তাই হলো । পার্সেলের গায়ে লাইট মেরে ঠিক একই নাম পেলাম । পার্সেল ছিল অনেক গুলো । সব আগুনে পুড়ে গেছে । এটাও আধা পোড়া ।
-আচ্ছা তোমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিচ্ছে না কেন ?
-সামনে মাসে আমার বিয়ে । বাবা চান না আমি ওই ছেলের সাথে আর যোগাযোগ রাখি । কিন্তু তাঁর কথা অমান্য করছি তাই এখন ঘর বন্ধি আছি ।
-তুমি চাইলে আমি তোমাকে ওই ছেলের কাছে যেতে সাহায্য করবো ।
-আপনার সাথে পড়ে কথা বলবো । এমনিতেই অনেক দেড়ি হয়ে গেছে । মা জানলে কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে দিবে ।
মেয়েটা দৌড়ে চলে গেল । আমি ফোনটা হাতে নিলাম । অনেক গুলো ম্যাসেজের মধ্যে একটা ম্যাসেজ আমার নজর কাড়লো ।
-সত্যি বলছি , আমার পেটের সন্তান শুধুই আমাদের দুজনের ।
সন্ধ্যা নেমে গেছে । মানুষ নিজ নীড়ে ফিরছে । সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার অবসান ঘটলে বাড়ির পথ সবাই বেছে নেয় । ল্যাম্পোষ্টের নিয়ন আলো জ্বলতে শুরু করেছে । জান্নাতের ম্যাসেজটা দেখেই আমি ওর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছি । মেয়েদেরকে চাঁদের সাথে তুলনা করা হয় । আমি জান্নাতকে চাঁদ উপাধি দিলাম । ওর মনে প্রচণ্ড আঘাত দেওয়া হয়েছে । প্রিয়জনের দেওয়া কষ্টের চেয়ে পৃথিবীতে আর কিছু নেই । তার মানে আমি চাঁদকে আঘাত দিয়েছি । তাই সংক্ষেপে চন্দ্রাঘাত বলা যায় ।
ও হয়তো এখন ছাদে বসে আছে । চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । আকাশের দিকে বারবার তাকাচ্ছে । আমার কথা মনে হচ্ছে । নিজের পেটে এক নবজাতকের কথা মনে পড়ছে । বালিশে মুখ চেপে কান্না করা জান্নাতের স্বভাব । আচ্ছা , জান্নাত কান্না করার জন্য ছাদেও কি বালিশ নেবে ?
(সমাপ্ত)


writer :- Md Jobayer Ahmmed

Popular posts from this blog

₪ সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম [post no:-22]

হ্যাপি কাপল

₪ ছেলেটি মেয়েটাকে অনেক ভালোবসতো [post no:-18]

বড় বোন থাকার ১৫টি মজার দিক

₪ বুদ্ধিমান মানুষ চেনার উপায় [post no:-16]

মাইকেল জ্যাকসন 150 বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

অবহেলা

₪ ছোট বোনের থেকে টাকা ধার [post no:-27]

ডিপ্রেশন

এক চালাক ব্যক্তি [ post no: 11 ]