নাড়ির টান
"তোর মতো বয়সে থাকতে আমি চার সন্তানের মা ছিলাম, আর বুড়ি হয়ে যাইতাছস এখনও বিয়া করতে ইচ্ছা করেনা। কয়দিন পরে বুইড়া ব্যাটা সাথে ছয় পোলার বাপ সে ও আসবোনা তোরে বিয়া করতে"! উপরের কথা গুলো আমার নানু মালেকা খাতুনের। উনার নাম মালেকা খাতুন কিন্তু উনাকে সবাই মালেকা সুন্দরী বলেই চিনেন। তার বয়স যখন ১০ বছর তখন তিনি আমার নানার বউ হয়ে আসেন। বলে রাখা ভালো সেকালে তার মতো সুন্দরী নাকি খুব কম ই ছিল গ্রামে। সেই ক্ষেত্রে আমি বলবো নানার আমার বিরাট ভাগ্য এমন রগচটা সুন্দরী কে বউ হিসেবে পেয়েছিলেন। কারণ কোন এক কবি বলেছিলেন নারী তেজি না হলে নারীত্ব ভাবটা নাকি লোপ পায়। নানা ভাই মারা গেছেন যখন আমার চার মাস বয়স তখন, আর এখন আমার বাইশ চলে। অতঃএব বলাই যায় দীর্ঘ ২২ বছর স্বামী ছাড়া থেকে এখন কাউকে স্বামী ছাড়া দেখলে তার সহ্য হয়না। অন্য কারোর টা বলতে পারিনা আমায় দেখলে তার সহ্য হয়না হাতের কাছে যা পান তা নিয়েই তেড়ে এসে আমার মা কে ডেকে বলে শাহ্জাদী তোর মাইয়া রে কিছু বল, ঢিঙ্গি মাইয়া বিয়া দেস না আমার বাড়ি আইয়া খালি আমার লগে লাগে। হুম নানু কথাটা মিথ্যা বলেনি তাকে দু'য়েক কথায় না ক্ষেপিয়ে দিলে অন্তত সেদিন আমি ভাত খেতে পারিনা। না ক্ষেপিয়ে উপায় নেই বাবা বুড়ি এইটা সারাদিন ই কানের কাছে বিয়া বিয়া করে। যেমন আজকে সকালে খেতে বসে ফোন টিপছিলাম আর খাচ্ছিলাম অমনি শুরু তার লেকচার! জামাই বাড়ি গেলে দৌঁড়ায়া কূল পাবিনা লো ছেড়ি বাদ দে এইসব অভ্যাস মাডি দে, নাইলে জামাই থাবড়ায়া বাপের বাড়ি থুইয়া যাইবো!
ইসস অমনি আমার কান দুইটা রাগে লাল হয়ে গিয়েছিলো । তাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে উত্তর দিয়েছি
এইই তোমার এতো জামাই জামাই করতে মজা লাগে ক্যান? আরেকটা বিয়া দিয়া তোমারে জামাই বাড়ি রাইখা আসমু বজ্জাত মহিলা। এরপরের কাহিনী আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না লাঠি একটা নিয়া বলে খারাইছ রে মা**! বাবাগো ঐ যে খাওয়া রেখে পালিয়ে ছিলাম দুপুরের আগে ঘর মুখো হইনি।
অনেক দিন পর গ্রামে এলাম মামা খাশি যবাই করেছে মামি বিকাল বেলা চালের গুড়ো দিয়ে রুটি বানাতে বসেছে। সবাই গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর যে যতটুকু পারি মামি কে সাহায্য করছিলাম। আমি আগে কখনও রুটি বানাইনি মামির থেকে নিয়ে চেষ্টা করছিলাম। এ বাবা রুটি তো না যেন নোয়াখালির মানচিত্র! একেকজন তো হেসেই বেহুঁশ। তখন কোত্থেকে নানু এসে চেয়ার টেনে বসে বলে
-হুহহ জামাই বাড়ির ভাত খাওয়া এত্ত সহজ না। এহন যে একটা বানাইয়া ফালাইলা আর চিল্লায়া হাসলা এইসব চলবোনা।
আমি হেসে উত্তর দিলাম;
-কেনো গো সে বাড়ির খাবারে কি ইটা বালু খোয়া থাকবে যে পেটে সইবেনা?
নানু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো
-এইসব কাম করলে খালি কিল পরবো পিঠে, কিল একটাও নিচে পরবো না।
আমি যায়গা ছেড়ে উঠে পালানোর সময় বললাম
-ও সাত্তার সিকদার তোমারে শুধু কিলাইতো তাইনা? তাই এখন বিয়ে বিয়ে করো যাতে ভালো দেখে একটা বিয়ে দেই? স্মৃতি ভুলার সখ হয়েছে নানু? আচ্ছা পরেরবার আসার সময় একটা টগবগে যুবক নিয়ে আসবো নি।
আমার এই বক্তব্যর পর নানুর ছুড়ে মারা ঝাড়ু আমার গায়ে না লাগলেও মামাকে রেহায় দেয়নি। মামার জন্য কষ্ট লাগলেও নানুকে রাগাতে পেরে আমি বেশ সন্তুষ্ট ছিলাম। কি করতাম আর? আরে বাবা পড়ালেখা টা শেষ করে নেইনা তোমার মেয়ের টা খাওয়ার জন্যে তো আর বসে থাকবো না? কিন্তু কে বোঝায় তাকে এ কথা? সে মানতে নারাজ কারণ আমি ২০ এর ঘর পেড়িয়ে গেছি।
দুইদিন পরের ঘটনা
সন্ধ্যা বেলা সূর্যাস্তের সময় পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত আমি আর আমার মামাতো বোনটা। তখনই কোত্থেকে এসে আমার নানু সুন্দরী হাজির। কিছু না বলেই পিছন থেকে এসে আমার গালে চিমটি দিয়ে ধরে শুরু তার চিল্লানি;
কি লো ঐ সন্ধ্যা হইছে চোক্ষে লাগেনা? হুমানে ব্যাডা মানুষ যাইতাছে রাস্তা দিয়া এইহানে খাড়াইয়া শুটিং করতাছো? নামাজ কালাম নাই?
ইসস বুইড়া ব্যাডি গাল ডা ছিইড়া ফালাইছে উনাকে বকতে বকতে ঘরে এসে
যে দরজা লাগিয়ে ছিলাম খুলেছি দু'ঘন্টা পর তাও সবার জোরাজুরিতে। ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছিলাম ঢাকা ফিরে আসবো, মা, মামি বুঝালেন যে উনার বয়স হয়েছে আর আগের কালের মানুষ বিয়ে নিয়ে কথা শুনাবেই। আমি যেন আর তার কথার উল্টো উত্তর না দেই আর পিছনে না লাগি। পরদিন সারাবেলা নানু হাজারটা গা জ্বলা কথা বলার পরেও যখন ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম তখন নানু তেলের বোতল এনে আমার চুলে তেল দিতে বসে শুরু করলেন এক নতুন গল্প।
শোন নানু ভাই, আমার যখন ১০ বছর বয়স তখন আমি তোর নানার বউ হয়ে এ বাড়িতে আসি। ঠিক মতো হাফপ্যান্ট টাও পরতে চাইতাম না, আমার শাশুড়ি আমায় গোসল করিয়ে কাপড় পরিয়ে দিতেন। ১৪ বছর বয়সে আমার প্রথম ছেলেটা হয়। তখন প্রথম সংসার কি জিনিস বুঝতে শুরু করি, বাপের বাড়ি যাওয়ার ঝোঁক টা ধীরে ধীরে কমে। ৭৫ সনে যখন তোর মা হয় তখন আমি ৫ সন্তানের মা। ততদিনে শাশুড়ি ও মারা গেছেন, এতো বড় সংসারের সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে বর্তায়। মেলা বড় গেরস্ত বাড়ি ৫ টা ৬ টা কামলা সারাবছর থাকতো তাগো সবার রান্না-বারা,
পোলাপাইনের দেখ-ভাল, গেরস্তি করা, মোটকথা সংসারের যাতাকলে পইরা আমি বাস্তবতা চিনা শুরু করি। নিজের সখ আহ্লাদ সব মাডি দেই। ততদিনে নিজের ভায়েরা ও বিয়া করছে সংসার হইছে নাইওর নিতে আইসা বইসা থাকার সময় হয়না তাদের । দেখতে দেখতে কেমনে যে ৪৪ টা বছর বাপের বাড়ির মুখ দেখি না বলতে পারিনা। জানস নানুভাই সব গুলা ভাই বইনের নাম ও মনে নাই এহন আমার।
আল্লাহ জানে কেমন দেখতে হইছে ভাই গুলা আমার! ওরাও মনে হয় আমার মত বুইড়া হইয়া গেছে। সালাম আমার ছোড ভাইডা বুড়া হইলে ওরে কেমন দেখায় দেখতে খুব মন চায়! নানু কথা গুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন। তার সামনে নিজেকে শক্ত রাখার শক্তি ছিলো না আমার, তাই তাকে রেখে উঠে চলে যাই।
পরদিন সকালে উঠেই ব্যাগ গোছানো শুরু করেছি নানু আমাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে মা কে ডেকে বলে
-কি রে শাহ্জাদী তোর মাইয়া ব্যাগ গোছায় ক্যান?
মা উত্তর দেয়
- আমরা আজই ঢাকা যাবো মা আর তুমি ও যাবা আমাদের সাথে।
নানু রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে উত্তর দেন দুইবছরে পরশু দিন আইলি এহনই যাবি গা এইডি কি তামাশা? তারপর মা,মামা,মামি সবাই নানুকে মানাতে সক্ষম হন এবং নানু আমাদের সাথে গাড়িতে উঠে। গাড়ি এলাকা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠতেই নানু ঘুমিয়ে পরেন। চলে এসে গাড়ি থেকে নেমে আমি নানুকে ডাক দেই। নানু ঘুম ভাঙ্গা কন্ঠে উত্তর দেন
- আইসা পরছি ঢাকা?
আমার ছোট ভাইটা তার হাত টেনে বলে
হ্যাঁ নানু চলে আসছি তাত্তাড়ি বের হও।
নানু গাড়ি থেকে নেমে চোখবুজে যেন কিসের ঘ্রাণ নেন। চোখ খুলে বিচলিত গলায় মাকে জিজ্ঞেস করেন কিরে এই বাতাস টা আমার এতো চিনা ক্যান? মাটির ঘ্রাণ ডায় বুকের ধুকপুকানি বাইড়া যায়! আমি কি এর আগে কখনো ঢাকা আইছিলাম?
মা উত্তর দেয়না
নানু মায়ের দিকে চেয়ে উত্তেজিত হয়ে বলেন কিরে বলস না ক্যান? মায়ের পিছনে চেয়ে চোখের চশমা টা খুলে মুছে আবার চোখে দিয়ে কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর হু হু করে কেঁদে বলে উঠেন
সালা..ম ভাইইইইইই আমার!
নানাভাই নানুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দেন। নানু অবিরাম তার চোখে মুখে চুমোতে থাকেন, নানা ভাই কেঁদে কেঁদে নানু কে জিজ্ঞেস করেন
বুবাই এই গাঙ ডার কথা মনে আছে তোমার? এইহানে আমরা কত্ত ভেলা চড়াইতে আসতাম পানিতে ডুবাইতাম? ৪৪ বছরে সব ভুইল্লা গেলা তুমি কেমনে?
নানু বাহুডোরে ভাইকে আরে শক্ত করে জাপটে ধরে উত্তর দেন কিচ্ছু ভুলি নাই রে দেখ দেখ আমার কপালের দাগ ডা? তোরে পানির থে বাঁচাইতে গিয়া যে গাছের গুড়ি ঢুইকা গেছিলো? দেখছস?
এতো পবিত্র ভালোবাসা দেখে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ১০ বছর বয়সি ছোট ভাইটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে! আমি সৌভিক বলে ডাক দিতেই আমায় জড়িয়ে ধরে বলে
-আপাই তুই আমাকে ভুলে যাবিনা তো? তুই যে আমার জন্য মায়ের কাছে মার খাস ৪৪ বছরে ভুলে যাবিনা তো বল?
আমি ওর কথার কোনো উত্তর দিতে পারছিনা ভেতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে কেঁদে বলছে
নারে ভাই এটা যে ভোলা যায়না! এ সম্পর্ক যে নিঃশ্বাসে! প্রতি রক্তের কণায় কণায় কি করে ভুলবো বল??
লেখাঃ তাইয়্যেবা ইসলাম
ইসস অমনি আমার কান দুইটা রাগে লাল হয়ে গিয়েছিলো । তাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে উত্তর দিয়েছি
এইই তোমার এতো জামাই জামাই করতে মজা লাগে ক্যান? আরেকটা বিয়া দিয়া তোমারে জামাই বাড়ি রাইখা আসমু বজ্জাত মহিলা। এরপরের কাহিনী আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না লাঠি একটা নিয়া বলে খারাইছ রে মা**! বাবাগো ঐ যে খাওয়া রেখে পালিয়ে ছিলাম দুপুরের আগে ঘর মুখো হইনি।
অনেক দিন পর গ্রামে এলাম মামা খাশি যবাই করেছে মামি বিকাল বেলা চালের গুড়ো দিয়ে রুটি বানাতে বসেছে। সবাই গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর যে যতটুকু পারি মামি কে সাহায্য করছিলাম। আমি আগে কখনও রুটি বানাইনি মামির থেকে নিয়ে চেষ্টা করছিলাম। এ বাবা রুটি তো না যেন নোয়াখালির মানচিত্র! একেকজন তো হেসেই বেহুঁশ। তখন কোত্থেকে নানু এসে চেয়ার টেনে বসে বলে
-হুহহ জামাই বাড়ির ভাত খাওয়া এত্ত সহজ না। এহন যে একটা বানাইয়া ফালাইলা আর চিল্লায়া হাসলা এইসব চলবোনা।
আমি হেসে উত্তর দিলাম;
-কেনো গো সে বাড়ির খাবারে কি ইটা বালু খোয়া থাকবে যে পেটে সইবেনা?
নানু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো
-এইসব কাম করলে খালি কিল পরবো পিঠে, কিল একটাও নিচে পরবো না।
আমি যায়গা ছেড়ে উঠে পালানোর সময় বললাম
-ও সাত্তার সিকদার তোমারে শুধু কিলাইতো তাইনা? তাই এখন বিয়ে বিয়ে করো যাতে ভালো দেখে একটা বিয়ে দেই? স্মৃতি ভুলার সখ হয়েছে নানু? আচ্ছা পরেরবার আসার সময় একটা টগবগে যুবক নিয়ে আসবো নি।
আমার এই বক্তব্যর পর নানুর ছুড়ে মারা ঝাড়ু আমার গায়ে না লাগলেও মামাকে রেহায় দেয়নি। মামার জন্য কষ্ট লাগলেও নানুকে রাগাতে পেরে আমি বেশ সন্তুষ্ট ছিলাম। কি করতাম আর? আরে বাবা পড়ালেখা টা শেষ করে নেইনা তোমার মেয়ের টা খাওয়ার জন্যে তো আর বসে থাকবো না? কিন্তু কে বোঝায় তাকে এ কথা? সে মানতে নারাজ কারণ আমি ২০ এর ঘর পেড়িয়ে গেছি।
দুইদিন পরের ঘটনা
সন্ধ্যা বেলা সূর্যাস্তের সময় পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত আমি আর আমার মামাতো বোনটা। তখনই কোত্থেকে এসে আমার নানু সুন্দরী হাজির। কিছু না বলেই পিছন থেকে এসে আমার গালে চিমটি দিয়ে ধরে শুরু তার চিল্লানি;
কি লো ঐ সন্ধ্যা হইছে চোক্ষে লাগেনা? হুমানে ব্যাডা মানুষ যাইতাছে রাস্তা দিয়া এইহানে খাড়াইয়া শুটিং করতাছো? নামাজ কালাম নাই?
ইসস বুইড়া ব্যাডি গাল ডা ছিইড়া ফালাইছে উনাকে বকতে বকতে ঘরে এসে
যে দরজা লাগিয়ে ছিলাম খুলেছি দু'ঘন্টা পর তাও সবার জোরাজুরিতে। ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছিলাম ঢাকা ফিরে আসবো, মা, মামি বুঝালেন যে উনার বয়স হয়েছে আর আগের কালের মানুষ বিয়ে নিয়ে কথা শুনাবেই। আমি যেন আর তার কথার উল্টো উত্তর না দেই আর পিছনে না লাগি। পরদিন সারাবেলা নানু হাজারটা গা জ্বলা কথা বলার পরেও যখন ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম তখন নানু তেলের বোতল এনে আমার চুলে তেল দিতে বসে শুরু করলেন এক নতুন গল্প।
শোন নানু ভাই, আমার যখন ১০ বছর বয়স তখন আমি তোর নানার বউ হয়ে এ বাড়িতে আসি। ঠিক মতো হাফপ্যান্ট টাও পরতে চাইতাম না, আমার শাশুড়ি আমায় গোসল করিয়ে কাপড় পরিয়ে দিতেন। ১৪ বছর বয়সে আমার প্রথম ছেলেটা হয়। তখন প্রথম সংসার কি জিনিস বুঝতে শুরু করি, বাপের বাড়ি যাওয়ার ঝোঁক টা ধীরে ধীরে কমে। ৭৫ সনে যখন তোর মা হয় তখন আমি ৫ সন্তানের মা। ততদিনে শাশুড়ি ও মারা গেছেন, এতো বড় সংসারের সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে বর্তায়। মেলা বড় গেরস্ত বাড়ি ৫ টা ৬ টা কামলা সারাবছর থাকতো তাগো সবার রান্না-বারা,
পোলাপাইনের দেখ-ভাল, গেরস্তি করা, মোটকথা সংসারের যাতাকলে পইরা আমি বাস্তবতা চিনা শুরু করি। নিজের সখ আহ্লাদ সব মাডি দেই। ততদিনে নিজের ভায়েরা ও বিয়া করছে সংসার হইছে নাইওর নিতে আইসা বইসা থাকার সময় হয়না তাদের । দেখতে দেখতে কেমনে যে ৪৪ টা বছর বাপের বাড়ির মুখ দেখি না বলতে পারিনা। জানস নানুভাই সব গুলা ভাই বইনের নাম ও মনে নাই এহন আমার।
আল্লাহ জানে কেমন দেখতে হইছে ভাই গুলা আমার! ওরাও মনে হয় আমার মত বুইড়া হইয়া গেছে। সালাম আমার ছোড ভাইডা বুড়া হইলে ওরে কেমন দেখায় দেখতে খুব মন চায়! নানু কথা গুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন। তার সামনে নিজেকে শক্ত রাখার শক্তি ছিলো না আমার, তাই তাকে রেখে উঠে চলে যাই।
পরদিন সকালে উঠেই ব্যাগ গোছানো শুরু করেছি নানু আমাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে মা কে ডেকে বলে
-কি রে শাহ্জাদী তোর মাইয়া ব্যাগ গোছায় ক্যান?
মা উত্তর দেয়
- আমরা আজই ঢাকা যাবো মা আর তুমি ও যাবা আমাদের সাথে।
নানু রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে উত্তর দেন দুইবছরে পরশু দিন আইলি এহনই যাবি গা এইডি কি তামাশা? তারপর মা,মামা,মামি সবাই নানুকে মানাতে সক্ষম হন এবং নানু আমাদের সাথে গাড়িতে উঠে। গাড়ি এলাকা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠতেই নানু ঘুমিয়ে পরেন। চলে এসে গাড়ি থেকে নেমে আমি নানুকে ডাক দেই। নানু ঘুম ভাঙ্গা কন্ঠে উত্তর দেন
- আইসা পরছি ঢাকা?
আমার ছোট ভাইটা তার হাত টেনে বলে
হ্যাঁ নানু চলে আসছি তাত্তাড়ি বের হও।
নানু গাড়ি থেকে নেমে চোখবুজে যেন কিসের ঘ্রাণ নেন। চোখ খুলে বিচলিত গলায় মাকে জিজ্ঞেস করেন কিরে এই বাতাস টা আমার এতো চিনা ক্যান? মাটির ঘ্রাণ ডায় বুকের ধুকপুকানি বাইড়া যায়! আমি কি এর আগে কখনো ঢাকা আইছিলাম?
মা উত্তর দেয়না
নানু মায়ের দিকে চেয়ে উত্তেজিত হয়ে বলেন কিরে বলস না ক্যান? মায়ের পিছনে চেয়ে চোখের চশমা টা খুলে মুছে আবার চোখে দিয়ে কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর হু হু করে কেঁদে বলে উঠেন
সালা..ম ভাইইইইইই আমার!
নানাভাই নানুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দেন। নানু অবিরাম তার চোখে মুখে চুমোতে থাকেন, নানা ভাই কেঁদে কেঁদে নানু কে জিজ্ঞেস করেন
বুবাই এই গাঙ ডার কথা মনে আছে তোমার? এইহানে আমরা কত্ত ভেলা চড়াইতে আসতাম পানিতে ডুবাইতাম? ৪৪ বছরে সব ভুইল্লা গেলা তুমি কেমনে?
নানু বাহুডোরে ভাইকে আরে শক্ত করে জাপটে ধরে উত্তর দেন কিচ্ছু ভুলি নাই রে দেখ দেখ আমার কপালের দাগ ডা? তোরে পানির থে বাঁচাইতে গিয়া যে গাছের গুড়ি ঢুইকা গেছিলো? দেখছস?
এতো পবিত্র ভালোবাসা দেখে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ১০ বছর বয়সি ছোট ভাইটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে! আমি সৌভিক বলে ডাক দিতেই আমায় জড়িয়ে ধরে বলে
-আপাই তুই আমাকে ভুলে যাবিনা তো? তুই যে আমার জন্য মায়ের কাছে মার খাস ৪৪ বছরে ভুলে যাবিনা তো বল?
আমি ওর কথার কোনো উত্তর দিতে পারছিনা ভেতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে কেঁদে বলছে
নারে ভাই এটা যে ভোলা যায়না! এ সম্পর্ক যে নিঃশ্বাসে! প্রতি রক্তের কণায় কণায় কি করে ভুলবো বল??
লেখাঃ তাইয়্যেবা ইসলাম
₪ [ post no: 51 ]