ভ্রম
ফারুক সাহেব এরশাদনগর বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটা ছোট্ট দোকানের মালিক। খুব দামি দোকান না, একটা স্টেশনারী দোকান। কম্পিউটার আছে একটা, ফটোকপি করা হয়। দোকানের সামনের দিকে একটা সেগুনকাঠের টেবিল পাতা আছে। আর আছে দুটো চেয়ার। পাশাপাশি রাখা। একটায় ফারুক সাহেব নিজে বসেন,অন্যটা তার দোকানের সহকারীর জন্য। সহকারী বলা ঠিক হবে না, একটা ২৪/
২৫ বছর বয়সী ছেলে শুরু থেকেই এই দোকানে কাজ করে,নাম মিরাজ।দোকানের নাম আল-মদিনা স্টেশনারী। টেবিল চেয়ার গুলোর পেছনে তাকে সাজানো রয়েছে হাজার হাজার বই-পত্র। আর আছে খাতা-কলম,পেন্সিল-রবার, কাটার এইসব। আর দোকানের এক কোনায় একটা টেবিলের ওপর একটা পুরানো মডেলের কম্পিউটার।
মিরাজকে অত্যন্ত স্নেহ করেন ফারুক সাহেব। বিয়ে করেননি তিনি।মিরাজও তাই ঠিক করেছে,বিয়ে করবে না।ফারুক সাহেবের বয়স চুয়াল্লিশ হলো। মিরাজ ছেলেটা অল্পবয়সী।তার বিয়ে না করার কারণ হলো তার ওস্তাদ বিয়ে করেননি। অস্তাদ হলেন ফারুক সাহেব। অবশ্য ওস্তাদ মত বদলালে অন্য কথা।
ফারুক সাহেবের প্রতিদিন সকালের রুটিন ঠিক করা।সেটা এমন যে, সাড়ে সাতটার সময় দোকানে এসে নিজের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়বেন। প্রতিদিন সকালে ছয়টার একটু পরেই খবরের কাগজের লোক দোকানের সামনে রেখে যায়।তারপর কাগজ পড়তে পড়তেই মিরাজ এসে পড়বে।আটটার দিকে।সে এসে পাশের 'মজনু টী-স্টোর' থেকে চা এনে দেবে।চিনি কম,দুধ বেশি। তারপর দুজনে মিলে নাস্তা শেষ করে কাজ শুরু করবে।
আজ সকালেও প্রতিদিনের মতো সাড়ে সাতটার সময় দোকানে ধুকে নিজের চেয়ারে বসলেন ফারুক সাহেব।বাইরের দিকে তাকালেন।আকাশে বেশ মেঘ করেছে।আশ্চর্য তো!বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখেছেন তিনি। পৌষ মাসের তেরো তারিখ।পৌষ মাসের তেরো তারিখ বৃষ্টি! যা হয় হোকগে তো। ফারুক সাহেব পত্রিকা পড়তে পড়তে ঘড়ি দেখলেন।৮ঃ২০বাজে!আরে! একটু আগেও তো ৭ঃ৩০ বাজছিল। তিনি একবার শুধু বাইরে তাকালেন আর এর মধ্যেই ৫০ মিনিট পার হয়ে গেল!যাকগে, হয়তো কখন সময় কেটে গেছে টের পাননি। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো, আটটা বাজেই তো মিরাজের চওলে আসার কথা।এলো না যে। আবার বাইরে তাকালেন ফারুক সাহেব। আরে! হচ্ছেটা কি তার সাথে, কিছুই বুঝতে পারছেন না। বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে! অথচ তিনি কিছুই টের পেলেন না!
ফারুক সাহেবের মনে হলো, স্বপ্ন দেখছেন। সেটা যাচাই করার জন্য পাশেই একটা ষ্টীলের স্কেল পড়ে ছিল, তিনি সেটা দিয়ে নিজের হাতে বাড়ি দিলেন।আহ! ব্যাথা তো ঠিকই লাগলো। তার মানে বাস্তবেই এসব ঘটনা ঘটছে।
এখনো মিরাজ এলো না।ওনার চা খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা এনে দেবে কে? আবার ঘড়ি দেখলেন ফারুক সাহেব। আরে! এখন আবার ৯টা বাজলো কীভাবে?
এমন সময় মিরাজ এসে ধুকলো দোকানে।বলল, "ওস্তাদ,মাফ করবেন।বাড়ি থেকে যেই বের হলাম, অমনি দেখি বৃষ্টি শুরু।ছাতা হাতে ছিল অবশ্যি, কিন্তু এমন জোরসে নামলো বৃষ্টি, একটা দোকানের সামনে দাড়ায়ে থাকতে হইলো।এই জন্যি দেরি হয়ে গেলো। মাফ করবেন।দাড়ান, চা আইনে দি।"
এই বলে সে দৌড় দিলো বাইরের দিকে।ফারুক সাহেব বাইরের দিকে তাকালেন। বৃষ্টির জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না।এর মধ্যেই মিরাজ ছেলেটা বাইরে বেরিয়ে গেলো। ছেলেটা বড্ড অদ্ভুত। সবসময় তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকে।
একটু পরেই ফিরে এলো মিরাজ।ওকে দেখে হকচকিয়ে গেলেন।কারন ছেলেটা একটুও ভেজেনি! ফারুক সাহেব বাইরের দিকে তাকালেন। এখনো বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। আরও একটা কারন আছে অবাক হওয়ার। সে এসেছিল সবুজ রঙের একটা ফতুয়া পরে। এখন দেখা যাচ্ছে নীল। ফারুক সাহেব বললেন, "কিরে মিরাজ, তুই সবুজ রঙের ফতুয়া পরে এসেছিলি না? এখন আবার নীল হলো কেমন করে?" সে হেসে বলল, "ওস্তাদ, আপ্নের বয়েস হইসে। চোখের জ্যোতি কইমে গেসে। কি ভুলভাল দেখিসেন।আমি নীল ফতুয়াই পইরে আইসেলাম।"ফারুক সাহেব এবার বললেন, " মিরাজ। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পরতেসে। তুই ভিজলি না যে?" মিরাজ বলল, "কোন বিষ্টি ওস্তাদ?" ফারুক সাহেব বললেন,"তুই নিজেই দেখ বাইরে.... কথা শেষ করতে পারলেন না ফারুক সাহেব। বাইরে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। কোথায় বৃষ্টি? বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পর্যন্ত নেই। শুকনো রাস্তাঘাট। কিছুই বুঝতে পারছেন না ফারুক সাহেব।মিরাজ দোকানে ঢুকেই তো বলল, বৃষ্টির জন্য দেরি হয়েছে ওর।
ফারুক সাহেব বাইরে বেরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন।দেখলেন, মজনুর দোকানের সামনে অনেক লোক জমা হয়ে আছে।মিরাজকে জিজ্ঞেস করলেন, "কি রে মিরাজ, মজনুর দোকানের সামনে এতো বেশি ভিড় কেন রে? বলতে পারিস?" মিরাজ বলল, "ও, ওইখানে দেখলাম এক যুয়ান ছ্যারা মইরে পইরে আসে। কি একটা যন্তর,টেরাক না কি যানি, পিষা ফালাইসে।" ফারুক সাহেব বললেন, "কি কইস, সত্যি! তুই চিনিস ছেলেটাকে?" মিরাজ বলল, " জিনা ওস্তাদ। আমি ক্যাম্নে চিনমু?"
প্রতিদিন বিকেলে পাচটার সময় দোকান থেকে দুজনে একসাথে বেরিয়ে আসেন। আজ দুপুর দেড়টা নাগাদ মিরাজ এসে ফারুক সাহেবকে বলল, "ওস্তাদ, আইজকা বাসায় কিছু কাম আছে। একটু আগে যাওয়া লাগব।" এই দোকানের বয়স প্রায় ১০ বছর হতে চলল। শুরু থেকেই মিরাজ দোকানে কাজ করে। আগে কখনো এমনটা ঘটেনি। কাজেই ফারুক সাহেবের অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক। তিনি তার পরেও বললেন, "ঠিক আছে। ২টা বাজে চলে যাইস।"
দুইটা নাগাদ মিরাজ চলে গেল। মিরাজ চলে যাওয়ার একটু পরেই ফারুক সাহেব ঘড়ি দেখলেন। ৩টা বাজে! একটু আগেই তো গেল মিরাজ। তখন দুইটা বাজছিল। আর এখন! আজ সকাল থেকেই সময়ের এই অদ্ভুত ব্যাপারটা খেয়াল করছেন তিনি। তবে মিরাজ যতক্ষন ছিল, তখন সময় স্বাভাবিক ভাবেই কেটে গেছে।
এমন সময় দোকানের টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফারুক সাহেব সেটা উঠাতেই একটা মেয়ের কন্ঠ ভেসে এল ফোনে।
"হ্যালো, এটা কি আয়শা লন্ড্রি?"
"জি না। এটা আল-মদিনা স্টেশনারী।"
ফোন কেটে গেলো। ফারুক সাহেব কাজে মন দিলেন।
৩ঃ৪৫-এ আবার ফোন বেজে উঠল। সেই মেয়েটাই।
"হ্যালো, এটা কি আল-মদিনা হার্ডওয়্যার?"
" আরে! আজব মেয়ে তো আপনি! একটু আগেই তো বললাম এটা আল-মদিনা স্টেশনারী।"
"ও, আচ্ছা।"
বিকেল ৪ টার দিকে আবারও সেই মেয়েটা ফোন করলো।
"হ্যালো, এটা কি আল-মদিনা স্টেশনারী?"
"জি হ্যা। কিছু বলবেন?"
"আপনার দোকানে একটা ছেলে কাজ করে না? মিরাজ নামে?"
"জি। কিন্তু কেন?"
"জি, সেই ছেলেটা আমার ভাই।সে কি দোকানে আছে এখন?"
"না। কিন্তু তার তো এখন বাড়িতে থাকার কথা। সে আজ দুপুর দুটোর সময় বাড়িতে কাজ আছে বলে চলে গেল।"
"কিন্তু সে তো বাড়িতে পৌছায়নি।"
"সে বাড়ি পৌছুলে আমাকে জানাবেন।"
"জি আচ্ছা।"
বড় আশ্চর্যজনক ব্যাপার মনে হলো ফারুক সাহেবের কাছে।আজ কাস্টমারও বেশি নেই। তাই তিনি বাড়ি চলে গেলেন।
পাশেই একটা মেসে থাকেন তিনি। একাই থাকেন।ছোট্ট একটা ঘর।একটা খাট, একটা আলনা আর একটা টেবিল-এইসব ই আছে ঘরে। আর আছে একটা টিভিসেট। অনেক পুরনো। রাতে খবর দেখার জন্য তিনি এইটা কিনেছিলেন।
রোজ রাত আটটায় খবর দেখেন ফারুক সাহেব। আজও সময়মতো টিভি চ্যানেল অন করলেন।
শিরোনাম বলা শেষ করে সংবাদপাঠক বল্লেন,
"এবার আজকের শীর্ষ সংবাদ। আজ সকাল ন'টা নাগাদ এরশাদনগরের " মজনু টী-স্টল" নামক চায়ের দোকানের সামনে এক ২৪ বছর বয়সী যুবকের চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া লাশ পাওয়া যায়। পরে জানা যায়, যুবকটিকে একটি মালবাহী ট্রাক পিষে ফেলে। চায়ের দোকানের মালিক মজনুর কাছে জানা যায়,ছেলেটির নাম...মিরাজ। পাশের একটা দোকানে কাজ করে। রোজ সকালে এসে চা নিয়ে যায়। আজও যথারীতি চা নিতে আসে। এরপর চা নিয়ে জাওয়ার সময় উক্ত ঘটনা ঘটে।"
ফারুক সাহেব যেন অবুঝ শিশুর মতো কিছুই বুঝতে পারছেন না।
সত্যি! জগতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে, যার ব্যাখ্যা কোনো মহাজ্ঞানীও দিতে পারেন না।
লিখাঃ- মুনা তাবাসসুম
₪ [ post no: 50 ]