₪ পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা (স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট) [post no: 28]
সালটা ১৯৭১ সাল । বাংলাদেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে । পৃথিবীর প্রচুর আকাম নাকি জুলাই মাসে সংঘটিত হয়েছে । আমার জন্মও হয়েছে জুলাই মাসে । এই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আলোচিত, সমালোচিত সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিম্যান্টটাও কিন্তু জুলাই মাসে সংঘটিত হয়েছে ।
আমরা সবাই জানি, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি পৃথিবীর দশটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি । প্রফেসর ফিলিপ জিম্বারডো এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের একজন অধ্যাপক । আর স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট প্রফেসর ফিলিপ জিম্বারডোর করা একটি সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিম্যান্ট ।
কথা ছিলো এক্সপেরিম্যান্টটা চলবে ১৫ দিন । এখানে বেশ কিছু ভল্যান্টিয়ার লাগবে । তাই তিনি স্থানীয় একটি মিডিয়ায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রিক্রুটমেন্ট অ্যাড দিলেন । বলা হলো প্রত্যেককে প্রতিদিন ১৫ ডলার করে দেওয়া হবে ।
১৯৭১ সালে কিন্তু দিনে ১৫ ডলার অনেক টাকা। তখন গ্রাজুয়েশন করছিলো, কিংবা হন্যে হয়ে চাকুরী খুজছিলো এরকম অনেকেই চাকুরীর জন্য অ্যাপ্লাই করলো । সবাইকে একটি সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে সিলেক্ট করা হলো । বেশ অনেকজনকে ওয়েটিং লিস্টে রাখা হলো ।
প্রফেসর ফিলিপ জিম্বারডো সবাইকে তাদের নিজ নিজ কাজের ধারা, নিয়ম, এবং বাউন্ডারি ঠিক করে দিলেন । সবাইকে দুটো গ্রুপে ভাগ করা হলো ।
১। প্রিজন, মানে বন্দী
২। জেলার/জেলের গার্ড
এবং তিনি নিজে সাজলেন জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ।
শুরু হলো পরীক্ষা ।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ৪২০ নাম্বার বিল্ডিং টি হলো সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট । এই ডিপার্টমেন্ট এর একটি সেকশন সাজিয়ে বানানো হলো জেলখানা । সত্যিকারের জেলখানার চেয়ে কোন অংশে কম নয় এই জেলখানা । এই প্রিজনের নাম দেওয়া হলো, স্ট্যানফোর্ড কাউন্টি প্রিজন ।
প্রিজনারদের সত্যি সত্যি বাসা থেকে ধরে নিয়ে আসা হলো । প্রথমেই শুরু হলো জেলের মত কার্যক্রম । বন্দীদের কাপড় খুলে ফেলা হলো, ওদের জেনিটালিয়া নিয়ে ফাজলামী করা হলো । সবার মাথায় পলিথিনের একটা ব্যাগ পুরে দেওয়া হলো । এখানে কারোর কোন নাম নেই । সবাই শুধু নাম্বার দিয়ে পরিচিত । একটি মাত্র নাম্বার ।
প্রথম দিন থেকেই শুরু হলো মানসিক নির্যাতন । কিন্তু তারপরেও প্রথমদিন সবকিছু ঠিকঠাক চললো । প্রফেসর ফিলিপ জিম্বারডো ভাবলেন এটা একটা বোরিং এক্সপেরিমেন্ট হতে যাচ্ছে ।
দ্বিতীয় দিন নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে গেলো বহুগুণ । খেলা শুরু হলো দ্বিতীয় দিন । কিছু কিছু বন্দী বিদ্রোহ করা শুরু করলো ।বন্দী ৮৬১২ এই বিদ্রোহের নেতা । সে বেড টেনে তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো যাতে করে জেলাররা ঢুকতে না পারে । গার্ডরা ধীরে ধীরে তাদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো । চূড়ান্তভাবে মানসিক নির্যাতন করা শুরু করলো । এতটা নির্যাতন করতে হবে এটা ওদেরকে বলে দেওয়া হয়নাই ।কিন্তু ওরা অদ্ভুতভাবেই এটা করতে শুরু করলো । গার্ডরা ওদের সারারাত ঘুমাতে দিতোনা, টয়লেট করতে হতো পট কিংবা বালতিতে এমনকি নিজ হাতে বন্দীদের সেটা সাফ করতে হতো ।
আপনারা খেয়াল করবেন যে, ওরা সবাই কিন্তু জানতো ওরা শুধুই ১৫ দিনের জন্য একটা এক্সপেরিম্যান্ট করছে, মানে অভিনয় করছে, কিন্তু এই অভিনয় করতে করতেই যে ব্যাপারটা এত সিরিয়াস হয়ে যাবে ব্যাপারটা বুঝে ওঠেননি খোদ প্রফেসর ফিলিপ জিম্বারডো । কিন্তু যা হচ্ছে তার ফল তাঁর পরীক্ষার জন্য ভালোই । এর মধ্যে তিনি নিজেও কিন্তু এই খেলার মধ্যে কখন ডুবে গেছে উনি নিজেও বুঝতে পারেননি ।
পরের দিনই বন্দী ৮৬১২ এই পরীক্ষা ছেড়ে চলে যেতে চান । জিম্বারডো বলেন “তুমি থাকো, তোমাকে তো ওরা গায়ে মারেনি” ।৮৬১২ ফিরে আসেন । সে এসে বাকী প্রিজনারদের বলে, “কাউকেই বাহিরে যেতে দেওয়া হবেনা, ১৫ দিন এভাবেই থাকতে হবে।“
যদিও এটা কখনই বলা হয়নি । কিন্তু সে যেহেতু বিদ্রোহিদের নেতা, এবং এসে সবাইকে এটা বলেছে, সবাই মেন্টালি আরও ঘাবড়ে যায় ।
প্রিজনার ৮৬১২ একেবারেই ভেঙ্গে পরে, এবং তার মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়া শুরু হতে থাকে, সে পাগলপ্রায় হয়ে যায় ।ওকে রিলিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । এর মাঝে প্রফেসর নিজেও এটার মধ্যে সাইকোলজিক্যালি এমনভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়েন যে, তিনিও যাতে এই জেলখানা ঠিক ঠাক মত আরও ১২-১৩ দিন চলে সেভাবে শক্ত ভূমিকা নেওয়া শুরু করেন । প্রিজনার ৮৬১২ যাতে অন্য কাউকে মুক্ত করতে না পারে, সেজন্য প্রফেসর জেলখানাটাকে অন্যদিকে সরিয়ে নেন।
প্রফেসর নিজেও পাগলপ্রায় হয়ে যান । এদিকে জেলাররাও ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পরে, এবং তাদের ফ্রাস্টেশন বন্দীদের ওপর দিয়ে মেটায় ।তারা পরের রাত গুলোতে বন্দীদের আর ঘুমাতে দেয়না । ৮১৯ নাম্বার প্রিজনার এর পরে বিদ্রোহ করে । সে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয় । সে জানায় সে চলে যেতে চায় । কিন্তু জেলাররা অন্য কয়েদিদের বুঝায়, তারা যেন ৮১৯ কে চিৎকার করে বলে, তুই খারাপ কয়েদী, তুই খারাপ কয়েদী । সে কাঁদতে কাঁদতে প্রফেসরকে বলে সে মরুক কিংবা বাঁচুক, সে জেলেই থেকে যেতে চায় । যাহোক তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়, পরিবর্তে ওয়েটিং লিস্ট থেকে অন্য আরেকজনকে আনা হয়, নাম দেওয়া হয় ৪১৬ । ওর ওপরে আরও বেশী অত্যাচার করা হয় । ৪১৬ এর ওপরে এমন অত্যাচার করা হয়, সে পরের দিনই আমরণ অনশনে চলে যায় । এখানে প্রিজনারদের যে প্রিজনারের মতই আচরণ করেই যেতে হবে, এরকম কিন্তু বলা হয়নি, কিন্তু সবাই এমনভাবে খেলাটাতে মানসিক ভাবে জড়িয়ে পরে, যে ওরা ওদের চরিত্রের বাহিরে অন্য কিছুই চিন্তা করতে পারছিলো না । কেউ আগ বাড়িয়ে এটাও বলেনা যে, এটা শুধুই খেলা, একটা পরীক্ষা বৈ কিছু নয় ।
ওদের আচরনে জেলাররা আরও ক্ষেপে যায় । ৪১৬কে একটি অন্ধকার বদ্ধ ঘরে আটকে রাখা হয় । এবং বাকী কয়েদীদের দ্বারাও মেন্টালি নির্যাতন করা হয় । তখন কেবল ৫ম দিন। আরও দশ দিন তখনও বাকী ।
ষষ্ঠদিনে আরেকজন প্রফেসর ক্রিস্টিনা মাশলাখ ভিজিটে আসেন, এবং এই এক্সপেরিমেন্টের নির্মমতা দেখে খুবই ক্ষিপ্ত হন । উনি নিজেও খুব ভয় পেয়ে যান । উনি প্রফেসর জিম্বারডোকে বুঝান, এই তরুনরা যে সাফার করছে, এটার জন্য আপনি দায়ী হবেন । আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ঝামেলাও হতে পারে ।
এরপরের দিনই প্রফেসর জিম্বারডো এই সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষাটি বন্ধ করে দেন । এই পরীক্ষাটি পুরো বিশ্বে একটি আলোড়ন তুলে দেয় । এর পরে এ ধরণের সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষায় যেন কেউ শারীরিক কিংবা মানসিক ভাবে নির্যাতিত না হয় সেটার আইন পাশ করা হয়।
কিন্তু এবার আসি আসল কথায়, এই পরীক্ষাটি যত নির্মম কিংবা সমালোচিত হোক না কেন, এটার দ্বারা লব্ধ রেজাল্ট কিন্তু সবার জন্য একটি বিশাল প্রাপ্তি ।
সেটা হলো, “কাউকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হয়, সেই মানুষ আপাতঃ দৃষ্টিতে যত সাধারণই মনে হোক না কেন সে একজন ডেভিল কিংবা দানবে রুপ নিতে পারে ।আর মানসিক চাপে পরে অনেকেই মানে যাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে তারা প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলতে পারে ।“
এ ধরণের কেইস কি আমাদের সমাজে কিংবা পৃথিবীতে দেখতে পান?
আমি পাই।
যা হোক, ভালো থাকবেন সবাই।
লেখাঃ- তৌহিদ রিয়াজ